সর্বরোগহর জাতীয়তাবাদ
Narendra Modi

বিপদ যত বাড়ছে, ‘আল ইজ় ওয়েল’-এর হাঁক তত জোরদার

পরিসংখ্যান যে দিন জানাল, লকডাউনের আগেই ভারতীয় অর্থব্যবস্থা ধরাশায়ী হয়েছিল, সে দিনই চিঠিতে এমন দুর্মর আশাবাদ— নেহাতই সমাপতন?

Advertisement

অমিতাভ গুপ্ত

শেষ আপডেট: ০৮ জুন ২০২০ ০০:০১
Share:

আল ইজ় ওয়েল!’ র‌্যাঞ্চোর গ্রামের চৌকিদারের এই হাঁক শুনে সবাই নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ত। তার পর যে দিন গ্রামে চুরি হল, সে দিন টের পাওয়া গেল যে চৌকিদার বেচারা রাতে দেখতে পান না। গত কয়েক দিন ধরে প্রধানমন্ত্রী মোদীর ভাষণ শুনে, চিঠি পড়ে কেবলই সেই র‌্যাঞ্চোর গ্রামের চৌকিদারের কথা মনে পড়ছে। ‘চৌকিদার’ বলে নয়— প্রধানমন্ত্রীর কথায় ‘আল ইজ় ওয়েল’-এর সুরটা বড় জোরদার বলে।

Advertisement

মে মাসের শেষে জানা গেল, লকডাউন আরম্ভ হওয়ার আগেই ভারতীয় অর্থনীতির কঙ্কালসার অবস্থা হয়েছিল। জানুয়ারি থেকে মার্চ, এই তিন মাসে আর্থিক বৃদ্ধির হার কমে দাঁড়িয়েছে ৩.১ শতাংশে— সতেরো বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম বৃদ্ধি। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই হিসেবেও নাকি জল মেশানো আছে। তিন মাসের বৃদ্ধির হার হিসেব করার যে পদ্ধতি সচরাচর ব্যবহার করা হয়, সে ভাবে হিসেব করলে এই হার দাঁড়াবে এক শতাংশের একটু বেশি। ২০১৯-২০ সালের গোটা বছরের বৃদ্ধির হারও এসে দাঁড়িয়েছে ৪.২ শতাংশে। অর্থনীতির এই হাঁড়ির হাল বহু দিন হয়নি। মজার কথা হল, যে দিন এই তথ্যগুলো প্রকাশিত হল, সে দিনই প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে একটা চিঠি লিখলেন। তাতে জানালেন, কোভিড-১৯’এর ফলে যে আর্থিক সঙ্কট তৈরি হয়েছে, তার থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে ভারত গোটা দুনিয়ার কাছে উদাহরণ হবে। কী ভাবে? প্রধানমন্ত্রী জানালেন, ‘ভারতের মাটির সুগন্ধের সঙ্গে ঘাম, কঠোর পরিশ্রম এবং দেশের শ্রমশক্তির প্রতিভা মিলেমিশে’, সরকার-ঘোষিত কুড়ি লক্ষ কোটি টাকার আর্থিক প্যাকেজের সহায়তায়, দেশে ‘উৎপাদন বাড়বে, আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা কমবে, দেশ আত্মনির্ভরতার পথে হাঁটবে’।

পরিসংখ্যান যে দিন জানাল, লকডাউনের আগেই ভারতীয় অর্থব্যবস্থা ধরাশায়ী হয়েছিল, সে দিনই চিঠিতে এমন দুর্মর আশাবাদ— নেহাতই সমাপতন? ঠিক যখন জানা যাচ্ছে যে প্রবাস থেকে ঘরে ফিরতে চেয়ে শ্রমিক স্পেশাল ট্রেনের কামরাতেই খিদের জ্বালায়, জলের অভাবে, তীব্র গরমে মারা যাচ্ছেন একের পর এক শ্রমিক, যখন কাজ হারিয়ে গভীরতম অনিশ্চয়তার গহ্বরে পড়ছেন নিম্নমধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত মানুষরা, তখনই প্রধানমন্ত্রী লিখলেন, ‘কোভিড-১৯ অতিমারির বিরুদ্ধে লড়াইটা লম্বা ছিল বটে, কিন্তু ভারত জয়ের পথে হাঁটতে আরম্ভ করেছে’— শুধুই দেশের মানুষের মনে আশা জিইয়ে রাখার চেষ্টা? না কি, খুব সচেতন ভাবে একটা অন্য গল্প খাইয়ে দেওয়ার ছক?

Advertisement

দিন চারেক পরের কথা বলি। আন্তর্জাতিক রেটিং সংস্থা মুডিজ় বহু বছর পরে ভারতকে ‘ডাউনগ্রেড’ করল। এই রেটিংকে গুরুত্ব দেওয়ার দরকার আছে কি না, তা নিয়ে দ্বিমত থাকতেই পারে— রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ বাড়লেই এই জাতীয় রেটিং সংস্থা রেগে যায়। কিন্তু, মুডিজ় যে কথাগুলো বলল, সেগুলো উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। তারা জানাল, কোভিড-১৯ বা লকডাউনের কারণে নয়, ভারতীয় অর্থব্যবস্থার সমস্যা কাঠামোগত। এবং, ভারত খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়েই এগোবে— আট শতাংশ হারে বৃদ্ধির যে দিন গেছে, অদূর ভবিষ্যতে তা ফেরার সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ। পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণ এই কথাটাকে ভিত্তিহীন বলার কোনও উপায় রাখেনি। মুডিজ়-এর ঘোষণার দু’দিন পর, এক বণিকসভার সম্মেলনে ভিডিয়ো বক্তৃতায় মোদী বললেন, ‘আর্থিক বৃদ্ধি ফিরবেই’— ভারতে আনলক ওয়ান আরম্ভ হচ্ছে, ‘মানে, বৃদ্ধির পথে ফেরত আসার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে।’ তিনি নিজেই প্রশ্ন করেছেন, তিনি এত আশাবাদী কেন; নিজেই উত্তর দিয়েছেন: আমার আশাবাদী হওয়ার অনেক কারণ আছে— ভারতের ক্ষমতা, আর সঙ্কট সামলানোর শক্তির ওপর আমার ভরসা আছে।’ সদ্‌গুরু মার্কা কেউ এই কথাটা বললে ব্যাপারটা বুঝে নেওয়া যেত, কিন্তু আর্থিক মহাপ্রলয়ের যাবতীয় তথ্যপ্রমাণের মুখে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী কেন বলে চলেন, ‘আল ইজ় ওয়েল’?

র‌্যাঞ্চোর গ্রামের চৌকিদার রাতে দেখতে পেতেন না। প্রধানমন্ত্রী সম্বন্ধে সে কথা ভাবার ধৃষ্টতা আমাদের নেই। তিনি কি জানেন না, যে প্যাকেজকে তিনি অর্থনীতির কবচকুণ্ডল হিসেবে দেখাচ্ছেন, সেটা আসলে একটা প্রকাণ্ড ধাপ্পা— কুড়ি লক্ষ কোটি টাকা নয়, তাতে সরকারের নতুন ব্যয়ের পরিমাণ মেরেকেটে আড়াই লক্ষ কোটি? তিনি জানেন না, ওইটুকু টাকা খরচ করে অর্থনীতির স্বাস্থ্যোদ্ধার অসম্ভব? এটাও জানেন না যে তাঁর প্যাকেজে থাকা ঋণের নাগাল দেশের সিংহভাগ মানুষ পাবেন না— চায়ের দোকানি বা ফুচকাওয়ালাকে ব্যাঙ্ক ঋণ দেবে না, তা সে অর্থমন্ত্রী যা-ই বলুন? সবচেয়ে বড় কথা, তিনি জানেন না যে গোটা দুনিয়া কোভিড-১৯ নামক অতিমারির নাম শোনার আগেই ভারতীয় অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছিল? দেশের আশি শতাংশ মানুষ যখন এতখানি বিপন্ন, তখন কোনও মতেই বলা যায় না যে দেশ ঘুরে দাঁড়াচ্ছে— এই মানুষগুলোকে বাদ দিয়ে দেশ হয় না?

তবুও প্রধানমন্ত্রী কেন দুনিয়াজয়ের খোয়াব ফেরি করছেন? অকারণে নয়। তাঁর সম্পূর্ণ বাস্তববর্জিত ন্যারেটিভের একটা নির্দিষ্ট অভিমুখ আছে— তিনি বলছেন: মোদী হ্যায়, তো মুমকিন হ্যায়। স্লোগানটা পুরনো, পরীক্ষিত। কিন্তু, যেখানে যাবতীয় প্রমাণ বলছে মোদী অর্থনীতির হাল ধরতে বিশ্রী রকম ব্যর্থ, সেখানেও কি এই স্লোগানে কাজ হবে? এখানেই নরেন্দ্র মোদীরা রাজনীতির মূল কথাটাকে মোক্ষম ধরেছেন। অর্থব্যবস্থার কী অবস্থা হল, এবং তার পিছনে শাসকদের দায় কতখানি, সেটা বুঝতে গেলে অর্থশাস্ত্রে যেটুকু দখল লাগে, একশো ত্রিশ কোটির মধ্যে কত জনেরই বা তা আছে? দেশ ঠিক চলছে কি না, সেটা মানুষ আসলে বোঝে গল্পের ওপর ভিত্তি করে। নরেন্দ্র মোদী জানেন, কী ভাবে অনাগত সাফল্যের গল্প তৈরি করতে হয়— কী ভাবে সেই গল্পের সঙ্গে জুড়ে দিতে হয় দেশকে, যাতে সেই সাফল্যের প্রমাণ নেহাতই বাহুল্যে পরিণত হয়। নোটবাতিলের পর যেমন তিনি মানুষকে বিশ্বাস করাতে পেরেছিলেন, দেশের শত্রুদের শায়েস্তা করার জন্য এই কঠিন সিদ্ধান্তটা করতেই হত। এই দফাতেও তিনি প্রতি বার মনে করিয়ে দিচ্ছেন— ভারত শুধু ঘুরে দাঁড়াবে, তা-ই নয়; গোটা দুনিয়ার কাছে দৃষ্টান্ত হবে, বাইরের পণ্য বর্জন করে দেশের মাটি, দেশের ঘামে আত্মনির্ভর হবে ইত্যাদি। অর্থাৎ, এখন অবধি যা বিপত্তি, তার দায় অতিমারির; এর পর থেকে যা হবে, তা যুদ্ধ। অমিত শাহ কেন হঠাৎ শুধু দেশি পণ্য কেনার পরামর্শ দেন, আইটি সেল ঠিক এখনই চিনা পণ্যকে বয়কট করার ডাক দেয় কেন— মোদীর এই বয়ানকে বাদ দিয়ে সেই কথাগুলো বোঝা যাবে না।

অর্থনীতিকে এই স্বদেশি, আত্মনির্ভর জাতীয়তাবাদের গল্পে মুড়ে ফেলার মস্ত সুবিধা রয়েছে। জিডিপির বৃদ্ধির হার নয়, আর্থিক অসাম্য কমানো নয়— মোদীদের গল্প মানুষকে বলবে, অর্থনীতির ভাল-মন্দ মাপতে হবে দেশাত্মবোধের সূচকে। যেহেতু ভারতের আত্মনির্ভরশীলতা শুধু দেশের উৎপাদন বৃদ্ধিতেই সীমাবদ্ধ নয়, তার অন্যতম উদ্দেশ্য চিনকে ‘সবক’ শেখানোও বটে, ফলে মানুষের গায়ে সমস্যার আঁচ লাগবে, বিলক্ষণ— কিন্তু, বর্ডারে সৈনিকরা লড়লে এটুকু তো সহ্য করতেই হবে। যুদ্ধ যখন, তার ধাক্কা দেশের গায়ে লাগলে তার জন্য কেউ মোদীজির দিকে আঙুল তুলবে কেন? যুদ্ধের মধ্যে প্রধান সেনাপতিকে যে বিব্রত করে, সে শত্রু বই কী? অর্থনীতির বয়ান যত বেশি জাতীয়তাবাদী হবে, ততই সহজ হবে বিরুদ্ধবাদীদের অবস্থানকে সম্পূর্ণ অবৈধ ঘোষণা করে দেওয়া। নরেন্দ্র মোদীর আর্থিক নীতি নিয়ে প্রশ্ন করলেই সেই দেশদ্রোহীকে পাকিস্তানে বা চিনে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া যাবে।

গত ছ’বছরে ভারত দেখেছে, কী ভাবে প্রতিটি প্রশ্নকে উগ্র জাতীয়তাবাদের ময়দানে টেনে এনে বিরোধী পক্ষকে গোহারান হারিয়েছেন নরেন্দ্র মোদীরা। যে কোনও প্রসঙ্গকেই দেশপ্রেম বনাম দেশদ্রোহের ছকে ঢেলে নিলে সাধারণ মানুষেরও বুঝতে সুবিধা হয়। জিনি কো-এফিশিয়েন্ট বা গ্রস ক্যাপিটাল ফর্মেশন বোঝেন যত জন, তার বহু লক্ষ গুণ বেশি মানুষ বোঝেন, দেশের জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। এ বার অর্থনীতিকেও জাতীয়তাবাদের ছকে সেজে নিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। জানাচ্ছেন, তিনি পারবেন— তিনিই পারবেন— এই যুদ্ধে ভারতকে নেতৃত্ব দিতে। এ দিকে তাঁর আমলে দেশে বেকারত্বের হার অর্ধশতকের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে গিয়েছে; গ্রামাঞ্চলে মানুষের ভোগব্যয় ২০১২ সালে যা ছিল তারও নীচে নেমেছে; এবং আর্থিক বৃদ্ধির হার নেমে গিয়েছে প্রায় দুই দশকের সর্বনিম্ন স্তরে।

র‌্যাঞ্চোর গ্রামের সেই চৌকিদারও বুঝবেন, আল ইজ় নট ওয়েল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement