কাপড় কোথায়

স ‌ংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে যাহারা প্রতিবাদ করিতেছে, তাহাদের পোশাক দেখিয়াই চিনিয়া লওয়া যায়— জানাইয়াছেন নরেন্দ্র মোদী।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০১৯ ০০:১৬
Share:

নরেন্দ্র মোদী।

স ‌ংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে যাহারা প্রতিবাদ করিতেছে, তাহাদের পোশাক দেখিয়াই চিনিয়া লওয়া যায়— জানাইয়াছেন নরেন্দ্র মোদী। কোন পরিচ্ছদের কথা বলিতেছেন, তিনি ভাঙিয়া বলেন নাই। বলিবার প্রয়োজনও নাই। কোন পোশাকের কথা বলা হইতেছে, তাহা যিনি বলিয়াছেন এবং যাঁহাদের উদ্দেশে বলিয়াছেন, উভয় পক্ষেরই না বুঝিবার কারণ নাই। প্রধানমন্ত্রী হইয়া এমন একটি ভয়ানক সঙ্কেত-জর্জর কথা কাহারও পক্ষে বলা সম্ভব, তাহা জানিয়া বোধ করি আজ আর ভারতবাসী বিস্মিত হইবেন না। বরং প্রধানমন্ত্রীকে একটি অন্য প্রশ্ন করা যাইতে পারে: পোশাক দেখিয়া অনুপ্রবেশকারী চিনিবার কোনও অলৌকিক শক্তি তাঁহার আছে কি? ‘চিহ্নক’-এর যে ইঙ্গিত তাঁহার বাচনে সুস্পষ্ট, তাহা এই উপমহাদেশে বহু মুসলমানের পোশাকে (বা অঙ্গসজ্জায়) বহুলপরিচিত। তাঁহাদের মধ্যে কে ‘স্বদেশি’, কে ‘অনুপ্রবেশকারী’, ‘দেখিয়া’ই তাহা বলিয়া দেওয়ার কোনও উপায় নাই, এমনকি মহাবলী মোদী-শাহের নাগালেও নাই। অতএব, অনুমান করা চলে, প্রধানমন্ত্রী বলিতে চাহিয়াছেন যে, মুসলমান মাত্রকেই পোশাক দিয়া চিনিতে হইবে এবং তাঁহাদের সম্পর্কে ‘কী করণীয়’ তাহা বুঝিয়া লইতে হইবে। অর্থাৎ নাগরিক পঞ্জি এবং নাগরিকত্ব আইনের মহাতাণ্ডবে যে কথাটি তাঁহারা বলিতে বলিতেও বলিয়া ফেলেন নাই, ঝাড়খণ্ডের নির্বাচনী জনসভায় সেই কথাটিই যেন ভক্তবৃন্দের কানের ভিতর দিয়া মরমে পৌঁছাইয়া দেওয়া হইল। লক্ষণীয়, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন কার্যত নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণের দায়টি মুসলমানের উপরই চাপাইয়া দিয়াছে— তিনি যত ক্ষণ না নিজেকে ভারতীয় হিসাবে প্রমাণ করিতে পারিতেছেন, রাষ্ট্র তত ক্ষণ তাঁহাকে অনুপ্রবেশকারী হিসাবেই দেখিবে। একই রকম স্পষ্ট এই আশঙ্কা যে এনআরসি-তে নাম তুলিবার কাজটি সকলের পক্ষেই কঠিন, এবং মুসলিম মানুষের পক্ষে বিশেষ ভাবে কঠিন হইবে। চেহারা ‘দেখিয়া চিনিবার’ উপদেশটি শুনিলে এই আতঙ্ক স্বাভাবিক যে— দুই ব্যবস্থার সাঁড়াশিতে মুসলমান ধরিবার, তাঁহাদের নাগরিকত্ব নাকচ করিবার আয়োজন সম্পন্ন হইতেছে।

Advertisement

দৃশ্যত, প্রধানমন্ত্রী তথা তাঁহার সতীর্থদের অন্তঃকরণটি তাঁহার ওই উক্তিতে ধরা পড়িয়া গিয়াছে। দেশব্যাপী বিপুল প্রতিবাদে তাঁহারা চাপে পড়িয়াছেন এবং তাহার ফলেই মুখ ফসকাইয়া মনের কথাটি বাহির হইয়া পড়িতেছে— এমনটি অসম্ভব নহে। আবার, ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ হইতে যাঁহারা নরেন্দ্র মোদীর রাজনৈতিক জীবনের দিকে লক্ষ্য রাখিতেছেন তাঁহারা হয়তো বলিবেন, নরেন্দ্র মোদী ধরা পড়িবার লোক নহেন, তিনি বড় জোর স্বেচ্ছায় ধরা দিতে পারেন। অর্থাৎ, হইতেই পারে, তাঁহার মনে কী আছে, দেশবাসীকে তাহার এক ঝলক দেখাইয়া দিলেন প্রধানমন্ত্রী। ভক্তবৃন্দের প্রতি একটি সঙ্কেত ছুড়িয়া রাখিলেন। ইংরাজিতে যাহাকে ‘ডগ হুইস্‌ল’ বলা হয়।

প্রশ্ন অবশ্য অন্ধভক্তদের লইয়া নহে। গত কয়েক বৎসরে ভারত দৃশ্যত যেখানে পৌঁছাইয়াছে, সেখানে বিপুলসংখ্যক মানুষই বোধ করি আর দেশের সাংবিধানিক চরিত্র লইয়া ভাবিত নহেন। ভারত একটি হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত হইলেও তাঁহাদের কিছু বলিবার নাই। মোদী এই কথাটি মোক্ষম বুঝিয়াছেন, ফলে জনসভায় দাঁড়াইয়া নিজের মনের স্বরূপ দর্শন করাইতে তিনি দ্বিধা করেন না। তাই, প্রধানমন্ত্রী কোন অতলে নামিতে পারেন, তাহা লইয়া বিচলিত হইবার পূর্বে ভাবা প্রয়োজন, দেশটি কোথায় পৌঁছাইল। উদারবাদী ভাবনার সহিত যাঁহাদের যোগ নাই, তেমন মানুষের নিকট এই সুতীব্র বিদ্বেষ অস্বাভাবিক ঠেকিতেছে না, অগ্রহণযোগ্য বোধ হইতেছে না— ইহাই এই সময়ের সর্ব বৃহৎ বিপদ। রাজার কাপড় নাই, তাহার তুলনায় ঢের বেশি উদ্বেগজনক রাজার মুখের উপর এই কথাটি বলিবার মতো সাবালকের খোঁজ নাই।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement