অন্বেষা: প্রজাতন্ত্র দিবসের সকালে শাহিনবাগে পতাকাশোভিত জনপ্লাবন, দিল্লি, ২৬ জানুয়ারি। পিটিআই
অনেক দিন পরে রবীন্দ্রনাথের একটি গান আবার মন দিয়ে শুনলাম। পড়লামও। তার প্রথম দুই পঙ্ক্তি: ‘কোন্ খেলা যে খেলব কখন্ ভাবি বসে সেই কথাটাই—/ তোমার আপন খেলার সাথি করো, তা হলে আর ভাবনা তো নাই।’ পূজা পর্যায়ের এই গানকে বরাবরই শুনে এসেছি নিবেদনের গান হিসেবে। সেই গান এক সময় বলে, ‘তোমার নিঠুর খেলা খেলবে যে দিন বাজবে সে দিন ভীষণ ভেরী’। এবং তা শেষ হয় পরম নিবেদনে: ‘সে দিন যেন তোমার ডাকে, ঘরের বাঁধন আর না থাকে/ অকাতরে পরানটাকে প্রলয়দোলায় দোলাতে চাই।’ আগমার্কা রবীন্দ্রনাথ।
কিন্তু, আগে ভাবিনি, আজ মনে হল, অন্য অর্থও কি নেই এ গানের? যদি না-ও থাকে, আমরা কি তা তৈরি করে নিতে পারি না আমাদের চেতনার রঙে? যে চেতনা তার সমকালের সন্তান? যে সমকালের পরতে পরতে প্রলয়দোলার আকর্ষণ? সেই আকর্ষণে বহু মানুষ ঘর ছেড়ে পথে এসে দাঁড়াচ্ছেন, পায়ে পা মেলাচ্ছেন, হাতে হাত, প্রজাতন্ত্র দিবসে শত শত মাইল মানববন্ধন রচিত হচ্ছে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদী আবেগে। তাঁরা জানেন, এই আন্দোলন চড়ুইভাতি নয়, চিত্রগুপ্তের খাতায় দেশদ্রোহের খতিয়ান লেখা হচ্ছে, অনেককেই হাতে হাতে শাস্তি চুকিয়েও দেওয়া হচ্ছে, যোগী আদিত্যনাথের মহান প্রদেশটির কথা ছেড়েই দিলাম, খাস রাজধানীতে প্রজাতন্ত্র দিবসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভোটসভায় ‘এনআরসি ফেরত নিন’ আওয়াজ তুলে বেধড়ক মার খাচ্ছেন ভারতের প্রজা। জেনেশুনে এত মানুষ যখন সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে ক্ষমতার মুখের ওপর সত্যের বাণী ছুড়ে দেন, তখন যদি মনে করি, ‘তোমার ডাকে’ ঘরের বাঁধন ছিঁড়ে গিয়েছে বলেই এমনটা হয়ে উঠতে পারল, তাঁর নিবেদনের গানে যদি জাগরণের আবেগ খুঁজে পাই, তা হলে রবীন্দ্রনাথ অন্তত আপত্তি করবেন না।
এ আবেগের মূল্য স্বীকার না করলে কেবল ভুল হবে না, বোকামিও হবে। খেয়াল করা দরকার, যাঁরা রাষ্ট্র চালাচ্ছেন তাঁরা এই আবেগের সামনে বিস্মিত, বিভ্রান্ত, ঈষৎ বেসামালও। তাঁদের আত্মপ্রত্যয় ভেঙে গিয়েছে বললে অত্যুক্তি হবে। কিন্তু সে বস্তুটি যে কিঞ্চিৎ মচকেছে, তাঁদের ভাবগতিক দেখলেই সে কথা বোঝা যাচ্ছে। তাঁরা বুঝতে পারছেন না, নেতা নেই, রাজনৈতিক দল নেই, তা সত্ত্বেও কেমন করে লক্ষ লক্ষ মানুষের এই প্রলয়দোলা আন্দোলিত হয়ে চলতে পারে! যূথশক্তি আর অর্থের জোর ছাড়া যাঁরা কিছুই করতে শেখেননি, তাঁদের পক্ষে এই জনজাগরণের তল পাওয়া কঠিন বইকি।
কিন্তু প্রশ্ন উঠবেই— এই আন্দোলনের মেয়াদ কত দিন? কতটুকুই বা এর প্রকৃত শক্তি? সংশয়ীরা বলবেনই যে, প্রতিবাদ বিক্ষোভ সবই তো কিছু শহুরে পরিসরে সীমিত, দেশের বেশির ভাগ মানুষের এ-সব নিয়ে মাথাব্যথা নেই, তাঁরা দিনগত পাপক্ষয়ে নাজেহাল। বাজার চড়ছে, ব্যবসাপাতি নেই, চাকরি নেই— এগুলো নিয়ে তাঁদের চিন্তা আছে নিশ্চয়ই, সে জন্যে সরকারের ওপর রাগও জমছে, কিন্তু সংবিধানের প্রস্তাবনা কিংবা আজাদির স্লোগান তাঁদের কাছে অপ্রাসঙ্গিক। তাই দেখতে দেখতে প্রতিবাদের বেগ স্তিমিত হবে, সব পাখি ঘরে ফিরবে, ক্ষমতার অধীশ্বরেরা বিস্ময় কাটিয়ে জাতীয়তাবাদের ঘর গুছিয়ে নেবেন, আরবান নকশালদের উচ্ছ্বাস সরে গেলে দেখা যাবে, মেরুকরণের সীমারেখা আরও স্পষ্ট হয়েছে, হিন্দু ভোট আরও সংহত।
আবেগ যত মূল্যবান হোক, এই সংশয়ও উড়িয়ে দেওয়ার নয়। রাষ্ট্রীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে কী ভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে, সেই প্রশ্ন ইতিমধ্যেই বড় আকার ধারণ করেছে, সুচিন্তাশীল মানুষ সেই বিষয়ে নানা মূল্যবান পরামর্শ দিচ্ছেন। যেমন, অর্থনীতি ও দর্শনের বিশেষজ্ঞ অমর্ত্য সেন এক সাক্ষাৎকারে (‘ইট ডিপেন্ডস অন হাউ দি ইমার্জিং ইয়ং লিডার্স ম্যচিয়োর’, দ্য টেলিগ্রাফ, ২৬-১) বলেছেন, বিভিন্ন সমস্যা এবং বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রতিবাদগুলির মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে তাদের বিভিন্নতাকে গুরুত্ব দেওয়াও আবশ্যক— কোনও একটি বা এক ধরনের লক্ষ্য যেন একমাত্র লক্ষ্য হয়ে না দাঁড়ায়। এ-কথার সূত্র ধরেই বলতে পারি, আর্থিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক বহু প্রশ্নে বর্তমান শাসকদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে বহুমাত্রিক প্রতিবাদ গড়ে তোলা দরকার, এখনও তাতে বিস্তর ঘাটতি আছে। এমনকি, নাগরিকত্ব সংক্রান্ত আন্দোলনেও অর্থনীতির প্রশ্নকে তার প্রাপ্য গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। সিএএ-এনআরসি’র বিপদ যে দরিদ্র এবং সুযোগবঞ্চিত মানুষের ক্ষেত্রে অনেক বেশি, বামপন্থী দলগুলি সে কথা বলছেন ঠিকই, কিন্তু সমস্যার শ্রেণি-চরিত্রটি তাঁদের আরও অনেক বেশি স্পষ্ট করে দেখানো উচিত।
তেমনই, সংখ্যালঘু সমাজের মানুষ, বিশেষত মেয়েরা যে ভাবে সমবেত হয়েছেন এবং বৃহত্তর সমাজ যে ভাবে তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছে, সেই অ-পূর্ব সংহতির সম্ভাবনা বিপুল। কিন্তু তা চরিতার্থ করতে গেলে আরও অনেক কাজ করা দরকার, বিশেষত দরকার আর্থিক ও সামাজিক বঞ্চনার কাঠামো ও প্রক্রিয়াগুলির স্বরূপ উন্মোচন করা, তাদের তীব্র সমালোচনা তৈরি করা, সেই সমালোচনার ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলা। ইতিহাসবিদ সুগত বসু (‘সামনে দীর্ঘ সত্যাগ্রহ’, আবাপ, ২৫-১) যে সত্যাগ্রহের কথা বলেছেন, তাকে সম্ভবত এই বিভিন্ন আন্দোলনের সমন্বয়ের মধ্য দিয়েই আত্মনির্মাণ করতে হবে, আত্ম-অন্বেষণও।
এবং প্রয়োজন সংগঠনের। যে ‘নেতৃহীন’, ‘অসংগঠিত’ সমাবেশ ভারতীয় গণতন্ত্রের অভিজ্ঞান হয়ে উঠল, তার মূল্য অসীম। কিন্তু ভুললে চলবে না, লড়াইটা এমন এক রাষ্ট্রশক্তির সঙ্গে, যে অতিমাত্রায় সংগঠিত, প্রতিবাদ দমনে সেই সংগঠনকে সমস্ত প্রকারে কাজে লাগাতে তার কিছুমাত্র নৈতিক দ্বিধাবোধ নেই। তার পাশাপাশি, বিরোধী রাজনীতির মঞ্চে প্রতিস্পর্ধী নেতৃত্বের যে অভাব এখনও প্রকট, রাহুল গাঁধী নামক সোনার হরিণের পিছনে না ছুটে যে অভাব মেটানোর দায় নাগরিক (ও রাজনৈতিক) সমাজকেই নিতে হবে, তার মোকাবিলার জন্যও সংগঠনের বিশেষ প্রয়োজন আছে।
কেমন হবে সেই সংগঠন? বিরোধী রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর সঙ্গে তার সম্পর্ক কী হবে? নাগরিক সমাজেরই বা সেখানে কোন ভূমিকা থাকবে? কোনও হাতে-গরম উত্তর নেই। থাকতে পারেও না। মনে পড়ে, প্রজাতন্ত্রের ষাট বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রকাশিত হয়েছিল অরুণা আসফ আলির কয়েকটি লেখার ছোট্ট সঙ্কলন: ওয়ার্ডস অব ফ্রিডম (পেঙ্গুইন)। মহারাষ্ট্রে কংগ্রেসের রাষ্ট্র সেবা দল-এর কাজের ফাঁকে, সম্ভবত ১৯৪৬ সালে, লেখা ‘ফ্রেটারনিটিজ়: সোশ্যাল গ্রুপিংস’ নিবন্ধের শুরুতেই এই বামপন্থী সমাজকর্মী লিখেছিলেন, ‘‘আবেগের বশে কাজ করাটা সচরাচর নিন্দিত হয়, কারণ তাতে ফল মেলে না। তবে বড় বড় ঐতিহাসিক আন্দোলনগুলির ক্ষেত্রে দেখা গেছে, স্বতঃস্ফূর্ততা সর্বগ্রাসী আগুন জ্বালাতে পারে।’’ সেই আগুনকে সুপরিবর্তনের কাজে লাগানোর জন্য সংগঠনের গুরুত্বের কথা বলেছিলেন তিনি। এবং সাবধান করেও দিয়েছিলেন যে, এ-যাবৎ সংগঠনকে একচেটিয়া দখলে রেখেছে ‘চতুর ও লোভী’ লোকেরাই, তাই দেখতে হবে প্রতিবাদী সংগঠন যেন ‘সঙ্কীর্ণ স্বার্থচক্র’ না-হয়ে ওঠে। সেবা দলের স্বেচ্ছাব্রতী তরুণ সমাজ তাঁকে ভরসা দিয়েছিল, তিনি লিখেছিলেন, ‘‘রাষ্ট্র সেনাবাহিনী সংগঠন করে ক্ষমতা বজায় রাখতে বা সমান সংগঠিত অন্য শক্তিকে প্রতিরোধের জন্য, (কিন্তু) এই ছেলেরা স্ব-ইচ্ছায় অ-সহায় মানুষের বাহিনী হিসেবে সংগঠিত হচ্ছে অত্যাচারী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই করতে, বিত্তের শক্তি ধ্বংস করতে।’’
সেবা দল সুদূর অতীত, কিন্তু প্রতিবাদী তরুণ সমাজ আজও ভরসা দেয়। রাষ্ট্রক্ষমতার প্রতিস্পর্ধী সংগঠন গড়ে তোলার পথও এই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই খুঁজতে হবে আমাদের। নতুন থেকে ক্রমাগত নতুনতর পথ। এই অন্বেষায় থেমে থাকা চলবে না। কোন খেলা যে খেলব কখন, সেই ভাবনার কোনও বিরাম নেই।