আন্দোলনের জন্য জমায়েত। নিজস্ব চিত্র
নয়া নাগরিকত্ব আইন নিয়ে হইচই ছিলই। মানতে পারা ও না পারা নিয়েও ছিল সংশয়। কিন্তু সঙ্কট যে এমন আকার নেবে তা কে জানত! দেখতে দেখতে এক অলিখিত বন্্ধের চেহারা নিয়েছে জেলা, শহর। অতর্কিত ও ঝোড়ো গতিতে আছড়ে পড়েছে আন্দোলন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মানুষ বেসামাল ও নাজেহাল। মাঝপথে বাস ও ট্রেনে আটকে পড়ার হয়রানি। ভয়ে বহু মানুষ একরকম অসহায় ও গৃহবন্দি। ভয়ের কারণ আন্দোলনকারীদের একাংশের হিংসাত্মক কাজ।
দিশেহারা মানুষ জীবনের সন্ধানেই আজ রাস্তায়। তাঁদের কাছে অভিযোগ জানানোর ভাষা নেই। প্রতিবাদের কোনও উপায় জানা নেই। আছে শুধু বুক ভরা অভিমান। আর ভিটে ও দেশ হারানোর আশঙ্কা। এই কষ্ট ও যন্ত্রণার কোনও পরিভাষা এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের জানা নেই। তাঁদের কাছে এই কষ্টের অনুভব একদম নতুন। তাই তাঁদের প্রতিক্রিয়াও হয়তো একটু ভিন্ন। তা ছাড়া যে কিশোর ও যুবারা আন্দোলনের মুখ হয়ে উঠেছেন তাঁদের কাছে সাহস ছাড়া কিচ্ছু নেই। নিজেদের হারানোর মতো জীবিকা ও বিলাসবহুল জীবনও নেই। নেই উজ্জ্বল কেরিয়ার। দেশ ও সমাজ নিয়ে তেমন বোধও হয়তো নেই। রাষ্ট্র তাঁদের সব কেড়ে নিচ্ছে, এই আবেগেই তাঁরা গা ভাসিয়ে দিয়েছেন। সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করে তাঁরা নিজেদের সম্ভাব্য যন্ত্রণা ভুলতে চাইছেন। ওঁদের ক্ষমা করে পথ দেখানোর দায় সকলের।
ধ্বংসলীলা কখনও সভ্যতার শুভ কাজে সংগঠিত হয় না। এ ভাবে নিজের অধিকারও সুনিশ্চিতও করা যায় না। জ্বালিয়ে, পুড়িয়ে নিজেদের নিঃশেষ করে দেওয়ার মধ্যে বিকার আছে, বাস্তব নেই। এই উন্মাদনায় স্বয়ং সরকার আক্রান্ত। নইলে এই আইনের কোনও প্রাসঙ্গিকতা এই মুহূর্তে নেই। তা ছাড়া এর আগেও নাগরিকত্ব বিল সংশোধন হয়েছে। এমন অবিশ্বাসের সুনামি আসেনি কখনও। মূল কথা হচ্ছে এটাই যে, সরকার ও দেশের একাংশের মানুষের মধ্যে বিশ্বাসের সুতোটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। তাই প্রতিরোধের আগুনে সব পুড়ছে। গুলিয়ে যাচ্ছে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের ফারাক।
প্রতিবাদ চলুক। তার একটা বার্তা থাকুক। উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যও নির্দিষ্ট থাকুক। কিন্তু অগণতান্ত্রিকতাকে কখনও নৈরাজ্য দিয়ে জয় করা যায় না। সংবিধানকে ভালবাসলে তাকে উপযুক্ত মর্যাদা দিয়ে এগোনো দরকার। দেশের প্রতি সম্মানবোধ থাকলে দেশের সরকারি সম্পত্তি রক্ষার প্রতি দায়কেও মেনে চলা জরুরি। অপমান ও বঞ্চনা মানুষকে শক্তিশালী করে। আরও ঐক্যবদ্ধ করে। এই একতার স্বার্থেই তো দেশে থাকার প্রয়াস। দেশকে বাঁচাতে হলে দেশের সম্পত্তিকে নষ্ট করার মতো অন্যায় কাজকে রুখে দেওয়ার সাহস প্রয়োজন। সঙ্কট ও বিপন্নতা মানুষকে ভুল পথে চালনা করে। তাই যাঁরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁদের অনেক বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে। নইলে বিপক্ষের হাতেই অস্ত্র তুলে দেওয়া হবে। মানুষের মধ্যে বৈষম্যের বীজ বপনের ষড়যন্ত্রকারীরাই
জয়ী হবে।
এই দেশ এমন হাজারও বাধা পেরিয়ে এসেছে। ব্রিটিশদের মতো শক্তিশালী ও রাজনৈতিক কৌশলে ভরপুর শাসকদের হাত থেকে এই দেশ স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিয়েছে। কিন্তু বশ্যতা স্বীকার করনি। লাগাতার আন্দোলন চলেছে। কিন্তু মনোবল কিছুতেই মুখ থুবড়ে পড়েনি। মুঘল যুগেও রাজপুতদের ঐক্য ও দেশরক্ষার সংকল্পের সামনে ঝুঁকেছিল দোর্দণ্ডপ্রতাপ শাসকেরা। এই দেশ এক অনন্য লড়াইয়ের ঐতিহ্যের দলিল। হাজারও টানাপড়েনে নিজেদের দেশের ঐক্যকে ঝুঁকতে দেয়নি ভারতীয়রা।
আজকের এই নয়া নাগরিকত্ব আইনের নামে বিভেদও অবশেষে যেন প্রহসনে পরিণত হয়। ইতিহাস যেন অবাক হয়ে পিছনে তাকিয়ে স্মরণ করে দেশের মানুষের এই আন্দোলনের মুহূর্ত। এমন উচ্চতায় প্রতিবাদের সুর বাঁধা জরুরি। পুলিশ চিরকাল রাষ্ট্রের হাতিয়ার। এদের অত্যাচারে সংযম হারানো নয়, মনকে আরও শক্ত করা দরকার। দেশ সরকার, পুলিশ বা রাষ্ট্রের নয়। দেশ আপামর জনগণের। তা ছাড়া এক দায়িত্বশীল নাগরিকের এটা বোঝা জরুরি যে, জনগণের অনুপাতে পুলিশের সংখ্যা কম। তাই ব্যাপক ভাবে এলোপাথাড়ি প্রতিরোধ গড়ে তুললে দেশবাসীর প্রতি অবিচার হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে। আন্দোলনও দুর্বল হয়ে পড়বে। সেরা সাম্রাজ্যবাদী কার্জনের পরিকল্পনাকে ফিরিয়েছিল বাংলা। গোলা-বারুদ কিছুই আটকাতে পারেনি দেশপ্রেমের শক্তিকে। ঐক্য ও সম্প্রীতির সামনে চিরকাল স্বৈরাচারকে হার মানতে হয়েছে। নিরস্ত্র দেশপ্রেম পরাস্ত করেছে আগ্নেয়াস্ত্রের জোরকে। দেশের ইতিহাসের পাতায় লেখা সেই কাহিনী কেউ ছিঁড়ে ফেলতে পারেনি। মিটিয়েও দিতে পারেনি। এমন এক গর্বিত দেশের মানুষের হিংসা কখনও অস্ত্র হতে পারে না।
ভুল হয়ে যেতে পারে। অন্যায়ও হতে পারে না বুঝে। কিন্তু আখেরে সেই ভুল সংশোধন করে পথ বদলে নিতে সময় লাগার কথা নয়। কখনও কোনও আদর্শ নাগরিক দেশের সম্মান ও শৃঙ্খল ভেঙে শত্রুর ভূমিকায় নামতে পারে না। দেশের প্রতি ভালবাসা আছে বলেই তো দেশে থাকার মিনতি। সরকারের কাছে আবেদন, অধিকার যেন কেড়ে না নেয়। ভিটে যেন অক্ষত থাকে। পরিবারের সবাই যেন এক ছাদের তলায় থাকতে পারে। এই আবেদন সবাইকে একসঙ্গে করতে হবে। আবেদনে সরকার সাড়া না দিলে অনুরোধ জানাতে হবে। নিয়ম ভেঙে নিয়ম কিছুক্ষণের জন্য প্রতিষ্ঠা কখনও হয়তো হয় কিন্তু সত্য প্রতিষ্ঠা হয় না।
এই মুহূর্তে সত্য এই যে, আমরা ভারতীয়রা এক সঙ্গে থাকতে চাই। এই দেশের মাটিতেই মরতে চাই। আমাদের দেহ আমার পড়শি কবরে বা শশ্মানে নিয়ে যাবে, সেটাই চাই। এটাই আমাদের জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত। সেই সত্য ও সুন্দর ইচ্ছে একটুকরো কাগজ যেন ছিনিয়ে না নেয়। এই বাসনা লালন করেও হয়তো কিছু লোক ভুল করে ফেলেছে। ভিড়ের মাঝে প্ররোচনার ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছে। তাই আন্দোলনে মিশে গিয়েছে অন্য বিষ। সেই গরল তুলে ফেলে অমৃতটুকুকেই সম্পদ করে এগোনোর পালা। এই দেশের মাটি ও মাথার ছাদ যেন সব ভারতীয়ের হয়।
সৃষ্টিকর্তাও নাকি মানুষের অন্তিম ইচ্ছের মূল্য দেয়। তবে কি শাসক ইচ্ছের কোনও মূল্য না দিয়ে ফিরিয়ে দেবে আমাদের? আশায় বুক বাঁধতে ইচ্ছে হয়। শান্তির এই আহ্বান আজ ইমাম-মোয়াজ্জিন থেকে সব ধর্মের মানুষের। সহনাগরিকের পারস্পরিক ভালবাসা ও প্রেমের বন্ধনে শাসকের করুণা বর্ষিত হোক। শাসক এক বার সুশাসক হয়ে বিশ্বধর্ম তুলে নিক হাতে। আন্দোলনের শক্তি যেন তাদের মন জয় করতে সমর্থ হয়। ততদিন প্রতিবাদের ভাষা থাক সংযত ও গঠনমূলক। দেশভাগের যন্ত্রণা মানুষ সহন করেছে। এ বার মানুষে মানুষে ভাগাভাগির অভিশাপ থেকে মুক্তির প্রার্থনায় সব ভারতীয়ের একাত্মবোধকে সম্মান করুক শাসক। আন্দোলনের এটাই একমাত্র লক্ষ্য। সাংবিধানিক ভাবে এর চেয়ে বড় উদ্দেশ্য অন্য কিছুই নেই। প্রতিহিংসার হাতিয়ার বড্ড ক্ষণস্থায়ী। এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধও। সেই বিপদে জড়ালে আন্দোলনের হাত ধরার মানুষ কমবে। জনশূন্য পথে হাজার কেঁদে ফিরলেও নাগরিকত্বের অধিকার মিলবে না। তাই সময় নষ্ট না করে গঠনমূলক পথে পা বাড়াতে হবে। নইলে নিজেদের ক্ষমা করা কঠিন হয়ে পড়বে।
মনে রাখতে হবে, এই মুহূর্তে দেশে বিপ্লব নয়, নিজেদের অধিকার সুরক্ষিত করা জরুরি। সেই সংস্কারের অভিমুখ খুঁজে বের করাই মূল কথা। ধর্মীয় মেরুকরণের বিরুদ্ধে লড়াই বড় কঠিন। সেই পথে নামার জন্য অফুরান মনোবল ও সত্যের সাধনা দরকার। দরকার হিংসাবর্জিত পথ। সেই পথে হাঁটার সাহস না থাকলে আন্দোলন এক পা-ও এগোতে পারবে না। বিজয়ের বিজ্ঞাপনে আহ্লাদিত ভীতিপ্রদর্শনকারীরা আরও সাহস নিয়ে দেশ ভাঙতে এগোবে।
লেখক শিক্ষিকা, মতামত নিজস্ব