কেন্দ্রীয় সরকারের সংখ্যালঘু অবস্থানটি ইতিমধ্যে বেশ পরিষ্কার। অথচ রকমসকম দেখিয়া বোধ হয়, সরকারের ধারণা, এখনও নানা ওজর-অজুহাত ভানভণিতার বেশ গ্রহণযোগ্যতা আছে, সেগুলি তাঁহারা চালাইয়া যাইতে পারেন। কিছু দিন আগে রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার সভায় (ইউ এন হিউম্যান রাইটস কাউন্সিল) ভারতীয় রাষ্ট্রের গৌরবোজ্জ্বল ধর্মনিরপেক্ষতা বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মুকুল রোহতগি যে কথাগুলি বলিয়া আসিলেন, আন্তর্জাতিক মঞ্চেও তাহা খুব সহৃদয় শ্রোতৃমণ্ডলী পাইল না। গত কয়েক বৎসর ধরিয়া এ দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর বিভিন্ন রকম সামাজিক-সাংস্কৃতিক নিয়ন্ত্রণ কায়েম করিবার যে প্রয়াস দেখা গিয়াছে, তাহা ইতিমধ্যেই যথেষ্ট প্রচারিত সংবাদ। সুতরাং ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার মুখটি যদি আবার তুলিয়া ধরিতেই হয়, সে ক্ষেত্রে ফাঁপা বুলি আউড়াইবার অপেক্ষা কিছু স্পষ্ট উদাহরণ দিলে ভাল হয়। যেমন, কেন্দ্রীয় সরকার কোন কোন উপায়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের হিতসাধনের ব্যবস্থা করিতেছে, কিংবা তাহাদের অধিকারের সুরক্ষার কথা ভাবিতেছে। তেমন কিছু যে এজি বলিতে পারেন নাই, তাহার সহজ কারণ, তেমন কিছু বলিবার নাই। ঠিক এইখানেই ভারতের গৌরবমণ্ডিত ধর্মনিরপেক্ষতার ঐতিহ্যটি বিপন্ন বর্তমানের সহিত যুঝিতেছে। একটি উদাহরণেই তাহা পরিষ্কার হইবে।
অতি সম্প্রতি সরকারি ঘোষণা: যে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংখ্যালঘু প্রতিষ্ঠান হিসাবে স্বীকৃতি পাইতে চায়, তাহাদের আগে নীতি আয়োগের কাছে গিয়া নিজেদের নথিভুক্ত করাইতে হইবে, আধার কার্ড-সহ আবেদন করিতে হইবে। নীতি আয়োগের সমর্থন ভিন্ন ‘সংখ্যালঘু’ সার্টিফিকেট পাওয়া যাইবে না। যে সব প্রতিষ্ঠান সরকারি অর্থের মুখাপেক্ষী নহে, তাহাদের জন্য একই বিধান। ন্যাশনাল কমিশন ফর মাইনরিটি এডুকেশন ইনস্টিটিউশনস এই নীতি ধার্য করিয়াছে। প্রসঙ্গত এই কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারপার্সনও এই সিদ্ধান্তে হতবাক, কেননা সাংবিধানিক ধারা অনুযায়ী এই ভাবে নাম লিখাইয়া সংখ্যালঘু প্রতিষ্ঠান হইবার রীতি এত দিন পর্যন্ত এই দেশে ছিল না, এখনও থাকিবার কথা নহে। সংবিধানের ৩০ নম্বর ধারা অনুযায়ী, ভাষা বা ধর্ম, যে কোনও ভিত্তিতে নির্ধারিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় তাহাদের শিক্ষা-সংস্কৃতির পোষণ ও প্রসার করিবার অধিকারী, তাহাদের নিজস্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরির অধিকারও আছে। সরকার সেই প্রতিষ্ঠানের খোঁজখবর রাখিতেই পারে, সেখানে কী ধরনের শিক্ষাদান চলিতেছে, এই লইয়া মাথাও ঘামাইতে পারে। কিন্তু সরকারি সিলমোহর ছাড়া এমন প্রতিষ্ঠান অস্তিত্বশীল হইতে পারিবে না, এমন শর্ত অভূতপূর্ব।
যাহা সংবিধানসম্মত নয়, এমন একটি কাজ সরকার করিতে চলিয়াছে কী করিয়া? এক, সংখ্যালঘু শিক্ষা-সংস্কৃতির হাল লইয়া উদ্বিগ্ন সরকার তাহাদের উন্নতিকল্পেই প্রতিষ্ঠানের হিসাব চাইতে পারে। আবার, সংখ্যালঘু কার্যক্রমের উপর ‘নজর’ রাখিতেও রেজিস্ট্রেশনের ব্যবস্থা করিতে পারে। বিচারব্যবস্থায় ‘পারিপার্শ্বিক তথ্যপ্রমাণ’ বলিয়া একটি কথা আছে। তাই এমন ভাবা অসঙ্গত হইবে না যে বিজেপি রাষ্ট্রের সাম্প্রতিক প্রয়োজন এই দ্বিতীয় কাজটিই। বিশেষ করিয়া সরকারি অর্থ-নিরপেক্ষ ভাবে যাঁহারা শিক্ষাপ্রসারের কাজ করিয়া থাকেন, তাঁহাদের নজরের আওতায় আনা তো আরওই প্রয়োজন। সব মিলাইয়া বর্তমান সরকারের ‘ওয়াচডগ’ সত্তা বলিতেছে, সংখ্যালঘু প্রতিষ্ঠানগুলিকে অসম্মানের দিকে ঠেলিয়া দিতে বাধা নাই। দীর্ঘপ্রচলিত কার্যবিধি কিংবা সংবিধানের ধারা, সবই তুচ্ছ করিয়া যখন সংখ্যালঘু-নজরদারির চেষ্টা এতটাই তুঙ্গে, তখন দেশেবিদেশে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থার বড়াই হাস্য-উদ্রেককারী নয় কি?