লকডাউন চলাকালীন নয়াদিল্লি থেকে পায়ে হেঁটে গ্রামে ফিরছেন শ্রমিকেরা। ফাইল চিত্র
‘লকডাউন’-এর যাঁতাকলে পড়ে এক বড় অংশের শ্রমজীবী মানুষ আজ সঙ্কটাপন্ন। সাধারণ ভাবে দেশের মোট শ্রমজীবীর ৯৬ শতাংশ মানুষ, যাঁরা অসংগঠিত ক্ষেত্রে যুক্ত, এক দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। এঁদের মধ্যে আবার যাঁরা পরিযায়ী শ্রমিক, তাঁদের অবস্থা আরও সঙ্গীন। এঁদের বাঁচাতে আশু পদক্ষেপ প্রয়োজন।
ইতিহাসে সম্ভবত এই প্রথম মে দিবস পালিত হতে চলেছে, যেখানে শ্রমিক ভাইয়েরা থাকবেন গৃহবন্দি। ১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে হয় সেই ঐতিহাসিক লড়াই। শ্রমিকদের উপরে মালিক শ্রেণির নির্বিচারে গুলি চালনা ও ফলশ্রুতিতে শ্রমিকের রক্তে ভেজা পোশাক থেকেই রক্তপতাকার সূত্রপাত। শ্রমিকদের আত্মত্যাগে আট ঘণ্টা কাজের সেই দাবি স্বীকৃতি পায়। দেশে দেশে ১মে দিনটি শ্রমিক শ্রেণির সংহতি দিবস হিসেবে পালিত হতে থাকে। ভারতে ১৯২৩-এ প্রথম মাদ্রাজ শহরে মে দিবস পালিত হয়। সেই শুরু। তার পরে ফি বছর গোটা দেশেই দিনটি শ্রমিকদের বিজয় দিবস হিসেবেই পালিত হয়ে আসছে।
তবে এ বছরে চিত্রটা ভিন্ন। করোনা নামক অদৃশ্য শত্রুর কাছে পৃথিবীর প্রায় ২১০টি দেশের কোটি কোটি মানুষ কার্যত অসহায়। একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, অর্থনীতিতে উন্নত দেশগুলিতে চলছে মৃত্যুর মিছিল। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা অজানা এই ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে সকলকে গৃহবন্দি থাকার পরামর্শ দিয়েছে। কিছু স্বাস্থ্যবিধি, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সব কাজকর্ম বন্ধ করে দেশে দেশে চলছে ‘লকডাউন’।
আমাদের দেশেও গত ২৪ মার্চ থেকে ‘লকডাউন’ শুরু হয়েছে। জাতীয় মহামারি রোধে ব্রিটিশ সরকারের ১৮৯৭ সালের আইনে কিছু সংশোধন এনে ‘অর্ডিন্যান্স’ও জারি করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণামতো সমস্ত রাজ্যগুলির সীমানা বন্ধ করা হয়েছে। সমস্ত ধরনের যাত্রী পরিবহণ বন্ধ। শুধু অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের পরিবহণ চালু রয়েছে।
এ দিকে ‘লকডাউন’-এর যাঁতাকলে পড়ে এক বড় অংশের শ্রমজীবী মানুষ আজ সঙ্কটাপন্ন। সাধারণ ভাবে দেশের মোট শ্রমজীবীর ৯৬ শতাংশ মানুষ, যাঁরা অসংগঠিত ক্ষেত্রে যুক্ত, দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে রয়েছেন। এঁদের মধ্যে আবার যাঁরা পরিযায়ী শ্রমিক, তাঁদের অবস্থা আরও সঙ্গীন। গ্রাম থেকে শহরে, এক জেলা থেকে অন্য জেলায়, ভিন্ রাজ্যে এমনকি বাইরের দেশেও কাজ করতে যাওয়া এই সব পরিযায়ী শ্রমিকেরা মূলত অদক্ষ ও স্বল্প-দক্ষ শ্রমিক। দেশের অভ্যন্তরে শ্রমের এই গতিশীলতা দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যায় ও সচল রাখে। এই অসংগঠিত শ্রমজীবীরাই মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ৬০ শতাংশের কারিগর।
অথচ এই শ্রমিকেরাই আজ ঠাঁইহারা। সীমিত সময়ের নোটিসে ‘লকডাউন’ শুরু হওয়ায় বেশির ভাগই বাড়ি ফিরতে পারেননি। বিদেশ-বিভুঁইয়ে কোনও দিন দু’মুঠো জুটছে, কোনও দিন তা-ও নয়। হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিক, পুরুষ-মহিলা বাচ্চা কাঁধে ব্যাগ নিয়ে হেঁটে চলেছেন। কখনও বিভ্রান্ত হয়ে দিল্লির বাসস্ট্যান্ড আবার কখনও মুম্বইয়ের বান্দ্রা রেলস্টেশনে কাতারে কাতারে শ্রমিকেরা জড়ো হচ্ছেন। সকলের একটাই দাবি, যেন অবিলম্বে বাড়ি ফেরানোর ব্যবস্থা করা হয়। তবে সুরাহা তো হচ্ছেই না, বদলে জুটছে পুলিশের লাঠি।
মূলত পূর্ব ও উত্তর ভারত থেকেই ফি বছর কয়েক লক্ষ শ্রমজীবী মানুষ ভিটেমাটি ছেড়ে দক্ষিণ, পশ্চিম ভারত, দিল্লি, হরিয়ানায় যান। দেশের উন্নয়নের লক্ষ্যে পরিকাঠামো নির্মাণ শিল্প, ছোট ছোট শিল্প কারখানা, পরিবহণ-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এঁদের বিষয়ে বিন্দুমাত্র পরিকল্পনা ছাড়া ‘লকডাউন’ ঘোষণার ফলে পরিযায়ী শ্রমিকদের এই দুর্দশা। এমনকি, বিভিন্ন রাজ্যে কত সংখ্যায় পরিযায়ী শ্রমিক কাজ করেন, তারও কোনও তথ্য কেন্দ্রীয় সরকার বা সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারের কাছে নেই।
বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে জানা যায়, প্রায় এক কোটি পরিযায়ী শ্রমিক আন্তঃজেলা, রাজ্য ও বিদেশে যুক্ত আছেন। ইতিমধ্যে তাঁদের একটি অংশ বাড়ি ফেরার পথে বিভিন্ন রাজ্যে ক্যাম্পে আছেন। হাঁটতে হাঁটতে পথেই কেউ কেউ প্রাণ হারিয়েছেন। ‘দ্য হিন্দু’ পত্রিকার তরফে ১১১৫৯ জন পরিযায়ী শ্রমিকের উপরে করা একটি সমীক্ষা থেকে চিন্তাজনক ছবি উঠে এসেছে। গত ৪-১৩ এপ্রিলে করা ওই সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ৯৬ শতাংশ শ্রমিক কোনও রেশন পাননি এবং ৯০ শতাংশ ‘লকডাউন’ চলাকালীন কোনও মজুরিও পাননি। ৬২ শতাংশ শ্রমিক জানেনই না যে তাঁদের জন্য সরকারি ভাবে কোনও কর্মসূচি ঘোষিত হয়েছে। আরও চিন্তার, উক্ত শ্রমিকদের ৭০ শতাংশের কাছে মাত্র ২০০ টাকার মতো অবশিষ্ট আছে। সরকারি ও বিভিন্ন সংস্থার তরফে খাবার দেওয়া হলেও তা পর্যাপ্ত নয়। সমীক্ষায় এও দেখা গিয়েছে, উত্তরপ্রদেশের পরিযায়ী শ্রমিকেরাই সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছেন।
ঐতিহাসিক ভাবেই তফসিলি জাতি ও জনজাতিভুক্ত মানুষদের যাঁরা এই পরিযায়ী শ্রমিক, তাঁরা দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করলেও প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। কারণ, এই সব সুবিধাগুলি তাঁদের স্থায়ী বসবাসের জায়গাতেই দেওয়া হয়। বছরের বেশির ভাগ সময়ে বাড়ির বাইরে থাকায় তাঁরা তা পান না। পাশাপাশি, ভোটের সময়েও প্রায়শই হাজির থাকতে না পারায় বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলগুলিরও এঁদের প্রতি বিশেষ সহমর্মিতা থাকে না। এমনকি, এই সব পরিযায়ী শ্রমিকেরা ট্রেড ইউনিয়নের সঙ্গেও যুক্ত হতে পারেন না। এর অন্যতম কারণ, এঁরা বিভিন্ন ঠিকাদারদের মাধ্যমে অন্যত্র কাজে যুক্ত হন। তাই সব সময়েই কাজ চলে যাওয়ার একটি আশঙ্কা এঁদের মধ্যে কাজ করে। অনিশ্চয়তা পরিযায়ী শ্রমিকদের জীবনচর্চার অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে তা আরও বেড়েছে।
আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থা, রাষ্ট্রপুঞ্জ ভারতের পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশা দূর করতে সরকারি হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছে। সুপ্রিম কোর্টেও এঁদের দুরবস্থা নিয়ে মামলা দায়ের হয়েছে। অন্য দিকে, বেকারত্বের হারও ৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৫ শতাংশ ছুঁয়েছে। আনুমানিক আড়াই কোটি শ্রমিক কর্মচ্যুত হয়েছেন এবং প্রতি দিন হচ্ছেন। তবে আশার কথা, গত ২৭ এপ্রিল বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী পরিযায়ী শ্রমিকদের সমস্যার বিষয়ে রাজ্য সরকারগুলিকে নজর দিতে বলেছেন।
এই পরিস্থিতিতে অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের বাঁচাতে সরকারি পদক্ষেপ জোরদার হওয়া প্রয়োজন। সর্বজনীন রেশন ব্যবস্থার পাশাপাশি শ্রমিকদের আর্থিক সাহায্য প্রদান দেশকে পুনরায় অগ্রগতির পথে নিয়ে যাবে। মে দিবসে এটাই হোক সরকারের তরফে পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য উপহার।
লেখক বাঁকুড়া খ্রিস্টান কলেজের শিক্ষক