ইংরেজি শব্দ ‘এনভায়রনমেন্ট’। উনিশ শতকের আগে এর ব্যবহার বিরল। বিশ শতকেও বহু দিন অবধি অর্থ ছিল চারপাশ, পরিমণ্ডল, ইত্যাদি। ষাটের দশকে, দূষণের প্রশ্ন ক্রমশ সামনে এল, ‘এনভায়রনমেন্ট’ শব্দে বাড়তি অর্থের সংযোজন হল: মানুষের কর্মকাণ্ডে সংকটাপন্ন প্রাকৃতিক পরিমণ্ডল এবং সম্পদ। কবে যেন ইংরেজি ‘এনভায়রনমেন্ট’-এর বাংলা হয়ে গিয়েছে ‘পরিবেশ’। এখানেও দু’রকম অর্থ। প্রথমটি নিরীহ; দ্বিতীয়টিতে সমস্যা-সংকটের ব্যঞ্জনা।
পরিবেশ সংকটের কারণগুলি দূর করতে গেলে, বহু ধরনের মুনাফা-রোজগার বিপন্ন হবে, অনেকের জীবন দুর্বিষহ হবে। শ্যাম ও কুল দুই-ই রাখার (অর্থাৎ, উৎপাদন-আয়ের কাঠামোকে বিপন্ন না করে ক্ষতির বাড়াবাড়ি কমানোর) লক্ষ্যে দেশে দেশে প্রণীত হল পরিবেশ বিধি, তৈরি হল পরিবেশ দফতর, গড়ে উঠল পরিবেশ বিশেষজ্ঞ বাহিনী। ১৯৯০-এর দশকে সরকারি ভাবে শুরু হল পরিবেশের অবস্থা সংক্রান্ত প্রতিবেদন রচনা। নিন্দুকেরা অবশ্য বাঁকা হাসলেন। বললেন, পরিবেশ সমস্যার সত্যিকারের সমাধান করতে গেলে যা যা করা দরকার, তা এত ধরনের স্বার্থ ও নিষ্ক্রিয়তার অভ্যাসে আঘাত করবে যে সে সব করা যাবে না। খুব বেশি হলে কিছু ভাল প্রতিবেদন লেখা হবে আর এখানে সেখানে কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ!
পশ্চিমবঙ্গে সরকারি উদ্যোগে রাজ্যের পরিবেশের হাল সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯৯ সালে। পুনর্মুদ্রিত হয় ২০০১-এ। খুব কম লোকই সেই প্রতিবেদন স্বচক্ষে দেখেছেন। তার পর অনেক দিন সরকারি ভাবে এ রকম চেষ্টা হয়নি। কিছু দিন হল পশ্চিমবঙ্গের দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন: পশ্চিমবঙ্গের স্টেট অব দি এনভায়রনমেন্ট রিপোর্ট ২০১৬। ‘নন-প্রাইস্ড’ সংস্করণ। কিনতে পাবেন না। পর্ষদ কর্তৃক পাওয়ার যোগ্য বিবেচিত হলে নিখরচায় পাবেন। তবে পর্ষদ নিজেদের ওয়েবসাইটে ‘সফ্ট কপি’ রেখে প্রতিবেদনটি কিছুটা সহজলভ্য করেছেন।
পশ্চিমবঙ্গের প্রকৃতি-পরিবেশ সম্পর্কে এই প্রতিবেদনে প্রচুর সচিত্র (ও স-মানচিত্র) তথ্য এবং মনোজ্ঞ বিশ্লেষণ রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের নৈসর্গিক পটভূমি, রাজ্যের জনসংখ্যা সংক্রান্ত তথ্যের নানান দিক, ‘ভূমি ও ভূমি ব্যবহার’ এবং ‘মাটি’ সম্পর্কে আলোচনাগুলি শিক্ষাপ্রদ।
সবুজ বিপ্লবের নামে ‘উচ্চফলনশীল’ সংকর বীজ, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করে দেশের মাটি-জল-জৈববৈচিত্রের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, তা আজও জারি আছে। তার কুফলের ঠেলায় বেশ কিছু দিন ধরে সরকারও জৈব চাষ পদ্ধতির কথা বলতে শুরু করেছেন। কৃষি-সংক্রান্ত অধ্যায়ে জৈব ও সুস্থায়ী কৃষির বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গেই স্থান পেয়েছে। তবে এ সব ক্ষেত্রে সরকারি ভাবে ঠিক কী কী পদক্ষেপ করা হচ্ছে তার উল্লেখ নেই। বেশি কিছু করা হচ্ছে না বলেই কি?
পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে জলবায়ু সমস্যা ও তার মোকাবিলার সম্ভাব্য পদক্ষেপগুলি নির্দিষ্ট অধ্যায়ে বিশদ আলোচিত হয়েছে। অন্যান্য অধ্যায়ে এসেছে— বন ও বন্যপ্রাণ, জৈববৈচিত্র, জলসম্পদ, ভৌম জল, জলাভূমি, খনিজ সম্পদ, শিল্পজ দূষণ ব্যবস্থাপনা, বায়ুর গুণমান, কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, জৈব ও চিকিৎসাজাত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য, পৌর বর্জ্য জল ব্যবস্থাপনা, পরিবেশের নিয়মকানুন। অনেকগুলি রচনাই উৎকৃষ্ট। কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় এ রাজ্যের অধিকাংশ পৌরসভার নিষ্ক্রিয়তা সম্পর্কে প্রভূত তথ্য নির্দিষ্ট অধ্যায়ে আছে। জলসম্পদ ও ভৌম জল বিষয়ক রচনাগুলিও ভাল। বায়ুর গুণমান সংক্রান্ত অধ্যায়টিতে রাজ্যের বায়ুদূষণের (বিশেষত প্রশ্বাসযোগ্য ভাসমান ধূলিকণার) যে চিত্রটি পাওয়া যায় তা অতীব উদ্বেগজনক। প্রাসঙ্গিক সুপারিশের একটা তালিকাও আছে। কিন্তু সুপারিশগুলি বাস্তবায়নের সম্ভাবনা সম্পর্কে তথ্য অনুপস্থিত। জৈববৈচিত্র সংক্রান্ত অধ্যায়টি বিশেষ নজর কাড়ে। শুধু রাজ্যের প্রাণসম্ভারের আখ্যান নয়, প্রাণীর আবাস বিপর্যস্ত হওয়ার দরুন প্রাণীর অস্তিত্বসংকটের নানা উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। এসেছে আক্রান্ত জলাভূমি ও জলাভূমিবাসী প্রাণীর বিপন্নতার প্রসঙ্গ। জীবাণুসম্ভার ও তৎসংক্রান্ত গবেষণার প্রসঙ্গও। জেনে দুঃখ হয়, আমরা আঞ্চলিক জীবাণু সম্পর্কে গবেষণায় বেশ পিছিয়ে।
কিন্তু শিল্পজ দূষণ ব্যবস্থাপনার অধ্যায়টি পড়তে গিয়ে মনে হয়, দূষণ সমস্যার আলোচনার চেয়েও এই রচনার ঝোঁক দূষণ সমস্যার ব্যবস্থাপনায় পর্ষদের সাফল্যের বিবরণ দেওয়ায়। যে রাজ্যে পাথর-পেষাই কলের বহু শ্রমিক সিলিকোসিসের নরকযন্ত্রণায় ভুগে মরেন, সে রাজ্যের পরিবেশ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে এ বিষয়ে পর্যাপ্ত তথ্য এবং এই সমস্যার সমাধান বিষয়ে কী করা হচ্ছে তার বিস্তারিত আলোচনা জরুরি ছিল। খনিজ সম্পদ সম্পর্কে অধ্যায়ে এ সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত উল্লেখ ছাড়া কোথাও কিছু পাওয়া গেল না।
বাদ গিয়েছে বনাঞ্চলের বাইরে বৃক্ষসম্পদের প্রশ্ন। উন্নয়নের অছিলায় বাকি দেশের মতো এই রাজ্যেও চলে নির্বিচার গাছ-হত্যা। বনাঞ্চল-বহির্ভূত বৃক্ষ সংরক্ষণের আইনটি রোজ লঙ্ঘিত হয়। অন্য দিকে, গাছ লাগানো হয় অনেক— কিছু বাঁচেও। নিধন-রোপণের অবিরাম যোগবিয়োগের মোট ফল কী? গত দেড়-দুই দশকে বনাঞ্চলের বাইরে রাজ্যের বৃক্ষ আচ্ছাদনের হাল তাতে কী দাঁড়াল? কোনও আলোচনা নেই।
এর চেয়েও আশ্চর্য ঘাটতি, পশ্চিমবঙ্গের উপকূলীয় পরিবেশ নিয়ে স্বতন্ত্র অধ্যায় না থাকা। একটি উপকূলীয় রাজ্যের পরিবেশ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে উপকূল একটা স্বতন্ত্র অধ্যায় পেল না, মন্দারমণিতে তট-ধ্বংসের উল্লেখ পর্যন্ত থাকল না!
তবে উপকূলীয় জলাভূমির বিষয়টি জলাভুমি বিষয়ক অধ্যায়ে খানিকটা যত্নে আলোচিত। পশ্চিমবঙ্গের নানা প্রকারের জলাভূমির এবং তাদের অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক গুরুত্বের চমৎকার আলোচনা রয়েছে। কিন্তু ব্যাপক জলাভূমি নিধনের বাস্তবতা যথেষ্ট স্বীকৃতি পায়নি। আর পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র রামসার-ক্ষেত্র পূর্ব কলকাতা জলাভূমি সম্পর্কে রয়েছে মাত্র একটি অনুচ্ছেদ। এই প্রায়-অনুল্লেখ উদ্বিগ্ন করে, কারণ সরকারি নিষ্ক্রিয়তা ও অনেক ক্ষেত্রে প্রায় প্রত্যক্ষ মদতে এখানে দুই দশক ধরে ভেড়ি বোজানো হচ্ছে। পরিবেশ আইনের মুখে ঝাড়ু মেরে পূর্ব কলকাতা জলাভূমির অন্তর্গত বানতলা অঞ্চলে চলছে মারাত্মক দূষণকারী প্লাস্টিক প্রক্রিয়াকরণ। অদূরেই ফুটছে ভয়াবহ দূষণকারী চামড়া সেদ্ধর হাঁড়ি। এ সবের বর্জ্যে জল-বায়ু-মাটি নিরন্তর দূষিত হচ্ছে। সবাই জানেন, রাজ্যের পরিবেশ-কর্তারা জানেন না? তাঁদের প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ সবের উল্লেখ থাকে না কেন? সত্যিই কিছু করা হবে না বলে? নিন্দুকরাই তা হলে ঠিক? পরিবেশবিদ্যা বা পরিবেশ আইন নয়, স্বার্থ-ক্ষমতার জটিল সমীকরণই শেষ কথা বলবে?