তুমিই জেরুজ়ালেমের মন্দির ধ্বংসের জন্য লোককে উস্কাচ্ছিলে?” প্রশ্ন করলেন বিচারপতি। হাত-বাঁধা আসামিটি বয়সে তরুণ, বছর ২৭ বয়স। পরনে নোংরা, উলোঝুলো পোশাক। মাথায় সাদা ফেট্টির ব্যান্ডেজ, বাঁ চোখের নীচে কালশিটে। ছোকরার নাম জেশুয়া। ঘরসংসার, বাড়িঘর কিছু নেই। কিন্তু ছোঁড়াটা তার বিরুদ্ধে-ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করছে, “না ক্ষমতাধিপ, আমি জীবনেও মন্দির ধ্বংসের কথা বলিনি। আমি শুধু বলেছিলাম, পুরনো বিশ্বাসের মন্দির ধসে পড়বে, তার উপর নতুন বিশ্বাসের, নতুন মন্দিরের ইমারত তৈরি হবে।” ভবঘুরেটা আরও জানাল, বেথলেহেম শহরে আসার পথে ম্যাথু নামে এক জন তার সঙ্গ নেয়। ম্যাথু আগে রাজস্ব সংগ্রহ করত, এই পাগলাটে ছোঁড়ার কথা শুনে টাকাপয়সা রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দেয়। এখন তার সঙ্গে থাকে। সে যা বলে, লিখে নেয়। এবং, ভুলভাল লেখে।
আদালতের সচিব আরও দলিল এনে হাজির করল। পাগলটা সাঙ্ঘাতিক। এ নাকি খোদ সম্রাট টাইবেরিয়াস সিজ়ারের বিরুদ্ধেও উস্কানি দিয়েছে।
“আমি বলেছিলাম, যে কোনও ক্ষমতাই আসলে এক ধরনের হিংসা। ভবিষ্যতে এক দিন সিজ়ার বা কারও শাসন থাকবে না। মানুষ সত্য আর ন্যায়ের রাজ্যে পৌঁছবে, সেখানে কোনও ক্ষমতা বা হিংসা নেই,” বলল ছেলেটা। “সিজ়ারের সমালোচনা! এ রকম সুষ্ঠু, ন্যায়পরায়ণ শাসন আগে কখনও ছিল না, ভবিষ্যতেও হবে না,” বলে উঠলেন বিচারক। ক্রুশবিদ্ধ হওযাই এর সাজা। মনে যদিও অস্বস্তি।
বিচারপতি এ বার জানলেন, শহরের প্রধান যাজক তাঁর অপেক্ষায়। জেশুয়া-সহ চার জনকে আজ ক্রুশে চড়ানোর হুকুম দেওয়া হয়েছে। সামনেই ইহুদি উৎসব। সেখানে মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত এক অপরাধীকে ছেড়ে দেওয়াই রীতি। প্রধান যাজক জানালেন, তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, জেশুয়া ক্রুশে যাবে। আর বার-রাব্বাকে ছেড়ে দিতে হবে। ডাকাত বার-রাব্বা, যে মন্দির ধ্বংস করতে চেয়েছিল। “আপনার কোনও ভুল হচ্ছে না তো যাজক? বরং জেশুয়াকে ছেড়ে দেওয়া যাক,” বললেন বিচারক পাইলেট।
যাজক হাসলেন, “জেশুয়াকে কেন ছেড়ে দিতে বলছেন, বুঝি না? আপনি জেরুজ়ালেমকে ঘেন্না করেন। ও ছোঁড়া সবাইকে উস্কে বিদ্রোহ করবে, তার পর এই নগরীকে আপনি রোমান সৈন্যের তরবারির মুখে ঠেলে দেবেন!” পাইলেটের কী আর করার আছে? যাজকের মতিগতি ভাল নয়। সিজ়ারের কাছে গিয়ে উল্টোপাল্টা সাতকাহন করবেন। ছেলেটা হয়তো নির্দোষ, কিন্তু এত ঝুঁকি নেওয়া যায়?
সমবেত জনতার সামনে পাইলেট ঘোষণা করলেন, বার-রাব্বাকে মুক্তি দেওয়া হবে। জনতা গর্জে উঠল, কুঁকড়ে গেল, আর্তনাদ করল, হো হো হেসে উঠল, সিটি বাজাল। এই শহর এ রকমই! ভক্ত ভুলভাল লেখে, বিচারপতিকে ভয়ার্ত মাথা ধরা নিয়ে যাজকের সঙ্গে দর কষাকষিতে বসতে হয়। জেশুয়া ক্রুশে আর বার-রাব্বা মুক্তি পায়।
প্রতিভা বা ‘মাস্টার’-এর পাণ্ডুলিপিতে এ রকমই ছিল। মাস্টার এক জন লেখক, জিশুখ্রিস্টের বিচারপতি পন্টিয়াস পাইলেটকে নিয়ে উপন্যাস লিখছিল। কিন্তু সম্পাদক, প্রকাশক ও সমালোচকরা সকলে দুচ্ছাই করে। হতাশ প্রতিভা শেষ অবধি পাণ্ডুলিপি আগুনে ছুড়ে ফেলে দেয়। কয়েক মাস পরে ওল্যান্ড সেই পাণ্ডুলিপি আগুনের ভিতর থেকে নিয়ে আসে, অক্ষত ও নিটোল। ওল্যান্ড আসলে রহস্যময় চরিত্র। ঈশ্বর কিংবা শয়তান। আগুনের ভিতর থেকে কী ভাবে উদ্ধার হয় নিটোল পাণ্ডুলিপি? ওল্যান্ড জানায়, “পাণ্ডুলিপিরা পোড়ে না। রাষ্ট্রীয় নির্দেশনামা, বিচারালয়ের হলফনামা, সম্পাদকের উপদেশনামা সব কিছু পুড়ে খাক হয়ে যেতে পারে, কিন্তু আপসহীন লেখকের পাণ্ডুলিপিরা চিরন্তন।”
এ রকমই ছিল রুশ লেখক মিখাইল বুলগাকভের উপন্যাস ‘দ্য মাস্টার অ্যান্ড মার্গারিটা’। লেখকের জীবদ্দশায়, স্ট্যালিনের সোভিয়েট রাশিয়ায় স্বাভাবিক ভাবেই এই উপন্যাস বেরোয়নি, তাঁর মৃত্যুর দু’দশক বাদে প্রকাশিত হয়। সোভিয়েট ব্যবস্থাকে ওল্যান্ড ও তার ছায়াহীন অনুচরেরা যে কত নাকানিচোবানি খাইয়েছে!
বিচারপতি পাইলেটকে নিয়ে এরও আগে, ১৯০২ সালে ‘দ্য প্রকিউরেটর অব জুডিয়া’ নামে ছোটগল্প লিখেছিলেন আনাতোল ফ্রাঁস। প্রৌঢ় পাইলেট সিসিলি দ্বীপে থাকেন, চাষবাস করেন। কিন্তু এখনও সিজ়ার, রোম বলতে বুকের রক্ত চলকে ওঠে। পুরনো এক বন্ধুর সঙ্গে আড্ডায় পুরনো মেয়েমানুষের স্মৃতি হাতড়ান তাঁরা। জেরুজ়ালেমে এক ইহুদি মেয়ে নাচের বিভঙ্গে দীপ্তি ছড়াত। বন্ধু শেষে বলে, “শুনেছিলাম, মেয়েটা নাজারেথের জিশু বলে কোনও এক জনের অনুগামীদের দলে যোগ দিয়েছে। সেই জিশু নাকি কোনও একটা অপরাধের জন্য ক্রুশকাঠে বিদ্ধ হয়েছিল। তোমার কিছু মনে আছে, পন্টিয়াস?” “নাজারেথের জিশু?” বৃদ্ধ পাইলেট বিড়বিড় করেন, “মনে পড়ছে না তো।” এখানেই সাহিত্যে বিচারপতির ট্র্যাজেডি। সিজ়ারের কাছে তাঁর নামে কে লাগানিভাঙানি করেছিল এবং সব মনে আছে, শুধু ইতিহাস যে কারণে তাঁকে মনে রাখবে, সেটাই স্মৃতিতে নেই।
মাস্টার অবশ্য তার উপন্যাসের চরিত্রকে মুক্তি দিয়েছিল অন্য ভাবে। দু’হাজার বছর ধরে, চাঁদনি রাতের ছায়াপথে পল্টিয়াস পাইলেট তাঁর পোষা কুকুরটিকে নিয়ে পাথরের চেয়ারে বসে অপেক্ষা করেন। সে দিন জেশুয়ার পুরো কথা শোনা হয়নি। তার পর বারে বারে চেষ্টা করেন, কিন্তু কথা অসমাপ্ত রয়ে যায়। ওল্যান্ড মাস্টারকে বলে, ‘‘যাও, ওকে মুক্তি দাও। বাকি উপন্যাস এক লাইনে শেষ করো।’’
ওল্যান্ডের কথায় মাস্টার এ বার চেঁচিয়ে ওঠে, ‘‘তুমি মুক্ত।’’ পাহাড়ি ঝড় এবং বজ্রবিদ্যুৎ সেই চিৎকারে সঙ্গী হয়। মুক্ত পন্টিয়াস পাইলেট ছায়াপথের নীলাভ গহ্বরে হাঁটতে হাঁটতে পুরনো জেরুজ়ালেম শহরের দিকে মিলিয়ে যান।
ভয় থেকে মুক্তিতেই এই পৃথিবীর যাবতীয় সুসমাচার।