ইহা কোন তন্ত্র

কেবল নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কেনাবেচার পরিচিত খেলা নহে, মহারাষ্ট্রের ঘটনায় উলঙ্গ হইয়া পড়িল সাংবিধানিক দল-রাজনীতির বিপন্নতাও।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০১৯ ০০:০৪
Share:

রাজ্যপাল ভগৎ সিংহ কোশিয়ারীর কাছে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফডণবীস (বাঁ দিকে) ও উপমুখ্যমন্ত্রী অজিত পওয়ার (ডান দিকে)। পিটিআই

যে  কোনও গণতান্ত্রিক দেশে সরকার গঠনের প্রক্রিয়াটিই গণতন্ত্রের আকার-প্রকার বুঝাইবার পক্ষে যথেষ্ট। তাহার সামর্থ্য ও সীমা দেখাইতে সক্ষম। সুতরাং মহারাষ্ট্রের সরকার গঠন লইয়া যে কাণ্ড গত দুই দিনে ঘটিয়া গেল, স্বাভাবিক ভাবেই তাহা ভারতীয় গণতন্ত্রের বিচারকে সর্বোচ্চ আদালতে পৌঁছাইয়া দিয়াছে। সন্দেহ করিবার অবকাশ নাই যে, এ দেশে গণতন্ত্র গলিয়া-পচিয়া এক ভয়াবহ অনৈতিকতায় পর্যবসিত। ‘ঘোড়া কেনাবেচা’র বিষয়টি স্বাধীন ভারতে বার বার দেখা গিয়াছে, এমনকি দেড়শত বৎসর আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট এব্রাহাম লিঙ্কনের দেশেও দেখা গিয়াছে— কিন্তু মহারাষ্ট্রের ঘটনাবলি বুঝাইয়া দেয় অশালীনতার কোন তলানিতে তাহা নামিতে পারে। গভীর রাত্রিতে অতর্কিত ব্যস্ততায় রাজ্যপাল একটি পক্ষকে সরকার গড়িতে ‘আহ্বান’ জানাইতেছেন, ভোরের আলো ফুটিতে না ফুটিতে তাহা সংঘটিত হইতেছে, ইহার মধ্যে গণতন্ত্র-স্বীকৃত জনমতের সিলমোহর খুঁজিয়া পাওয়া অসম্ভব। কেবল টাকা ও ক্ষমতার জোরের উপর ভর করিয়া রাতবিরেতে যাঁহারা এমন ‘সার্জিকাল স্ট্রাইক’ চালাইলেন, তাঁহাদের হাতে গণতন্ত্রের মৃত্যুঘণ্টা বাজিল, এ কথা বলাই যায়। ক্ষিপ্র স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, যোগ্য সহচর বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী, ক্ষমতালোভী ও সুযোগসন্ধানী বিরোধী নেতা, অনুগত রাজ্যপাল, কাহার নাম এই ঘণ্টাবাদ্যের সহিত সর্বাধিক যুক্ত, সে তর্ক নিতান্ত অপ্রাসঙ্গিক।

Advertisement

কেবল নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কেনাবেচার পরিচিত খেলা নহে, মহারাষ্ট্রের ঘটনায় উলঙ্গ হইয়া পড়িল সাংবিধানিক দল-রাজনীতির বিপন্নতাও। একটি দলের নেতা যখন বিপক্ষের সঙ্গে হাত মিলাইয়া সরকার গড়িতে চলেন, তখন তিনি দলেরই প্রতিনিধিত্ব করিতেছেন কি না, দলের কত জনের প্রতিনিধিত্ব করিতেছেন, দলের পক্ষে কথা বলিবার অধিকারের জন্য কত জনের প্রতিনিধিত্ব করা দরকার, কোন সময়ের মধ্যে সেই সংখ্যা নিশ্চিত করিতে হয়, দল বহিষ্কার করিলেও বহিষ্কারের কয়েক ঘণ্টা আগে গৃহীত সিদ্ধান্ত দলের তরফে বহাল থাকে কি না— প্রশ্ন অসংখ্য। সমগ্র সরকার গঠনের বৈধতা নির্ভর করিতেছে ইহার উপর— তাই সর্বোচ্চ আদালতের অঙ্গনে এই প্রশ্নগুলিই পৌঁছাইয়াছে। তবে কিনা, আদালতের আইনি মীমাংসার বাহিরেও আর একটি বিষয় থাকিয়া যায়— তাহা নৈতিক দায়। আজিকার ভারতে এই নৈতিক দায়ের প্রশ্নটিরও সুবিচার দাবি করা দরকার। েয নেতাদের নিশুতি রাতে সরকার গঠনের প্রস্তুতি লইতে হয়, এবং তাহাকে সমর্থন জোগাইতে সেই রাতের নামকরণ করিতে হয় ‘রামপ্রহর’— তাঁহাদের সাংবিধানিক দায়িত্ববোধ ও কর্তব্যবোধ বিতর্কোর্ধ্ব হইতে পারে না।

এবং অবশ্যই, আরও একটি বৃহৎ সাংবিধানিক সঙ্কট নিহিত রাজ্যপাল পদটির মধ্যে। মহারাষ্ট্রের ঘটনা আরও এক বার প্রমাণ করিল ভারতীয় সংবিধানের যুক্তরাষ্ট্রীয়তার যে ‘ভাব’ রক্ষার নির্দেশ দেওয়া হইয়াছিল, তাহা ক্রমাগত অবজ্ঞাত হইতে হইতে এখন পদদলিত হইতে বসিয়াছে, এবং পদদলনের সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত মাধ্যম হিসাবে রাজ্যপাল বড় বেশি রকম কার্যকর হইয়া উঠিয়াছেন। স্বাধীন ভারতে রাজ্যপালের এই সমস্যা বরাবরই থাকিয়াছে। কিন্তু বর্তমানে নানা রাজ্যেই যে ভাবে খোলাখুলি প্রায় দলীয় এজেন্ট-এর মতো এই পদটির ব্যবহার হইতেছে, তাহাতে রাজ্য রাজনীতির মধ্যে কেন্দ্রের ‘স্ট্রাইক’ চালাইবার অস্ত্র হিসাবে উপস্থিত থাকা ব্যতীত এই পদটির আর কী গঠনমূলক ভূমিকা— আর এক বার বিবেচনা করিয়া দেখা উচিত। বিরোধী নেতারা নিশ্চয় আবারও ব্যর্থ হইবেন প্রশ্নগুলিকে যথাযোগ্য গুরুত্ব দিয়া শাসকের উপর চাপ দিতে। শেষ পর্যন্ত তাই নাগরিক সমাজের উপরই ভরসা— দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোর বৃহৎ বিপন্নতার প্রেক্ষাপটে জরুরি প্রশ্নসমূহ তুলিবার জন্য।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement