লন্ডন ডায়েরি।
রানি দ্বিতীয় এলিজ়াবেথের রাজত্ব সাঙ্গ হল। শুরু হল রাজা তৃতীয় চার্লসের জমানা। ৭০ বছরের রাজত্ব, বেশির ভাগ ব্রিটিশই ছোট থেকে রানিকে ছাড়া কাউকে সিংহাসনে দেখেননি। তাঁকে ছাড়া মানিয়ে নিতে সময় লাগবে। ডাকটিকিট, ব্যাঙ্ক নোট থেকে বিস্কুটের টিনেও তাঁর মুখ। সরকারি দফতরের কাগজকলম, কার্পেট, আসবাবে তাঁর সিলমোহর ‘ইআর’ (এলিজ়াবেথ রেজিনা)। চায়ের প্যাকেট থেকে জ্যামের বোতল— রাজসনদ মানেই তাঁর অভিজ্ঞান। গত সাত দশকে কোনও পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়নি।
বাজারে রানির ছবি দেওয়া সাড়ে চার বিলিয়ন স্টার্লিং নোট চলছে। সেগুলো বদলে রাজা চার্লসের ছবিওয়ালা নোট আনতে অন্তত দু’বছর লাগবে। রানির ছবি দেওয়া মুদ্রার নকশা পাল্টাবে। কানাডার কিছু নোট, নিউ জ়িল্যান্ডের মুদ্রা, কমনওয়েলথের কিছু অংশের সব নোট-মুদ্রাতে তাঁর ছবিও পাল্টাবে। ব্রিটেনের জাতীয় সঙ্গীতে ‘গড সেভ আওয়ার গ্রেশাস কুইন’-এর জায়গায় ‘কিং’ বলা হবে। অভ্যস্ত হতে সময় লাগবে। পিয়ানো, জিন, সোয়ারোভস্কি গয়না থেকে কলমিস্ত্রি, শব্দ প্রযুক্তিবিদ, ঝোপ-কাটা— ছ’শো রকমের ব্যবসায় রানির সনদ চলে। ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর পানীয়ের সংস্থাতেও রাজসনদ থাকে। রানির উত্তরাধিকারী বা রাজপরিবারের অন্য সদস্যের থেকে নতুন সনদ নিতে হবে এদের। সময় লাগবে। মাঝের সময়টুকু ব্যবসা চালানো যাবে। রানির চিহ্ন সম্বলিত ডাকবাক্সগুলি হয়তো থাকবে। রাজা ষষ্ঠ জর্জের চিহ্ন আঁকা পুরনো ডাকবাক্সগুলো তো এখনও আছে। এত বদল আনতে কয়েক বিলিয়ন পাউন্ড খরচ হবে।
স্মৃতি: বালমোরালে রানি ও প্রিন্স ফিলিপ, রানির চিহ্ন দেওয়া ডাকবাক্স (ডান দিকে)
শেষ নিদ্রার স্থানটি
বালমোরালই রানির জীবনাবসানের উপযুক্ত ক্ষেত্র। স্কটিশ এস্টেটটি রানির প্রিয়। কেয়ার্নগর্ম পাহাড় দিয়ে ঘেরা, ডি নদীর দু’ধারে ৫০,০০০ একর জুড়ে বিস্তৃত। লোকচক্ষুর আড়ালে পরিবারের সঙ্গে একান্তে সময় কাটাতেন এখানে। শৈশবে ঠাকুরদা-ঠাকুমা রাজা পঞ্চম জর্জ ও রানি মেরির সান্নিধ্যে ছুটি কাটাতেন। আসতেন স্বামী প্রিন্স ফিলিপ ও বাচ্চাদের নিয়ে। শেষ দিকে ঠাকুমা হয়েও এসেছেন। এখানে পোষ্য কর্গিদের নিয়ে ঘুরতেন, হাঁটতে বেরোতেন, বনভোজন করতেন। ফিলিপ বার-বি-কিউ করতেন, ধোয়ামোছা করতেন রানি নিজে। প্রিন্স ফিলিপের শেষ সময়ের অনেকখানি, শেষ বিবাহবার্ষিকীও এখানেই কাটিয়েছেন দু’জনে। লকডাউনে এখানেই ছিলেন প্রবীণ দম্পতি। রানি ভিক্টোরিয়ার স্বামী প্রিন্স অ্যালবার্ট ১৮৫২-য় দুর্গটি কেনেন। রানি ভিক্টোরিয়া এখানেই স্বামীর মৃত্যুর পর শোকপালন করতে এসেছিলেন। বালমোরাল দুর্গে থাকাকালীনই রাজপরিবারে ডায়ানার মৃত্যুর খবর আসে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের নজর এড়াতে এখানেই ঠাকুরদা-ঠাকুমা প্রিন্স ফিলিপ ও রানির ছত্রছায়ায় ব্যক্তিগত সময় কাটান উইলিয়াম ও হ্যারি। বৃহস্পতিবার সেই বালমোরালের দরজা দিয়েই রাজপরিবারের সদস্যদের গাড়ি ঢুকে গেল ভিতরে, নিভৃতে শোকযাপনের উদ্দেশ্যে।
এলিজাবেথের রসবোধ
মনে থেকে যাবে রানির হাসি, রসবোধ ও ‘স্পোর্টিং স্পিরিট’। ২০২২ অলিম্পিক্সের উদ্বোধনে বাকিংহাম প্রাসাদে জেমস বন্ডের শুটিং-এর অনুমতি দেন। দেখা যায়, বন্ডবেশী ড্যানিয়েল ক্রেগ রানিকে উদ্ধার করে প্রাসাদের বাইরে নিয়ে যাচ্ছেন। প্ল্যাটিনাম জয়ন্তীতে প্যাডিংটন ভালুকের সঙ্গে শর্ট ফিল্ম তোলেন। সে চা উল্টায়, প্রাসাদে হাঙ্গামা বাধায়। রানিকে দেখায়, হ্যাটের তলায় সে মার্মালেড স্যান্ডউইচ রাখে। দুষ্টু হেসে রানি জানান, তাঁর স্যান্ডউইচ রাখেন হ্যান্ডব্যাগে। দৃশ্যটি অনেকের কাছেই রানির প্রিয়তম ছবি। চায়ের নেমন্তন্ন শেষে রানি ও প্যাডিংটনের প্রস্থানের অলঙ্করণটি পোস্ট করেছেন অনেকে। ছবিটি প্ল্যাটিনাম জয়ন্তীর প্রতীক হয়ে উঠেছিল। এখন তা যুগান্তের পরিচায়ক।
প্রস্থান: রানি, কর্গি ও ভালুকের অলঙ্করণ
রানির ভারত-যোগ
ভারতের সঙ্গে রানির যোগ ঘনিষ্ঠ। ১৯৪৭-এ রানির বিয়েতে নিজের হাতে খাদির শাল বুনে উপহার দিয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী। ১৯৬১-তে প্রিন্স ফিলিপের সঙ্গে রানি প্রথম ভারতে আসেন, স্বাধীনতার পর সেই প্রথম কোনও ব্রিটিশ শাসকের ভারতসফর। নেহরু তাঁর জন্য লাল কার্পেটের ব্যবস্থা করেছিলেন। বারাণসীতে হাতির পিঠে চাপেন, তাজমহলে যান। দিল্লির রামলীলা ময়দানে বক্তৃতা দেন। শেষ বার ভারতে এসেছিলেন ১৯৯৭-এ। অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরে সফরকালে প্রিন্স ফিলিপ জালিয়ানওয়ালা বাগ কাণ্ডে মৃতদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলায় বিতর্ক হয়েছিল।