দলের সদর দফতরে সাংবাদিক বৈঠকে কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গাঁধী। সোমবার নয়াদিল্লিতে। পিটিআই
মাসিক আয় ১২০০০ টাকার কম, এমন আনুমানিক ২০ শতাংশ দরিদ্রতম পরিবারকে মাসে ৬,০০০ টাকা অর্থসাহায্য করিবার পরিকল্পনাটি অর্থনীতির ধোপে টিকিবে কি না, বা ন্যূনতম সহায়ক আয়ের ব্যবস্থা করাই দারিদ্র দূর করিবার সর্বোত্তম পন্থা কি না, প্রশ্নগুলি তর্কসাপেক্ষ। প্রতিটি তর্কের ফলই যে রাহুল গাঁধীর পক্ষে যাইবে, সেই নিশ্চয়তাও নাই। কিন্তু একটি কথা তর্কাতীত— নির্বাচনের ঢাকে আনুষ্ঠানিক কাঠি পড়িবার পর এই প্রথম বার বিরোধী শিবির হইতে আজেন্ডা বা উপজীব্য বিষয় স্থির করিবার একটি চেষ্টা দেখা গেল। এত দিন অবধি শাসকরা যেমন ডুগডুগি বাজাইয়াছেন, বিরোধীরা তাহার তালে নাচিয়াছেন। গেরুয়া শিবির মন্দির নির্মাণের ধুয়া তুলিয়াছে, প্রিয়ঙ্কা গাঁধী বঢরা মন্দিরে মন্দিরে মাথা ঠেকাইয়া ফিরিয়াছেন। নরেন্দ্র মোদী চৌকিদারির হাঁক দিয়াছেন, বিরোধীরা সেই অন্তঃসারশূন্য স্লোগান লইয়া মশকরা করিতে দিগ্বিদিকজ্ঞান হারাইয়াছেন। বস্তুত, ‘আমিও চৌকিদার’, এ হেন স্লোগানের মধ্যে যে রাজনীতি— বা, রাজনীতিহীনতা— আছে, নিম্নবর্গের মানুষের বঞ্চনাকে ক্রমাগত অস্বীকার করিয়া চলিবার সঙ্ঘ-মার্কা রাজনৈতিক দর্শন-পুচ্ছধারী অভিসন্ধি আছে, বিরোধী নেতারা সেই সত্যটিকেও চিহ্নিত করিতে পারেন নাই। তাঁহারা অবান্তরের সাধনায় মগ্ন হইয়াছেন।
অনুমান করা চলে, শাসকরাও তাহাই চাহেন। প্রকৃত প্রশ্নগুলি যাহাতে নির্বাচনী রাজনীতির পরিসরে ঢুকিতে না পারে, তাহা নিশ্চিত করিতে পারিলেই নরেন্দ্র মোদীদের পক্ষে লড়াই সহজতর হইয়া যায়। বিরোধীরা তাঁহাদের অনুগামিতার অভ্যাস পুরোপুরি ছাড়িতে পারিবেন, তাহার ভরসা নাই— গঙ্গাজলে আচমন সারিয়া প্রিয়ঙ্কা গাঁধী এ বার রামজন্মভূমির পথে! কিন্তু সহায়ক আয়ের প্রকল্পটি বিরোধী রাজনীতিকে অন্তত একটি ভিন্ন পথ দেখাইল। শাসকরা ইহার তাৎপর্য বুঝিতে ভুল করেন নাই। রাহুলের প্রস্তাবটিকে লইয়া তাঁহারা যতই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করুন, মনে মনে নিশ্চিত জানেন, গত পাঁচ বৎসরে দরিদ্র ভারতীয়র ‘অচ্ছে দিন’ যে আসে নাই, রাহুলের প্রতিশ্রুতি ঠিক সেই কথাটিকেই প্রকট করিয়া তোলে। ২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির চাপ সামলাইয়াও মনমোহন সিংহের সরকার ভারতীয় অর্থনীতিকে যে জায়গায় রাখিয়াছিল, সহজতর পিচেও নরেন্দ্র মোদী তাহার ঢের কম রানে আউট হইয়া গিয়াছে। বৃদ্ধি-হারের গতিভঙ্গ অব্যাহত, কর্মসংস্থানের হার ভয়াবহ, কৃষিতে নাভিশ্বাস উঠিতেছে। নোট বাতিল আর অপটু ভাবে প্রবর্তিত জিএসটি-র জোড়া ধাক্কা ভারতীয় অর্থনীতি এখনও সামলাইতে পারে নাই। অচ্ছে দিন!
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী প্রচারের জোরে ভারতের বুকে কাঁপুনি ধরাইয়া দিয়াছিলেন যে অর্থনীতি ডুবিতেছে, তিনি বিনা আর রক্ষা নাই। তৎকালীন শাসকরা সেই প্রচারের ধাক্কা সামাল দিতে, মোদীর তোলা— বহু ক্ষেত্রেই ভিত্তিহীন— প্রশ্নের উত্তর দিতে নাজেহাল হইয়াছিলেন। নরেন্দ্র মোদীর পাঁচ বৎসরব্যাপী ব্যর্থতা ও অপরিণামদর্শিতা এই দফায় তাঁহাদের সম্মুখে অস্ত্রের ডালি সাজাইয়া দিয়াছে, কিন্তু বিরোধী নেতারা এখনও নরেন্দ্র মোদীর তৈরি করিয়া দেওয়া বিষয়গুলি লইয়াই মগ্ন। তাঁহারা যথেষ্ট তৎপরতার সহিত প্রশ্ন করেন নাই যে, বিজেপির ২০১৪ সালের প্রতিশ্রুতিগুলি স্বচ্ছ গঙ্গার জলে ভাসিয়া গেল কেন। জানিতে চাহেন নাই, ভূ-জল যে বিপজ্জনক হারে নামিতেছে— কৃষি তথা গ্রামভারতের জীবনযাত্রায় যাহার প্রভাব দূরপ্রসারী— সরকার তাহার কী প্রতিকার করিল। তাঁহারা সরকারের প্রধান প্রকল্পগুলির ব্যর্থতার কথা মানুষকে বলিয়া উঠিতে পারেন নাই। চৌকিদারেই আটকাইয়া গিয়াছেন। এখনও যদি রাহুল গাঁধীরা অবান্তরের আরাধনা ছাড়িয়া অর্থনৈতিক ব্যর্থতার কথাটিই মানুষের মনে গাঁথিয়া না দিতে পারেন, আর কবে পারিবেন?