Anisuzzaman

তাঁরা অভিভাবক, তাঁরা শিক্ষক, সাহিত্যসমাজ চিরঋণী তাঁদের কাছে

আনিসুজ্জামান, দেবেশ রায়। একই দিনে দুই নক্ষত্রপতন। বাংলা সাহিত্যজগৎ এ শোক কাটিয়ে উঠবে কী করে! আনিসুজ্জামান, দেবেশ রায়। একই দিনে দুই নক্ষত্রপতন। বাংলা সাহিত্যজগৎ এ শোক কাটিয়ে উঠবে কী করে! 

Advertisement

তিলোত্তমা মজুমদার

শেষ আপডেট: ১৬ মে ২০২০ ০৩:৫৭
Share:

আনিসুজ্জামান ও দেবেশ রায়—  দু’জনেই বাংলা সাহিত্যজগতে দুই দিকপাল।

বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগৎ শোকাভিভূত করে চিরবিদায় নিলেন আনিসুজ্জামান এবং দেবেশ রায়। একই দিনে দুই নক্ষত্রপতন যেমন অভাবনীয় বিপর্যয়, তেমনই দুর্বহ তার আঘাত। একের প্রয়াণসংবাদ যে শোক ও আচ্ছন্নতায় অগণিত ভাষাপ্রেমীকে দ্রব করেছে, তারই কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে আরেকজনের চিরবিদায় নিষ্ঠুর নিয়তির ভয়ঙ্কর উৎপাত বলে মনে হয়।

Advertisement

আনিসুজ্জামান ও দেবেশ রায়— দু’জনেই বাংলা সাহিত্যজগতে দুই দিকপাল। দু’জনেই সৃজনশীল ও প্রাজ্ঞ। বাংলার ভাষার তরণিতে এই দুই শক্তিমান কান্ডারি রাজনৈতিক সীমানা অতিক্রম করে দুই বাংলার সংস্কৃতি ও সাহিত্যে অভিভাবক হয়ে উঠেছিলেন। তাঁদের চিরবিদায় যে শূন্য আসন রেখে গেল, তার আর প্রতিপূরণ হতে পারবে না।

আনিসুজ্জামানের সঙ্গে প্রথম পরিচয় তাঁর ‘মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’ গ্রন্থপাঠে। মননশীল বিশ্লেষণ ও সবিস্তার আলোচনা সম্বল করে রচিত এই অক্ষয় প্রবন্ধগ্রন্থপাঠ কতজনের বোধ, ধারণা, জ্ঞান, বাংলা সাহিত্য বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছে, কত জনের সাহিত্যবোধের কূপমণ্ডুকতা বিদূরিত করেছে, তার সংখ্যা নির্ণয় করা অসম্ভব। তাঁর এই গ্রন্থ রচনার কৃতিত্ব বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের এক নবদিশার আনয়ন। শুধু তাই নয়, দেশভাগ ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রত্যক্ষ সাক্ষী আনিসুজ্জামান তাঁর প্রজ্ঞা ও পরিশীলিত দৃষ্টিপাতে ১৭৫৭ থেকে ১৯১৮ পর্যন্ত মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্যের যে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশেষত্ব লিপিবদ্ধ করলেন, তা সাহিত্যমাধ্যমে এক ঐতিহাসিক দলিল হয়ে রইল।

Advertisement

পরবর্তী কালে আরও বহু প্রবন্ধের রচয়িতা আনিসুজ্জামান দুই বাংলাতেই ছিলেন সমান শ্রদ্ধার পাত্র। যেহেতু জীবনের এক দীর্ঘ পর্ব তাঁর এই বাংলার ভূমি স্পর্শ করে অতিবাহিত হয়েছে, সেহেতু তিনিও দুই বাংলাকেই নিজের বলে মানতেন। শুদ্ধ সাহিত্যচর্চাই নয়, অধ্যাপক, পণ্ডিত আনিসুজ্জামান অত্যন্ত উদ্যমী, সুসংগঠক ও সুপরিচালক। বহু সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের তিনি ছিলেন কর্ণধার, দায়িত্বশীল, দক্ষ। ব্যক্তিগত ভাবে যাঁদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় গড়ে তোলার সৌভাগ্য হয়েছিল, তাঁরা জানেন, তিনি ছিলেন সৌম্য, অমায়িক, স্নেহপরায়ণ। তাঁর সৃজনশীলতার অসামান্যতা, বহু স্বীকৃতি ও পুরস্কারের ভূষণ, তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা তাঁর স্বাভাবিক স্নেহ ও সহৃদয়তা এতটুকু আড়াল করেনি। সম্পাদক হিসেবেও তিনি একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। তিনি সংযুক্ত আছেন অথবা তিনি প্রধান সম্পাদকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন, এমন পত্রিকার মান সব সময়ই উন্নত ও শিল্পসম্মত।

বহু গুণ ও অপার জ্ঞান তাঁকে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির জগতে চিরস্মরণীয় করে রাখবে। সেই সঙ্গে, যারা তাঁকে ব্যক্তিগত ভাবে জানার সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরাও তাঁকে চিরায়ুষ্মান করে রাখবেন।

আনিসুজ্জামানের মতো দেবেশ রায়ও দুই বাংলার সাহিত্যমনস্ক মানুষের কাছে পরম শ্রদ্ধেয় অভিভাবক। সত্যিই, একই নিবন্ধে এই দুই সদ্যপ্রয়াত ব্যক্তি সম্পর্কে লিখতে গিয়ে বার বার দীর্ঘশ্বাস আসছে। কাল সমস্ত গ্রাস করে। ব্যক্তি, বস্তু, শিল্প, স্থাপত্য, কিছুই স্থায়িত্ব পায় না। এ কথা যেমন সত্য, তেমনই সত্য আমাদের অনুভব ঋদ্ধ হৃদয়ের অনুক্ষণ উপলব্ধি। খুব কি প্রয়োজন ছিল দুই মহাপ্রয়াণ একই দিনে ঘটার? এই সুবিপুল তরঙ্গাঘাতের জন্য কেউ কখনও প্রস্তুত থাকে না। এমনিতেও সমস্ত পৃথিবী এখন শোকগ্রস্ত, সন্ত্রস্ত। করাল মরণ ভাইরাস হয়ে ছেয়ে গিয়েছে। ঠাকুরমার ঝুলির সেই লালকমল নীলকমল গল্পের মতো ঘরে ঘরে ত্রাস, আজ কার পালা, কোথায়, কেমন। জীবনযাপনের অস্বাভাবিকতায় এমন দুই শোকাবেগ সামাল দেওয়ার ক্ষমতা পায় কোথায় মানুষ?

সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সমাজ বিশ্লেষক দেবেশ রায় বর্তমানের অনেক লেখকের কাছেই আক্ষরিক অর্থে অভিভাবকের আসনে সমাসীন। সেই অভিভাবকত্ব সাহিত্যবোধ উন্নীতকরণের, ভাষাবোধ বিস্তারের। সেই অভিভাবকত্ব এক প্রজ্ঞাবানের পায়ের কাছে বসে প্রশ্ন করার অধিকার প্রদান, দেবেশ রায় যা দিয়েছেন অনেককেই।

ভাষাশিল্পী দেবেশ রায় উত্তরবাংলার মানুষ। তাঁর অধিকাংশ সাহিত্যকীর্তির বিষয় ও পরিপ্রেক্ষিত উত্তরবঙ্গ। ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ তাঁর সুপরিচিত উপন্যাস। হয়তো যিনি সাহিত্যপিপাসু নন, কিন্তু সংস্কৃতির অন্য আরও ক্ষেত্রে বিচরণ করেন, তিনিও এই গ্রন্থের নাম জেনে থাকবেন। কিন্তু ‘তিস্তা পুরাণ’ ও অন্যান্য উপন্যাস বা গল্পগুলি না পড়লে দেবেশ রায়ের সাহিত্যক্ষমতা সম্পূর্ণ আস্বাদন করা যাবে না। সাহিত্য রচনাকালে এক আশ্চর্য ভাষা সম্ভার ও গভীর বিশ্লেষণী মেধা নিয়ে তিনি অবতীর্ণ হয়েছেন বারংবার। কলকাতায় বাস করলেও উত্তরবঙ্গের সঙ্গে তাঁর সংযোগ নিবিড়তা কখনও ক্ষীণ হয়নি। তাঁর চিন্তনে তিস্তার স্রোত ছিল সদা বহমান। নদীমাতৃক এই বাংলায়, উত্তরবঙ্গ যেন নদী, ঝোরা, ঝরনা , পুকুর দিয়ে গড়া এক অত্যাশ্চর্য ভুবন। এত নদী, জঙ্গল, পাহাড়, চায়ের বাগান, শস্যক্ষেত্র এবং বহু জাতি-উপজাতি সমন্বয়ে উত্তরবঙ্গ যেমন চিত্তাকর্ষক, তেমন রহস্যময়। দেবেশ রায় সম্পর্কে বলা যায়, তিনি সাহিত্যিক রূপে সেই অপার রহস্যের শিলালিপি উদ্ধারে ব্রতী ছিলেন।

নদী ও জঙ্গল, খেত ও চাষবাস সম্বল যে জীবন, চায়ের বাগান ও অপাপ সরলতার যে মন ওখানকার অস্তিত্ব ঘিরে, তার বিপরীতে শোষণ ও নিপীড়ন, অত্যাচার ও অনাচার, অন্যায় ও নির্যাতনের দুঃখ তাঁর কলমের কালি হয়ে উঠেছে বার বার। সুন্দর ও সারল্যের পাশপাশি যে বর্বরতার বাস, তাকে তিনি চিরে, ফাটিয়ে, ভেঙে দেখাতে চেয়েছেন। তাঁর রচনা বড় বলিষ্ঠ ও সত্যবাদী। এই সত্য সহ্য করার সাহস যার নেই, সে দেবেশ রায়ের পাঠক হতে পারবে না। তাঁর ভাষা ডুয়ার্সের ঘন সবুজ জঙ্গল ও সরলচিত্ত মানুষগুলির হাসিকান্নার মতোই ঘনবুনট। তাঁকে অনুধাবন করতে চাইলে কেবল উপভোগ্যতা নয়, চাই প্রশিক্ষিত চিন্তন ও সমাজসচেতনতা। তাঁর রচনা কখনও বিশুদ্ধ বিনোদন নয়। সাহিত্যিকের স্তর বিভাজন করলে দেবেশ রায় থাকবেন প্রথম সারির একজন হয়ে।

আনিসুজ্জামান ও দেবেশ রায়ের প্রয়াণ অপূরণীয় ক্ষতি। তবু, বাংলা সাহিত্যে তাঁদের অবদান পাঠকের চিরকালীন সম্পদ হয়ে রইল, এই যা সান্ত্বনা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement