এমন ভাবে বলা হচ্ছে, যেন সংবিধানে শুধু ৩৭০ ধারাটা আইনের সমতার গলার কাঁটা।
দেবেশ রায় লিখেছেন ‘ওঁরা একটু পড়াশোনা করুন না!’ (১৪-৮)। কাদের বলেছেন তিনি? নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহকে? তাঁরা যথেষ্ট পড়াশোনা করেই সব কথা বলছেন। পড়াশোনা করেন বলেই তাঁরা দিনকে রাত করতে দক্ষ। যাঁদের বলছেন, ভুল বোঝাচ্ছেন, সেই মানুষগুলোকে পড়াশোনা করাতে পারবেন দেবেশবাবু? সেই শ্রোতাদের কানগুলো সেই ভাবেই তৈরি: এক দেশ-এক আইন-৩৭০ ধারা- ইসলামি জঙ্গি-বহুবিবাহ-অনেক সন্তান— এগুলোই তাঁরা শুনতে চান। তাই এগুলোই শুনতে পান।
আসলে যুক্তি-তথ্য দিয়ে আপনি বলতে পারেন, ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার সময় ১২টি প্রদেশ নিয়ে যে ভারত গঠিত হয়, তার সঙ্গে পরে যুক্ত করা হয় ৫টি রাজ্য: জম্মু-কাশ্মীর, হায়দরাবাদ, সিকিম, ত্রিপুরা, মণিপুর। এ ছাড়া ছিল ৫৬৫টি দেশীয় রাজ্য। এই নতুন যারা এল, অন্তর্ভুক্ত হল, তাদের সঙ্গে পৃথক পৃথক চুক্তি হয়েছে। তাদের কিছু স্বাতন্ত্র্য রক্ষার জন্য, কিছু আর্থিক-সামাজিক রক্ষাকবচ। অরণ্যের জীবনেও তো বাইরের হস্তক্ষেপ মুক্ত রাখার আইন আছে। জনজাতীয় গোষ্ঠীর পৃথক পৃথক স্বার্থ রক্ষার বন্দোবস্ত। এটা শুধু কাশ্মীর বা ৩৭০ নয়, বৈচিত্রময় ভারতীয় ভূখণ্ডে এমন অসংখ্য ধারার অস্তিত্ব আছে। এই সব কথা আপনার লেখা পড়ে আমি তো বুঝলাম, বেশ।
এ বার সোজা কিছু প্রশ্ন করি। প্রশ্ন ১) কাশ্মীরের জনগণের মতামত, গণভোট নেওয়া হয়েছিল ভারত ভুক্তির সময়?
উত্তর: না, রাজা হরি সিংহ চেয়েছিলেন, তাই অন্তর্ভুক্ত।
প্রশ্ন ২) হায়দরাবাদের রাজা নিজাম কি চেয়েছিলেন ভারতভুক্তি?
উত্তর: না, সেখানকার জনগণ চেয়েছিলেন ভারতভুক্তি, তাই অন্তর্ভুক্ত।
এ তো মেষ-শাবককে দেখানো নেকড়ের যুক্তি। যে ভাবে হোক, কাজ হাসিল করা।
‘এক দেশ এক আইন’, কথাটা লোকে খাচ্ছে, তাই খাওয়াচ্ছে। আসলে কত অসংখ্য ছোট ছোট দ্বিপাক্ষিক চুক্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে আমাদের ভারত, আমাদের জানাই নেই।
এমন ভাবে বলা হচ্ছে, যেন সংবিধানে শুধু ৩৭০ ধারাটা আইনের সমতার গলার কাঁটা। এই একটা কাঁটা তুললেই আইনের সমতা। এমন অসংখ্য সহস্র কাঁটা আছে। তবে কাশ্মীর নামের সঙ্গে পাকিস্তান, মুসলমান অনেক কিছু লগ্ন হয়ে আছে। ওটা নিয়ে জমবে ভাল। জমছেও।
কেন জমছে, গল্পটা বলি। বছর কয়েক আগের কথা, বৈদ্যবাটি স্টেশনে আলাপ। কিশোরী, গীতা পাসোয়ান। লাইনের ধারে ঝুপড়ির বাসিন্দা। লোকের বাড়ি কাজ করে। যাবে মানকুণ্ডু, সেখান থেকে ‘স্বপ্না’ সিনেমা হল। টিকিট না পেলে পাশেই ‘জ্যোতি’ সিনেমা হল। স্টেশনে বসবাস, কিন্তু দৌড় ও-দিকে মানকুণ্ডু, চন্দননগর, আর এ-দিকে শ্রীরামপুর। এটাই ওর বিশ্ব। ওরা নাকি কেতুগ্রাম থেকে এসেছে। কিন্তু ও কখনও কেতুগ্রাম দেখেনি। শ্রীরামপুর গিয়েছে, মানসী টকিজ়, কমলা সিনেমা হল, আর মাহেশের রথ দেখতে। ও-দিকে চন্দননগরে জ্যোতি, স্বপ্না, শ্রীদুর্গা ছবিঘর, আর জবরদস্তি (জগদ্ধাত্রী) পুজো।
— কী সিনেমা দেখবি?
— ওই তো, ‘সাজন’, আগে দেখা হয়নি, ফের এসেছে। হেব্বি।
— কে কে আছে?
— সলমান, সঞ্জয় দত্ত আর মাধুরী দিকসি (দীক্ষিত)।
— ওরা কোথায় থাকে জানিস?
— হুম, ফরেনে, বম্বেতে। দূর আছে, ট্রেনে যেতে হয়। টাইম লাগে। এই লোকাল ট্রেনে না, মেল ট্রেন।
— বাব্বা, ফরেন জানিস তুই! ভারত কী, জানিস?
— মানে ইন্ডিয়া! ওটা একটা কেলাব। ক্রিকেট খেলে। সচিন সৌরভ খেলে।
— আর কোন কেলাবের নাম জানিস?
— পাকিস্তান, আনোয়ার জানোয়াররা খেলে।
— তুই কোন কেলাবের সাপোর্টার?
— ইন্ডিয়া ইন্ডিয়া। আনোয়ার জানোয়ার সব সচিনের কাছে ফুটে যাবে।
— পাকিস্তান কেলাবটা তোর শত্তুর কেন?
— ওরা আমাদের দেশের কাশ্মীর নিয়ে নিতে চায়।
— কাশ্মীর! সেটা কী?
সেটা কোথায়?
— একটা পাহাড়, অনেক দূরে, মেল ট্রেনে যেতে হয়।
— কী করে জানলি?
— ‘রোজা’ দেখেছি, ‘মিশন কাশ্মীর’ দেখেছি।
যখন মানুষের শিরায় শিরায় ঠাসা বারুদ, বিষ, তখন গীতা পাসোয়ানদের পড়াবে কে?
মালবিকা মিত্র
হুগলি
অরুণ কুমার রায়। ধানবাদ অঞ্চলে এই নাম অনেকের কাছে অশ্রুত হলেও; এ কে রায় ধানবাদে আট থেকে আশি সবার কাছে এক অতি পরিচিত নাম (বিশেষ করে গত শতাব্দীর সত্তর থেকে নব্বইয়ের দশকে)।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্নাতক এ কে রায় জার্মানি থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পর ধানবাদের সন্নিকটে সিন্দ্রি সার কারখানায় উচ্চ পদে যোগদান করেন। কিন্তু শ্রমিকদের শোষণ ও ছোটনাগপুর অঞ্চলের সাধারণ হতদরিদ্র মানুষদের দুর্দশা পর্যবেক্ষণ করে তিনি শাঁসালো মাইনের চাকরি থেকে পদত্যাগ করে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করলেন।
দুর্ধর্ষ কয়লা মাফিয়া ও বিভিন্ন কায়েমি স্বার্থের বিরোধিতা সত্ত্বেও এ কে রায় ছ’বার নির্বাচনে জয়ী হয়ে বিধায়ক কিংবা ধানবাদের সাংসদ রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন।
সাধারণ শ্রমিক ও দুর্বলের হয়ে লড়াই করার লক্ষ্যে তাঁর অসীম আত্মত্যাগ, কৃচ্ছ্রসাধন, সততা ও সরল অনাড়ম্বর জীবনযাপন ধানবাদের কয়লাঞ্চলে তাঁকে কিংবদন্তিতে রূপান্তরিত করে। অকৃতদার এ কে রায় বাস করতেন পার্টি অফিসের এক ছোট্ট কক্ষে। দু’জোড়া শার্ট-প্যান্ট, জেনারেল ক্লাসে রেল ভ্রমণ! ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের নেই অস্তিত্ব! সাংসদ/বিধায়ক রূপে প্রাপ্ত অর্থ জনগণের সেবায়!
১৯৯১ সালের লোকসভা নির্বাচনে তিনি বিজেপির রীতা বর্মার কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। ব্যাঙ্ক ডাকাতদের গুলিতে নিহত পুলিশ অফিসার রণধীর প্রসাদ বর্মার স্ত্রী ছিলেন রীতা। তাই তিনি শুধু বিপুল সহানুভূতি-ভোটই অর্জন করেননি, অযোধ্যা ‘আন্দোলন’ও ছিল সে সময়ের ধানবাদে ও ভারতে সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ ও স্পর্শকাতর ইস্যু!
রাজনৈতিক ভাবে এ কে রায় মূলস্রোতের বাইরে চলে গেলেও, তাঁর চরিত্র অনুযায়ী নিঃশব্দে প্রান্তিক মানুষদের হয়ে কাজ করে চলেছিলেন। তাই প্রাক্তন সাংসদ রূপে তাঁর মোটা অঙ্কের পেনশন সরাসরি জমা হত রাষ্ট্রপতির জনকল্যাণ ফান্ডে!
বর্তমান সময়ের নিরিখে এই ‘কিম্ভূত’ মানুষটা জীবনের অন্তিম দিন পর্যন্ত এক বিদ্যুৎহীন কক্ষে অতিবাহিত করে গেলেন, দেশের অগণিত হতদরিদ্র মানুষদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে, যাদের জীবনে বিদ্যুৎ এক অধরা বস্তু!
ব্যতিক্রমী মানুষটি গত ২১ জুলাই নিঃশব্দে আলোকবৃত্তের বাইরে অন্তিম নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। কিছু সংবাদপত্রে তাঁর পরলোকগমনের সংবাদ প্রকাশিত হলেও, বিশাল ভারতীয় সমাজ-সমুদ্রে এ কে রায়ের চলে যাওয়া ন্যূনতম তরঙ্গেরও সৃষ্টি করল না।
কাজল চট্টোপাধ্যায়
পিয়ারলেস নগর, সোদপুর
তথ্য ও সংস্কৃতি দফতর মুখ্য দৈনিক সংবাদপত্রে অনেক অনুষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে। কেন জানি না বিশ্ববিখ্যাত বাংলার বিজ্ঞানীদের জন্মদিবস এই তালিকায় ব্রাত্য। গত ২ অগস্ট প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের জন্মবার্ষিকীতে তিনি উপেক্ষিত হলেন। মেট্রো রেলের স্টেশনগুলির নামকরণের ক্ষেত্রেও কবি, স্বাধীনতা সংগ্রামীরা তালিকাভুক্ত হন, কিন্তু কোনও বিজ্ঞানীর নাম বিবেচিত হয় না, যদিও ট্রেন বিজ্ঞানের অবদান!
বদ্রী নাথ দাস
কলকাতা-২৮