ফাইল চিত্র।
তরুণ মজুমদারের ছবি আমাদের হৃদয়ে অক্ষয় হয়ে থাকবে, অমর হয়ে থাকবেন পরিচালক। তাঁর প্রয়াণ যেন একটা যুগের অবসান। পরিচালনা শুরু করেন ১৯৫৯ সালে, ১৯৬২ সালে কাঁচের স্বর্গ ছবির জন্য জাতীয় পুরস্কার পান। তাঁর ঝুলিতে চার-চারটি জাতীয় পুরস্কার, পদ্মশ্রী সম্মান, বিএফজে ও আনন্দলোক পুরস্কার। সেই সময় প্রযুক্তিবিদ্যার এত জয়-জয়কার ছিল না, ছিল না মোবাইল ফোন। বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম ছিল প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে সিনেমা দেখা। আর সেটা যদি তরুণ মজুমদারের তৈরি সিনেমা হয়, তবে তো পাড়া কে পাড়া, গ্রাম কে গ্রাম ভিড় জমাত সিনেমা হলে। সিনেমার পোস্টার দেখলেই কাউন্টারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইন দিতে হত। ব্ল্যাকেও টিকিট কাটতে হত। বাবা তারকনাথ দেখতে গিয়ে দেখেছি, মেয়েদের টিকিট কাউন্টারে কী প্রচণ্ড উন্মাদনা।
তরুণ মজুমদারের ছবির গান কালজয়ী হয়ে যেত। তাঁর ছবিতে ব্যবহৃত রবীন্দ্রসঙ্গীত আমাদের আরও প্রিয়, আরও পরিচিত হয়ে উঠত। তাঁর হাতে ছিল জাদুকাঠি। প্রতিটা গল্পে ছিল সামাজিক বার্তা। আজ এত বিনোদনের পসরা সাজানো, তার মধ্যেও তরুণ মজুমদারের সিনেমা সুযোগ পেলেই দেখতে বসি। চলচ্চিত্র জগতে এক অপূরণীয় ক্ষতি তাঁর চলে যাওয়া। প্রয়াত পরিচালককে শ্রদ্ধা ও প্রণাম জানাই।
পতাকা বিশ্বাস, কৃষ্ণনগর, নদিয়া
যে ছবি হয়নি
অনেকেই আক্ষেপ করে বলেন যে, তরুণ মজুমদার কখনও রাজনৈতিক ছবি করেননি। যদিও গণদেবতা, পলাতক বা সংসার সীমান্তে-র মতো ছবিতে তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণের প্রতিফলন মেলে। তবুও তিনি এক বার সরাসরি রাজনৈতিক ছবি করার উদ্যোগ করেছিলেন। সেটা ১৯৯৪ সালের পুজোর পর। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের তৎকালীন প্রধান আমাদের শিক্ষক রাখহরি চট্টোপাধ্যায় এক দিন আমাকে তাঁর ঘরে ডেকে বললেন, “তরুণ মজুমদার নেতাজিকে নিয়ে ছবি করছেন। গবেষণার কাজে ওঁকে সাহায্য করতে হবে। তুমি যাবে?” তিন-চার দিন পরে এনটিওয়ান স্টুডিয়োতে ওঁর অফিসে পর্দা সরিয়ে ঢুকে পড়লাম। দেওয়ালজোড়া স্বামী বিবেকানন্দের বিশাল ছবি। টেবিলে রাখা নেতাজির উপর একগুচ্ছ বই। উনি পড়ছিলেন, লেনার্ড গর্ডনের ব্রাদার্স এগেনস্ট দ্য রাজ। যে-ই আসুন তরুণবাবু চা খাওয়াবেনই। কারও কথা বেশি ক্ষণ পছন্দ না হলে বলতে শুনেছি, “এ বার তা হলে এক কাপ বিদায়ী চা হয়ে যাক!”
এর পর চলল এক বিশাল পর্ব। সুভাষচন্দ্রের জীবন নিয়ে চিত্রনাট্য লিখবেন তিনি। আর আমি ঘটনাগুলো পর পর সাজিয়ে দেব। ব্যক্তিত্বপূর্ণ মানুষ, গম্ভীর গলা, রসিকতা করেন নিজে একটুও না হেসে। পড়াশোনার উদ্যম অবিশ্বাস্য। তরুণবাবু বলতেন, “আমাকে চিত্রনাট্য লিখতে হবে। অ্যানেকডোটস চাই। রাজনীতির তত্ত্বকথা নয়।” আমিও সেই মতো খুঁজে চলতাম। লিখতাম। চিত্রনাট্যে সেগুলো কী ভাবে আসবে, সেটা বোঝাতেন। এক দিন প্রশ্ন করলেন, “আচ্ছা, ছবিতে জওহরলাল নেহরুকে কোথায় আনা যায় বল তো?” বললাম, ধরুন জালিয়ানওয়ালা বাগের ঘটনার পর নেহরু ট্রেনে করে কোথাও যাচ্ছেন। উপরের বাঙ্কে জেনারেল ডায়ার। পাশের বাঙ্কে অন্য এক সেনা আধিকারিক। জেনারেল ডায়ার তাঁকে গর্ব করে নিজের কুকীর্তির কথা বলছেন আর নেহরু রাগে ছটফট করছেন। এটা সত্য ঘটনা।” উনি দৃশ্যটা লিখতে বললেন। আমার লেখা দেখে, পরের অংশটুকু লিখে দিলেন। এমন ডিটেলস-এ উনি কাজ করতে ভালবাসতেন মাঝেমধ্যে ভাবতাম, ইনি তো যে কোনও গবেষণার কাজ করতে পারেন! তাঁর সব ছবির চিত্রনাট্যের নেপথ্যেই ছিল এমন নিরলস গবেষণা।
সেই পর্বে জওহরলাল, গান্ধীজি, দেশবন্ধু, বাসন্তী দেবী সবাই আমাদের ঘিরে ছিলেন। গান্ধী-নেহরু সম্পর্ক নিয়ে আমাদের তর্কও হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্ব এল। হিটলারের সঙ্গে নেতাজি দেখা করবেন, এ কি কম কথা। দরজার দিকে পিছন করে ঘাড় নিচু করে লিখছি। হঠাৎ দেখি তরুণবাবু দরজার দিকে তাকিয়ে আছেন! আমি তাঁর দিকে তাকাতেই বলে উঠলেন, “ওই দেখো! যেই হিটলারের প্রসঙ্গ উঠেছে অমনি তিনি এসে হাজির।” ঘুরে দেখলাম, উত্তমকুমারের সহ-অভিনেতা কমেডিয়ান ফকির দাস কুমার দাঁড়িয়ে। মুহূর্তে তরুণবাবু আবার গম্ভীর, আমার হাসি আর থামছে না!
এক দিন শেষ হল এই পর্ব। আমি যা পেলাম, তা সারা জীবনের সম্পদ। কিন্তু নেতাজির উপর ছবিটি হল না। কেন, সে প্রসঙ্গ থাক। এ বছর পয়লা বৈশাখ ফোন করাতে তরুণবাবু বললেন, “আমরা কত আনন্দ করে তখন কাজ করেছিলাম, তাই না?”
মনে পড়ল কথাগুলো। চোখটা ঝাপসা হল লিখতে লিখতে।
উদয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা-৭৮
গীতিকার তরুণ
তরুণ মজুমদার গানও লিখেছিলেন নিজের ছবির জন্য। তাঁর লেখা গান হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে ফুলেশ্বরী (১৯৭৪) ছবিতে মান্না দে গেয়েছিলেন ‘শুন শুন মহাশয়’, ঠগিনী (১৯৭৪) ছবিতে আরতি মুখোপাধ্যায় ‘যদি সেই গান চৈত্রের ঝরাপাতা হয়ে’, পরশমণি (১৯৮৮) ছবিতে অমিত কুমার ও ডায়না দাস ‘হে ঘোড়া টিক টিক টিক’, সুজাতা সরকার ও ডায়না দাস ‘ও বাবু ও বাবুমশাই’। আগমন (১৯৮৮) ছবিতে আশা ভোঁসলে ও মান্না দে গেয়েছিলেন ‘ভালোবাসার এই কি রে খাজনা’ প্রভৃতি।
১৯৭৫ সালে সংসার সীমান্তে ছবিতে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘সুজন কান্ডারী’-র সুর দিয়েছিলেন ও গেয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। এই গানের মধ্যে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আর সন্ধ্যা রায়ের কথোপকথন শোনা যায়। সেই কথোপকথন লিখেছিলেন তরুণ মজুমদার। আবার এই ছবিতে পতিতাদের নিয়ে একটি গান তৈরির সময় পুলক মুখড়া লিখলেন, ‘ও সাধের জামাই রে, তুই নি ক্যান নাগর হইলি না।’ তরুণ মজুমদার সঙ্গে সঙ্গে কাগজটা টেনে নিয়ে ‘নাগর’ শব্দটি কেটে লিখে দিলেন ‘ভাতার’। এই গানটি চার জন মিলে লিখেছিলেন— পুলক, তরুণ, হৃদয়েশ পান্ডে ও হিমাংশু শেখর দাস। সুর করলেন হেমন্ত, গাইলেন হৈমন্তী শুক্ল, প্রভাতী মুখোপাধ্যায়, ইলা বসু, ছবি ভট্টাচার্য, অঞ্জলি মুখোপাধ্যায়।
বিশ্বনাথ বিশ্বাস, কলকাতা-১০৫
শূন্য আসন
পরিণত বয়সে তরুণ মজুমদারের জীবনাবসান হল, তাতে হয়তো তেমন দুঃখ নেই। দুঃখ এই যে, তাঁর মতো সফল বাণিজ্যিক ছবি কে বানাবে, যাতে ভরপুর মনোরঞ্জনের সঙ্গে চিন্তার খোরাক থাকবে? বাংলা ছায়াছবিতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঠিক প্রয়োগ তাঁর মতো কত জন করতে পেরেছেন? প্রতিটি ছবির সাফল্যের পিছনে তাঁর নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা কাজ করেছে। চিত্রনাট্য রচনায় তাঁর পারদর্শিতা দর্শককে আড়াই ঘণ্টা আসনে মন্ত্রমুগ্ধের মতো বসিয়ে রাখত। সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালির জীবনযাত্রা কেমন ধারা হয়, তা ওঁর সিনেমাগুলো দেখলে বোঝা যেত।
অরুণ গুপ্ত, কলকাতা-৮৪
সফল সিরিয়াল
‘আগামী ৬ মে জনতার জন্য চলচ্চিত্র শতবার্ষিকী ভবন’ (আনন্দ প্লাস, ৩-৫) শীর্ষক প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, “মনে আছে, এই বাড়িতেই শেষ দিকে তরুণ মজুমদারের অফিস। তখন তিনি এখানে বসেই এক বেসরকারি চ্যানেলের জন্য ‘দুর্গেশনন্দিনী’-র চিত্রনাট্য লেখেন। সেই সিরিয়াল আর হয়নি।” এই তথ্য ভুল। দুর্গেশনন্দিনী ধারাবাহিকটি একটি বেসরকারি চ্যানেলে দীর্ঘ দিন ধরে সম্প্রচারিত হয়েছে। ধারাবাহিকটি অত্যন্ত জনপ্রিয়তাও লাভ করেছিল।
চন্দন দাশ, কলকাতা-২৬
পথনির্দেশিকা
বারাসত জেলাশাসকের অফিস কেন্দ্রবিন্দু ধরলে তার এক কিলোমিটার ব্যাসার্ধের বৃত্তের মধ্যে বহু সরকারি অফিস আছে। কিন্তু বারাসত রেল স্টেশন, বাস স্ট্যান্ড এবং রাস্তার মোড়ে অফিসগুলির কোনও পথনির্দেশিকা নেই। যার ফলে বহু মানুষকে হয়রান হতে হয়। এই বিষয়ে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।
তাপস চন্দ্র মল্লিক, বারাসত, উত্তর ২৪ পরগনা