পীযূষ ঘোষের ‘কলেজ আসুক স্কুলেও’ (২১-৩) বিষয়ে কয়েকটি কথা। ভারতের উচ্চ শিক্ষালয়গুলিতে পড়াশোনা করার জন্য প্রস্তুতির সুযোগ স্কুলে স্কুলে আসা দরকার। এ জন্য সরকারি স্কুলগুলিতে পঠনপাঠনে গুরুত্ব দেওয়া দরকার। সারা বছর ধরে বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও কর্মকাণ্ড বিদ্যালয়ে প্রকৃত অধ্যয়ন ও অধ্যাপনার সময় কেড়ে নিচ্ছে। ফলে কেবলমাত্র সিলেবাস ও পরীক্ষার দিকে চোখ রেখে পড়াশোনা চলছে। তার পর বহু বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর তুলনায় শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা এতই কম যে, বিভিন্ন শ্রেণিতে উপযুক্ত পঠনপাঠন চালানো এক সমস্যা। বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়কে আকর্ষক করে তুলতে সক্ষম বহু শিক্ষক আছেন, কিন্তু তাঁদের কাজের সুযোগ ও স্বাধীনতা কম। গতানুগতিক প্রশ্ন করা, পরীক্ষা নেওয়া, খাতা দেখা আর ফল ভাল না হলেও পাশ করানো— এ এক একঘেয়ে কর্তব্য হয়ে গিয়েছে।
শিক্ষাদান তথা পঠনপাঠনকে আনন্দময় ও ফলদায়ী করতে চাই গবেষণা, তথা অনুসন্ধানমুখী কাজের পরিবেশ। কয়েকটি দিন স্বল্প সময়ের জন্য সকলে মিলে মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্য কোথাও গিয়ে চমকিত হওয়া যায়, কিন্তু সমমানের শিক্ষা পাওয়া যায় কি? আইআইটি, এনআইটি বা আরও অনেক উচ্চশিক্ষা কেন্দ্রে পড়াশোনা করার জন্য আগ্রহ থাকা উচিত, তবে ওই সব স্থানে প্রবেশের জন্য চাই ধারাবাহিক সুশৃঙ্খল অনুশীলন।
পড়ুয়াদের বিভিন্ন উচ্চশিক্ষালয়, গবেষণাগার দেখানো হোক, তবে তার আগে রোজ তাদের আপন বিদ্যালয়ে বিজ্ঞানসম্মত ও আনন্দদায়ক পড়াশোনাটা হোক। শিক্ষাক্রম থেকে ডারউইন, পর্যায় সারণি, ইত্যাদি বাদ দিয়ে প্রোজেক্ট আর সামার সায়েন্স কার্যক্রম যেন ‘গাছের গোড়া কেটে আগায় জল ঢালা’। সবাই ভবিষ্যতে বিজ্ঞানের গবেষণা করতে পারবে না, কিন্তু সব ছাত্রছাত্রীর হাতে অন্তত একটি টেস্ট টিউব আর লিটমাস পেপার দেওয়াই যায়।
অসীম বসাক, বারাসত, উত্তর ২৪ পরগনা
ল্যাব চাই
পীযূষ ঘোষের প্রবন্ধটিতে উপদেশগুলি মহৎ হলেও দু’টি প্রশ্ন ওঠে। এক, প্রয়োজনীয় পরিকাঠামোর অভাব, এবং দুই, উপযুক্ত মানসিকতার অভাব। এই দু’টি একে অপরের সঙ্গে জড়িত। সবার প্রথমে এই ভিত্তিহীন ধারণাকে বর্জন করতে হবে যে, দশমে বিজ্ঞানে ভাল ফল করলে বিজ্ঞান নিয়েই পড়তে হবে। বিষয় নির্বাচন নির্ভর করুক পড়ুয়ার আগ্রহের উপর, নয়া জাতীয় শিক্ষানীতিতে যার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। এই কর্মসূচির যে সুফল প্রবন্ধকার লিখেছেন, তার মধ্যে কোথাও স্কুল এবং কলেজ পড়ুয়াদের জন্য সার্টিফিকেট, কোর্সে নম্বর যুক্ত হওয়া, বা স্টাইপেন্ডের উল্লেখ নেই। তা হলে পড়ুয়া কী পেল? কেবল যোগাযোগের নেটওয়ার্ক এবং সামাজিক সংযুক্তি? তার জন্য তো অনলাইন-অফলাইন-সহ অনেক প্ল্যাটফর্ম রয়েছে।
বিষয় নির্বাচনের পর প্রথমেই জোর দিতে হবে, যাতে বিষয়টিতে পড়ুয়াদের ভিত মজবুত হয়। স্কুলগুলিতে উন্নত মানের ল্যাব গড়ে তুলতে হবে, চাই স্মার্ট ক্লাসরুম। বিজ্ঞানভিত্তিক বিষয়ে ভিত মজবুত করতে অডিয়ো-ভিস্যুয়াল ক্লাস খুব কার্যকর হতে পারে। এই স্তরেই আমরা বুঝতে পারব, কাদের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট সম্ভাবনা আছে। নির্দিষ্ট মাপকাঠিতে (সেটি হতে পারে কোনও পরীক্ষা, বা স্কুলে সার্বিক ফল) সর্বোৎকৃষ্টদের বিভিন্ন স্কুল থেকে বেছে নিয়ে তাদের নামী প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত। এই কাজটি করতে এগিয়ে আসতে পারে রাজ্য সরকার। যেমন ভাবে তারা বিভিন্ন জেলা থেকে মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের বেছে নিয়ে নিখরচায় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার প্রশিক্ষণ দেয়, এখানেও সেই মডেল অনুসৃত হতে পারে। এতে সর্বাধিক লাভবান হবে গরিব পরিবারের মেধাবী ছেলেমেয়েরা। এই সব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের ‘মেন্টর’ হিসাবে কাজে লাগানো যেতে পারে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পড়ুয়াদের, যারা ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে তাদের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেবে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে ‘মউ’ স্বাক্ষর করে স্কুলপড়ুয়াদের কিছু পরিকাঠামোগত সুবিধা ব্যবহারের সুযোগ করে দিতে হবে। এমন একটি সমান্তরাল মডেল রাখতে হবে দ্বাদশ-পাশ পড়ুয়াদের জন্যও। যারা প্রথম বারে সুযোগ পায়নি, তারা পরবর্তী কালে একটি নির্বাচনী পরীক্ষা পাশ করে যাতে সেই সুযোগ পেতে পারে।
সৌপ্তিক পাল, দাশনগর, হাওড়া
রাষ্ট্রধর্ম
সুলতানি আমলে (১২০৬-১৫২৬) রাষ্ট্রের প্রকৃতি কেমন ছিল, সে সম্পর্কে সুন্দর আলোচনা করেছেন কণাদ সিংহ তাঁর ‘আর মোগলদের আগে?’ (২২-৩) শীর্ষক প্রবন্ধে। এই সময়কালে বিভিন্ন বংশোদ্ভূত শাসক দিল্লিতে রাজত্ব করেছেন, তাঁদের মধ্যে গিয়াসুদ্দিন বলবনের মতো কঠোর শাসক যেমন ছিলেন, তেমনই অনেকে জনকল্যাণকর কাজের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন। আলাউদ্দিন খিলজি যেমন তাঁর বাজারদর নিয়ন্ত্রণ নীতির জন্য বিখ্যাত, ফিরোজ শাহ তুঘলক হাসপাতাল তৈরি, খাল নির্মাণ ইত্যাদি জনকল্যাণকর প্রকল্পের জন্য সুপরিচিত। জালালুদ্দিন খিলজি ছিলেন সমকালের তুলনায় উদারনৈতিক শাসক। তাঁর সংক্ষিপ্ত শাসনকালে পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন যে, রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে জনগণের সমর্থন। যে-হেতু ভারতের জনগণের একটা বড় অংশ হিন্দু, তাই রাষ্ট্র প্রকৃত অর্থে ইসলামীয় রাষ্ট্র হতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে দিল্লির সুলতানির মূল প্রকৃতি ছিল অভিজাততন্ত্র, যদিও সুলতানের নিজস্ব ক্ষমতা ও সৈন্যদলের উপর তার স্থায়িত্ব নির্ভর করত। সুলতানরা ইসলাম ধর্মের নিয়মগুলি অনুসরণ করলেও কখনওই সাধারণ জনগণের উপর ধর্মীয় নিয়ম চাপানো হত না, বা তাদের নিজস্ব ধর্মাচরণের উপর বিধিনিষেধ প্রয়োগ করা হত না। মুসলিম ধর্মগুরুদের রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে দেওয়া হত না। কথিত আছে যে, ইলতুৎমিসের সময়ে ধর্মগুরুদের একাংশ হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করতে চাইলে তাঁর ওয়াজ়ির বলেছিলেন যে, এই পদক্ষেপ বাস্তবসম্মত নয়, এবং রাষ্ট্রনীতি-সম্মতও নয়।
আলাউদ্দিন খিলজি একনায়কতান্ত্রিক শাসক ছিলেন। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, রাষ্ট্রের প্রয়োজনে তিনি সেটাই করবেন যেটা তিনি ঠিক মনে করবেন। সেটা মুসলিম নিয়ম অনুসারী না-ও হতে পারে। মুসলিম ধর্মগুরুদের সন্তুষ্ট রাখার জন্য বিচার ও শিক্ষা দফতর তাঁদের দেওয়া হত। অমুসলিম জনগণ ‘জিজিয়া’ নামে একটা কর দিতেন দিল্লির সুলতানদের, কিন্তু ব্রাহ্মণ-সহ গরিব মানুষ, মহিলারা অনেকেই এই কর থেকে ছাড় পেতেন। প্রথমে এই কর জমির রাজস্ব হিসাবে নেওয়া হত। যে-হেতু অধিকাংশ জমির মালিক ছিলেন হিন্দু, তাই তাঁদের এই কর দিতে হত। পরে ফিরোজ শাহ তুঘলক ব্রাহ্মণদের এই করের আওতাভুক্ত করেন, ও এই করকে আলাদা কর বলে নির্দিষ্ট করেন। স্থানীয় হিন্দু রাজারা সুলতানি আমলেও যথেষ্ট শক্তিশালী ছিলেন।
সুলতানি যুগে সাধারণ হিন্দু জনগণের জীবনে কোনও পরিবর্তন লক্ষ করা যায় না। ভারতের মধ্যযুগীয় গ্রামসমাজের উপর দিল্লির দরবারের সুলতানের পরিবর্তন কোনও প্রভাব ফেলত না। তবে হিন্দুসমাজের কঠোর জাতিভেদ প্রথার কারণে, এবং সুফি সাধকদের প্রভাবে, হিন্দু সমাজের কিছু মানুষ ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। কিন্তু দীর্ঘ মুসলিম যুগে ইসলাম কখনও রাষ্ট্রীয় ধর্ম হয়ে ওঠেনি। ফিরোজ শাহ তুঘলক শেষ জীবনে ধর্মগুরুদের সন্তুষ্ট করতে কিছু কঠোর ইসলামীয় বিধি চালু করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তিনিও রাষ্ট্রীয় নীতির ক্ষেত্রে ধর্মগুরুদের হস্তক্ষেপ করতে দেননি।
অতএব মুসলিম শাসকমাত্রেই অত্যাচারী ছিলেন— এই ধারণাটি আদৌ ঠিক নয়। বরং সুলতানি যুগ থেকে সমাজজীবনে যে একটা মিশ্র সংস্কৃতির জন্ম হয়েছিল, তাকে সকলের সম্মান জানানো উচিত। (তথ্যসূত্র: হিস্ট্রি অব মেডিইভাল ইন্ডিয়া, সতীশ চন্দ্র)।
দেবযানী চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা-৮৬