Democracy

সম্পাদক সমীপেষু: যোগ্যতার পরীক্ষা দিন

মানুষের মনে প্রশ্ন তৈরিই হয় না যে, এই ছদ্ম-রাষ্ট্রসেবায় দীর্ঘমেয়াদি উপকার হচ্ছে কি? ইতিউতি কিছু প্রশ্ন ভাসলে বা বিরুদ্ধকণ্ঠ উচ্চারিত হলে তাকে দমনের জন্য থাকে আলাদা প্রস্তুতি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৬ জানুয়ারি ২০২৫ ০৬:২০
Share:

সেমন্তী ঘোষ ‘একেই কি বলে গণতন্ত্র’ (৩১-১২) প্রবন্ধে যথার্থই বলেছেন, গণতন্ত্রকে দোষ না দিয়ে ক্ষমতালোভী ‘ডিমাগগ’ থেকে ‘টাইর‌্যান্ট’-এ পরিণত নেতাদের প্রশ্ন করার সময় এসেছে। এক জন নেতা তথা দল নির্বাচনের আগে নানা মনভোলানো প্রতিশ্রুতি দিয়ে গণতন্ত্রের সিঁড়ি বেয়ে ক্ষমতা দখলের পর প্রথমেই ছলে বলে কৌশলে সরকারি যন্ত্র ও সংবাদমাধ্যমকে নিজেদের আজ্ঞাবহ করেন। তার পর কিছু তোষামুদে দল তৈরি করে, মানুষের লোভ-লালসা, বিনা পারিশ্রমিকে কিছু পাওয়ার বাসনাকে উস্কে দিয়ে এবং সেই চাহিদার টুকরো টুকরো প্রাপ্তি ঘটিয়ে নিরন্তর নিজেদের মাহাত্ম্য প্রচারের মাধ্যমে জনমানসে মসিহা ভাবমূর্তি নির্মাণের চেষ্টা করেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই প্রচেষ্টা সফল হয়। বিশেষত ভারত-সহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে, যেখানে শিক্ষার হার অত্যন্ত কম এবং দারিদ্রের হার ও ক্ষুধাসূচক অত্যন্ত বেশি। মানুষের মনে প্রশ্ন তৈরিই হয় না যে, এই ছদ্ম-রাষ্ট্রসেবায় দীর্ঘমেয়াদি উপকার হচ্ছে কি? ইতিউতি কিছু প্রশ্ন ভাসলে বা বিরুদ্ধকণ্ঠ উচ্চারিত হলে তাকে দমনের জন্য থাকে আলাদা প্রস্তুতি। দিনের শেষে যখন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়ে মানুষের বোধ জাগ্রত হয় তখন শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ বা সিরিয়ার মতো ঘটনা ঘটে। যার শেষ পরিণতি কখনও ভাল নয়।

Advertisement

কিন্তু গণতন্ত্রের বর্তমান কাঠামো কতটা ত্রুটিমুক্ত, বিশেষ করে ভারতীয় উদার গণতন্ত্র? আশা ছিল যথার্থ গণতন্ত্রে ভয়মুক্ত, হিংসামুক্ত, লোভ-লালসামুক্ত, বিদ্যা-বুদ্ধি ও পরিশ্রমের প্রতি শ্রদ্ধাশীল পরিবেশে নির্দ্বিধায় নিজ নিজ মত পোষণ করা যাবে। কিন্তু শাসক ক্ষমতা দখলের পর গণতন্ত্রকে নির্বিষ করার স্পর্ধা দেখানোর সাহস পান গণতন্ত্রের গাঠনিক সীমাবদ্ধতার সাহায্য নিয়েই। কী সেই গাঠনিক সীমাবদ্ধতা যা গণতন্ত্রের দোষহীনতাকে প্রশ্ন করতে পারে? গণতন্ত্রের সাফল্যের মূল চাবিকাঠি হল— শিক্ষা, সততা ও নৈতিকতা। ভোটপ্রার্থী ও ভোটদাতা উভয়ের শিক্ষা, আদর্শ, বিচক্ষণতা ও প্রলোভনে বিচলিত না হওয়ার মানসিক কাঠিন্য সফল গণতন্ত্রের রসায়ন। অথচ গণতন্ত্রে শেষ কথা বলে সংখ্যা। আঠারো পেরোলেই মানুষ সেই সংখ্যা নির্মাণ করেন। প্রত্যেক মানুষের বৌদ্ধিক ও সামাজিক অবস্থান, দৃষ্টিভঙ্গি এবং তৎসঞ্জাত চাহিদা ও সন্তুষ্টি আলাদা আলাদা। কিন্তু সংখ্যার জোর সকলের সমান। গলদটা এখানেই। বহু বিতর্কের পরও ভারতীয় গণতন্ত্রে নির্বাচনে প্রার্থীর ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতার মান নির্ধারণ বা ‘পুলিশ ভেরিফিকেশন’-এর বাস্তবায়ন হল না, যেমন চাকরির ক্ষেত্রে হয়। তাই যে কেউ শুধুমাত্র সংখ্যার জোরে মসনদে বসতে পারেন। কোনও দল বা নেতা বিরোধী অবস্থানে থেকে এ বিষয়ে সরব হলেও ক্ষমতা পেলেই সব ভুলে যান। তাই সংখ্যার এই অপার মহিমাকে আতশকাচের তলায় আনা দরকার। এটা করা এমন কিছু কঠিন নয়। সত্যিকার গণতন্ত্রে নির্বাচন কি কখনও উৎসব হতে পারে? তা তো আসলে পরীক্ষা হওয়া উচিত।

তাপস মণ্ডল, নতিবপুর, হুগলি

Advertisement

প্রতিবাদেই আস্থা

অমিতাভ গুপ্তের লেখা ‘ঘরে ও বাইরে লড়াই’ (৩০-১২) প্রবন্ধ প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা। প্রবন্ধকার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, “পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি কি তবে পৌঁছে গেল এমন একটি স্তরে, যেখানে দুর্নীতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ও সর্বজনগ্রাহ্য হয়ে উঠেছে?”

তাঁর এই কথা মনে হওয়ার কারণ হিসাবে দেখিয়েছেন সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা উপনির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের বিপুল জয়। তবে, পাশাপাশি এ কথাটিও ভুললে চলবে না, আর জি কর কাণ্ডের পরেই এ রাজ্যের মানুষ যে ভাবে রাস্তায় নেমে দিনের পর দিন প্রতিবাদ করেছেন, সেই প্রতিবাদ কিন্তু কিছু অনুদানের পরিপ্রেক্ষিতে ভুলে যাওয়ার কথা নয়, বা এমনও নয় যে, শিক্ষক নিয়োগে পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতির কথাও সাধারণ মানুষ ভুলে গিয়েছেন। তবে, এ কথা সত্যি, শাসক পরিবর্তন করে ক্ষমতায় কাকে আনবে, তার দিশা আপাতত এ রাজ্যের মানুষের কাছে নেই।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর আদর্শে অনুপ্রাণিত এ রাজ্যের কিছু মানুষ কিছু কারণে বিজেপির হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতিতে প্রভাবিত হলেও বেশিরভাগ লোকই এই মানসিকতা একেবারেই মেনে নিতে পারেন না। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় থেকেই পশ্চিমবঙ্গের মানুষ জাত-পাত, ধর্ম-বর্ণ নিয়ে বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধেই সংগ্রাম করে এসেছেন। তাই বহু রকমের ঐকান্তিক চেষ্টা সত্ত্বেও হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার মনোভাব দ্বারা পশ্চিমবঙ্গের বেশির ভাগ মানুষকেই প্রভাবিত করতে পারেনি বিজেপি। এ জন্যই বাংলাদেশের ঘটনাকে সামনে রেখেও বিজেপি হিন্দু রাজনীতির সুর চড়া করতে চাইলেও বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি।

অন্য দিকে, দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকা বামফ্রন্টের শাসনের নমুনা তাদের পক্ষে শুভ নয়, তাদের সমর্থকরাও বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট বিব্রত। বর্তমানে কংগ্রেসের হাত ধরে আবার তাদের ক্ষমতায় ফিরে আসার রাজনীতিকেও বাম মনোভাবাপন্ন মানুষ সমর্থন করতে পারেননি। তাই দুর্নীতি, অপশাসন সত্ত্বেও তৃণমূলের পক্ষে বেশির ভাগ মানুষ ভোট দিয়েছেন। একে সেই অর্থে দুর্নীতিকে সমর্থন করা বলা যায় না।

বরং, আশার কথা হল মানুষ কিন্তু এখন নির্বাচনের চেয়েও প্রতিবাদের রাজনীতিতে আস্থা রাখতে চাইছেন। মানুষ চান সুবিচার, অন্যায়ের প্রতিবাদ। তাই আমার মনে হয়েছে যে, সাধারণ মানুষের অনেকেই বুঝেছেন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় অন্য দলকে আনলেই ন্যায়বিচার পাওয়া যাবে না, প্রতিবাদের রাস্তাতেই একমাত্র আসল ন্যায়বিচার পাওয়া সম্ভব। এই মানসিকতাই এখন পশ্চিমবঙ্গের বেশির ভাগ শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের মধ্যে কাজ করছে।

অনুরূপা দাস, পাঁশকুড়া, পূর্ব মেদিনীপুর

দাবির কারণ

শর্মিষ্ঠা দত্তগুপ্তের লেখা ‘কিছু যায় আসে না?’ (৩-১) প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা। মৃত্যুদণ্ড দিলেই অপরাধ প্রবণতা বন্ধ হয়ে যায় না, কিন্তু বিশেষ কিছু কারণের জন্য ক্ষেত্রবিশেষে মানুষের মন অপরাধীর কঠোরতম শাস্তির দাবি করে। প্রথমত, মানুষের মন থেকে এই বিশ্বাসই উঠে যাচ্ছে যে অপরাধীর যথোচিত শাস্তি হবে। দিনের পর দিন বিভিন্ন অপরাধে দোষীদের ছাড় পাওয়া দেখে বীতশ্রদ্ধ সাধারণ মানুষ। যদি বা শাস্তি হয়ও, সেটা হয় যাঁরা অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল তাঁদের ক্ষেত্রে। প্রভাবশালীরা নিশ্চিন্ত জীবন কাটিয়ে দিচ্ছেন। দ্বিতীয়ত, মানুষের মনে বঞ্চনার ক্ষোভ। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, চলার পথে প্রতি মুহূর্তে বঞ্চিত হতে হতে যে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়ে আছে মনে, তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে গণপিটুনি বা তাৎক্ষণিক কঠোর শাস্তির দাবির মধ্যে। এই মনোভাব থেকেই সাধারণ নিরীহ মানুষও সমর্থন করে ফেলেন প্রশাসনের আপাদমস্তক বেআইনি কাজ— ‘এনকাউন্টার’। অনেকেরই মনে থাকবে ২০১৯-এ হায়দরাবাদের কাছে এক পশু চিকিৎসককে গণধর্ষণ ও খুনের অভিযোগে ধৃত অভিযুক্তদের পুলিশি হেফাজতে গুলিতে মৃত্যুর অভিযোগে উত্তাল হয়ে ওঠে দেশ। বহু মানুষই এই ‘এনকাউন্টার’কে সমর্থন করেছিলেন।

দুঃখের বিষয়, সাধারণ মানুষ পুলিশের উপর ক্রমে ক্রমে আস্থা হারিয়ে ফেলছেন। সেই কারণেই প্রচুর নারী তাঁদের যৌন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগই করেন না, একটা হতাশা কাজ করে। এই হতাশা সমাজের পক্ষে অত্যন্ত বিপজ্জনক। সেই কারণেই লেখিকা জনশুনানিতে মহিলাদের যৌন-লাঞ্ছনার ঘটনার স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ প্রত্যক্ষ করেছেন। জঘন্য অপরাধের শাস্তি হিসাবে ফাঁসি সেরা পথ কি না সে বিষয়ে বিতর্ক থাকুক, তবে লেখিকা ঠিকই বলেছেন যে, ধৈর্য ধরে যৌন-লাঞ্ছনার ঘটনার কথা সম্মান দিয়ে শোনার মাধ্যমে সমাধানের সূত্র বার করার চেষ্টা অত্যন্ত জরুরি। নইলে ক্ষোভ জমতেই থাকবে।

সুরজিৎ কুন্ডু, উত্তরপাড়া, হুগলি

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement