Reservation

সম্পাদক সমীপেষু: বৈষম্য কমবে?

ভৌগোলিক ও পরিবেশগত কারণে সংরক্ষণের দরকার আছে অরণ্যাঞ্চলের আদিবাসীদের, উপকূলবর্তী বা পাহাড়ি এলাকার অনুন্নত অধিবাসীদের। যেমন সংরক্ষণের দরকার আছে বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০২২ ০৪:৪০
Share:

‘প্রশ্নগুলো কঠিন’ (সম্পাদকীয়, ১০-১১) সে দিনও ছিল না, আজও নয়। প্রশ্নগুলোকে কঠিন করা হয়েছে। সম্পাদকের মতে, সুপ্রিম কোর্ট উচ্চবর্ণের দরিদ্রের জন্য ১০ শতাংশ সংরক্ষণের সরকারি সিদ্ধান্তকে সমর্থন করায় সংরক্ষণ ব্যবস্থার ভিত প্রসারিত হয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আর্থসামাজিক নানা বৈষম্য ছিল। তখন সংরক্ষণের দরকার ছিল। দীর্ঘ ৭৫ বছরেও সে-সব বৈষম্য দূর হল না, উপরন্তু সংরক্ষণ সুবিধাবাদী রাজনীতির হাতিয়ার হয়ে উঠল, এবং আর্থসামাজিক বৈষম্যের ভিতকে গভীর ও বিস্তৃত করল।

Advertisement

এই চিরবৈষম্যকারী সংরক্ষণ ব্যবস্থার প্রয়োজন আছে কি? এক জন কর্মঠ, উদ্যোগী, সৎ মানুষকে পিছনে রেখে এক জন অলস, অদক্ষ, অসাধু মানুষ কী করে সরকারি চাকরি বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুবিধা পেতে পারেন— স্রেফ অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল হওয়ার জন্য, অথবা নিম্নবর্ণ হওয়ার জন্য? ভৌগোলিক ও পরিবেশগত কারণে সংরক্ষণের দরকার আছে অরণ্যাঞ্চলের আদিবাসীদের, উপকূলবর্তী বা পাহাড়ি এলাকার অনুন্নত অধিবাসীদের। যেমন সংরক্ষণের দরকার আছে বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের। কিন্তু সুস্থ, সবল, মানুষদের সংরক্ষণ কেন দরকার?

সম্পাদকের প্রশ্ন, “আর্থিক দুর্বলতা অর্থাৎ দারিদ্র যত তীব্রই হোক না কেন, তাকে কি সেই গোত্রের (জাতিপরিচয়ের কারণে সামাজিক বৈষম্যের শিকার) পশ্চাৎপদতা বলে গণ্য করা চলে?” প্রশ্নটি জটিল। যাঁরা সংরক্ষণ দাবি করছেন, তাঁরা এর ন্যায্যতার প্রমাণ দিচ্ছেন। তার দু’টি শর্ত, সামাজিক পশ্চাৎপদতা এবং দারিদ্র। উচ্চবর্ণ মানেই সামাজিক ভাবে অগ্রসর আর নিম্নবর্ণ মানেই অনগ্রসর, বর্তমানে তা বলা চলে না। ভারতে দারিদ্র যদি ২৫ শতাংশ হয়, তবে ১০ শতাংশ সংরক্ষণ অসঙ্গত, এবং তা নিয়েও ডিভাইড-অ্যান্ড-রুল শুরু হবে। সমস্যা এড়াতে সবার জন্য কাজের সুযোগ করে দিক রাষ্ট্র। শ্রমের সদ্ব্যবহার হোক। যোগ্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি হোক। তা হলেই সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা কমবে।

Advertisement

শুভ্রাংশু কুমার রায়, চন্দননগর, হুগলি

গরিবের পরিচয়

গত লোকসভা নির্বাচনের আগে মোদী সরকার উচ্চবর্ণের মধ্যে আর্থিক ভাবে দুর্বল (ইকনমিক্যালি উইকার সেকশন বা ইডব্লিউএস) শ্রেণির জন্য ১০% সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছিল। তার প্রেক্ষিতে শীর্ষ আদালতে ৪০টি মামলা হয়। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি উদয় উমেশ ললিতের নেতৃত্বে পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চের মধ্যে তিন জন বিচারপতি ‘ইডব্লিউএস’ কোটার পক্ষে রায় দিয়েছেন। তবে এই ১০% সংরক্ষণের শর্তগুলি দেখে তাজ্জব বনে গেলাম। বলা হয়েছে, ১) সংশ্লিষ্ট নাগরিকের পরিবারের বার্ষিক আয় ৮ লক্ষ টাকার কম হতে হবে, ২) ১০০০ বর্গফুটের কম মাপের ফ্ল্যাট বা বাড়ির মালিক হতে হবে। এ দেশে ৯৯৯ বর্গফুট ফ্ল্যাটের মূল্য নিশ্চয়ই সবারই জানা আছে। ওই ফ্ল্যাটে যাঁরা বাস করেন, তাঁরা কি দরিদ্র শ্রেণির? বার্ষিক আয় ৮ লক্ষ টাকা কতগুলি পরিবারের আছে? এই আয়ের মানুষ দরিদ্র হলে এ দেশে নিম্ন মধ্যবিত্ত, বা মধ্যবিত্ত কারা? দেখা যাচ্ছে, ১০% সংরক্ষণের নামে দরিদ্র নয়, মোটামুটি ভাল আর্থিক অবস্থার মানুষদেরই সুবিধা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সরকারের উচিত দেশে প্রকৃত দরিদ্রদের তালিকা তৈরি করে তাঁদের উন্নতির জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা।

কুমার শেখর সেনগুপ্ত, কোন্নগর, হুগলি

ভেলকিবাজি

সংরক্ষণের ভূত ভারতীয়দের মাথা থেকে যাচ্ছে না। আপাতদৃষ্টিতে কোনও কোনও জনগোষ্ঠীর অনগ্রসর হওয়ার কারণ জাতিভিত্তিক মনে হলেও, অর্থনৈতিক অনুন্নয়নই মূল কারণ। যে কোনও জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিক ভাবে শক্তিশালী হলে সামাজিক পশ্চাৎপদতা হ্রাস পেতে বাধ্য। সাম্প্রতিক কালে সংরক্ষণকে অনগ্রসরতার মোকাবিলায় ব্যবহার না করে, রাজনৈতিক হাতিয়ার করা হয়। চলতি সংরক্ষণ পদ্ধতি ভারতকে শক্তিশালী না করে ভিতরে ভিতরে শক্তিহীন করে তুলছে। একই পরিবারের সংরক্ষণ কোটার সুবিধায় উন্নতি (উচ্চশিক্ষা চাকরি ইত্যাদি পেয়ে) ঘটলেও পরবর্তী প্রজন্ম একে হাতিয়ার করে সুবিধা গ্রহণ করছে। তৃতীয়ত, সংরক্ষণের আওতায় না-থাকা মেধাবী ছাত্ররা প্রত্যাখ্যাত হয়ে হতাশাগ্রস্ত হচ্ছে। চতুর্থত, জাতিগত সংরক্ষণের কারণে ভারতীয় মেধার ‘ব্রেন-ড্রেন’ ঘটছে, যার সুফল বিদেশি সংস্থাগুলি লুটে নিচ্ছে। রাষ্ট্রের উন্নতির উদ্দেশ্য মাঠে মারা যাচ্ছে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে আর্থিক ভাবে দুর্বল, অসংরক্ষিত শ্রেণির উচ্চশিক্ষা এবং সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ সংরক্ষণের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তে সিলমোহর দিয়েছে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। ১২ জানুয়ারি, ২০১৯ এই সংরক্ষণের আইন আনে কেন্দ্র। কিন্তু সমালোচকরা অভিযোগ করেন, লোকসভা ভোটের আগে উচ্চবর্ণের মানুষকে খুশি করতেই কেন্দ্র এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সব দিক বিচার করে শীর্ষ আদালত কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষেই রায় দিয়েছে।

প্রচলিত জাতিগত সংরক্ষণ ব্যবস্থায় শিক্ষা এবং কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে তফসিলি জাতির জন্য ১৫%, তফসিলি জনজাতির জন্য ৭.৫% এবং অন্যান্য অনগ্রসর জাতি বা ‘ওবিসি’ ব্যক্তিরা পান ২৭% সংরক্ষণের সুবিধা। সেখানে উচ্চবর্ণের দরিদ্ররা বঞ্চিত হচ্ছেন। সুযোগের সাম্যের সৃষ্টির করবে সংরক্ষণের এই নতুন আইন।

তবে ভারতে সমস্ত প্রকল্প প্রান্তিক স্তরে এসে রাজনৈতিক ভেলকিবাজিতে প্রয়োগ হয়। যেমন, পশ্চিমবঙ্গে বিপিএল শংসাপত্রধারী (অন্ত্যোদয় প্রভৃতি কার্ডধারী) ব্যক্তিদের কারও কারও জীবনচর্যা দেখলে অবাক হতে হয়। রেশন দোকানগুলিতে আজও ২ টাকা কেজির চালের জন্য লাইন দেন লক্ষ টাকার বাইক-বিহারীরা! জনগণের অর্থনৈতিক মূল্যায়নটা যথাযথ ভাবে করা অত্যন্ত জরুরি। এ কাজটি সুপ্রিম কোর্টের তদারকিতে হতে হবে।

বরুণ মণ্ডল, রানাঘাট, নদিয়া

ভেদাভেদ

‘সংরক্ষণ পাবেন দরিদ্র উচ্চবর্ণেরা’ (৮-১১) সংবাদের প্রসঙ্গে বলতে চাই, সুপ্রিম কোর্ট কিন্তু রায়ের কোথাও ‘উচ্চবর্ণ’ বা ‘নিম্নবর্ণ’ শব্দগুলি উল্লেখ করেনি। যে-হেতু সাংবিধানিক ভাবে এ রকম কোনও উচ্চ-নীচ বর্ণ বিভাজন নেই, সুতরাং আইনত তা সিদ্ধ নয়। ঐতিহাসিক ভাবে ভারতে হিন্দু জাতির মধ্যে বর্ণপ্রথা ছিল, কিন্তু ‘উচ্চ’ বা ‘নিম্ন’ বর্ণের ধারণা— কারও কারও মনে থাকলেও, বাস্তবে কখনও ছিল না। আনন্দবাজার পত্রিকা-র মতো প্রথম শ্রেণির এক দৈনিকও মানসিক ভেদাভেদ থেকে মুক্ত সমাজ গড়ে তোলার চেষ্টা না করে, বরং তাতেই প্রচ্ছন্ন মদত দিলে সেটা দুঃখজনক।

শিখর রায়, কলকাতা-১৪৪

কবে হবে?

দেশের সংবিধানে তফসিলি জাতি ও জনজাতিভুক্ত ব্যক্তিদের ৭০ বছর সংরক্ষণের মেয়াদ ছিল। স্বাধীন ভারতের লক্ষ্য ছিল, তার মধ্যে দেশের ওই মানুষদের আর্থিক উন্নতি ঘটিয়ে সংরক্ষণ তুলে দেওয়া হবে। স্বাধীনতার ৭৫ বছরের আগে অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের সংরক্ষণ তুলে দেওয়া হল। কিন্তু ২০২০ সালে দেশের সরকার সংবিধানের ১০৪তম সংশোধন করে তফসিলি জাতি ও জনজাতিদের সংরক্ষণ ৮০ বছর করে দিল। ২০১৯ সালে ১০৩তম সংবিধান সংশোধন করে আর্থিক ভাবে পিছিয়ে থাকা মানুষদের ১০ শতাংশ সংরক্ষণের সুযোগ দেওয়া হয়। আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া তফসিলি জাতি ও জনজাতি ভুক্ত মানুষেরা এই সংরক্ষণের আওতায় কোনও ভাবেই আসতে পারবেন না। সুপ্রিম কোর্টও একে সমর্থন করল। এখন প্রশ্ন, কবে থেকে এই সংরক্ষণ পাবেন দেশের উচ্চবর্ণের দরিদ্ররা? আশা করি, এ বার খুব তাড়াতাড়ি এই সংরক্ষণ কার্যকর হবে।

শক্তি চট্টোপাধ্যায়, এক্তেশ্বর, বাঁকুড়া

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement