Damodar River

সম্পাদক সমীপেষু: ‘বাংলার দুঃখ’ নয়

বন্যার কুফল অপেক্ষা সুফল অধিক গুরুত্বপূর্ণ। তা সত্ত্বেও এখনও পাঠ্যবইতে দামোদরকে ‘বাংলার দুঃখ’ নামে বর্ণনা করা হচ্ছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৯ জানুয়ারি ২০২৫ ০৬:৩৩
Share:

কল্যাণ রুদ্রের ‘বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য’ (৮-১) প্রবন্ধ বিষয়ে কিছু কথা। প্রবন্ধকারের গবেষণা থেকে জানা গিয়েছে— পূর্বে দামোদর নদের বন্যার কারণে নিম্ন অববাহিকা অঞ্চল নতুন পলিসমৃদ্ধ হওয়ায় ও জলের জোগান পাওয়ায় কৃষিজ ফসল উৎপাদনে ভারতের শ্রেষ্ঠ অঞ্চলে পরিণত হয়েছিল। তার পরও ইংরেজরা এই নদের নাম দিয়েছিল ‘বাংলার দুঃখ’। প্রবন্ধকার আবার বলছেন দামোদরের বন্যার জলে প্রতি বছর জিটি রোড ও রেললাইন বিচ্ছিন্ন হত। অর্থাৎ, জনজীবন বিপর্যস্ত হত। এখন দেখার বিষয়, যদি দামোদরের জলে জনজীবন বিপর্যস্ত তথা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হত, তা হলে অবশ্যই দামোদরকে ‘বাংলার দুঃখ’ বলা যুক্তিযুক্ত। অন্য দিকে, প্লাবনের ফলে জল ও নবীন পলির সঞ্চয় কৃষিজ ফসল উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ। প্রবন্ধকার ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম অর্ধের কথা বলেছেন। যে সময় বন্যাকবলিত দামোদর অববাহিকা অঞ্চলের জনঘনত্ব এখনকার থেকে অনেক কম এবং অধিকাংশ মানুষ কৃষিজীবী ছিলেন। সে ক্ষেত্রে বন্যার কুফল অপেক্ষা সুফল অধিক গুরুত্বপূর্ণ। তা সত্ত্বেও এখনও পাঠ্যবইতে দামোদরকে ‘বাংলার দুঃখ’ নামে বর্ণনা করা হচ্ছে।

Advertisement

সময়ের দাবি মেনে আমার তিনটি প্রস্তাব— প্রথমত, যে-হেতু দামোদরের ইতিহাস জানা গিয়েছে, তাই পাঠ্যবইতে এখনও চলে আসা ‘বাংলার দুঃখ’ দামোদর— যুক্তিহীন এই বাক্য পরিবর্তন করা। বরং পশ্চিমবঙ্গের কৃষিতে দামোদরের ইতিবাচক দিক তুলে ধরে দামোদরকে ‘বাংলার সবুজ নদ’ বা এই জাতীয় নামকরণ করা প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, ভুরডুইনের পরিকল্পনা মাফিক যে তিনটি বাঁধ নির্মাণ করা যায়নি, তা ডিভিসি’র উদ্যোগে পরিকল্পনা মাফিক নির্মাণ করা। তৃতীয়ত, ডিভিসি’র অধীনে থাকা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি থেকে পরিবেশ দূষণের হার লাঘব করা।

এ কথা সত্য যে— উন্নয়নমূলক কাজ ও পরিবেশ ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িত। একটির বৃদ্ধি হলে অপরটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে প্রযুক্তির উপর ভর করে ও পরিবেশের সুস্বাস্থ্য বজায় রেখে উন্নয়ন সম্ভব। এ ক্ষেত্রে ডিভিসি, বনবিভাগ, দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ ও সরকারি উদ্যোগ একযোগে কাজ করলে দামোদরের ‘বাংলার দুঃখ’ নাম ঘুচবে।

Advertisement

নরসিংহ দাস, রবীন্দ্রনগর, পশ্চিম মেদিনীপুর

সমাধানের পথ

‘দামোদরের উপরে বাঁধ দেওয়ার পরিকল্পনা আজও অসম্পূর্ণ’ থাকায় রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের সভাপতি ও নদী-বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র তাঁর প্রবন্ধে কিছু জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে প্রথমে দরকার কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের সমন্বয়, সহযোগিতা, যার অভাবের অভিযোগ প্রবন্ধকার ‘চরম, অমানবিক, অবিবেচনা’ (২২-১০) শীর্ষক প্রবন্ধে করেছিলেন। শেষে লিখেছেন, এই কাজে ডিভিসি এগিয়ে আসুক, এটাই সময়ের দাবি। প্রসঙ্গত, এর আগে বন্যা পরিস্থিতি ও সেই সূত্রে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষোভের কারণে ডিভিসির সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। এ অবস্থায় ডিভিসির কাছে বরং রাজ্য সরকার এগিয়ে যাক। বিপদ তো পশ্চিমবঙ্গের, সমাধানসূত্র না মেলায় ফের রাজ্যবাসীর বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকবে।

পঞ্চাশের দশক। সংবিধান তৈরি হয়েছে। সেই সময় বাম সাংসদ নিকুঞ্জ বিহারী চৌধুরী সংসদে এই সর্বনাশের কথা তুলেছিলেন। তার ভিত্তিতে একটি কমিটি গঠন করা হয়। সেখানে থেকে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের প্রস্তাব জন্ম নেয়। এখন ২০২৫ সাল। দীর্ঘ ৭৫ বছর সাত শাখানদী মুণ্ডেশ্বরী, দামোদর দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। বাম আমলে ১৯৮২ সালে এই প্রকল্পের শিলান্যাস হয়। প্রকল্পের সূচনায় দুই মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ এলাকার সঙ্গে আরামবাগ মহকুমার খানাকুল, গোঘাট, আরামবাগের বেশ কিছু এলাকা ধরা ছিল। ২০১১ সাল এই মহকুমাকে প্রকল্প থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। সেচ দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, আর্থ-সামাজিক এবং বন্যার উৎসের কিছু পরিবর্তনের নিরিখে ২০১১ সালে নতুন মাস্টার প্ল্যান রচনার সময় আরামবাগ মহকুমা বাদ পড়েছে। আন্দোলনকারীদের দাবি, সত্তরের দশক থেকেই ভোটের সময় ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান রূপায়ণের কথা বলে রাজনৈতিক দলগুলি। এখন যদি আরামবাগ মহকুমা, অর্থাৎ হুগলি জেলার দক্ষিণ-পশ্চিম অংশ বাদ দিলে প্রকল্প করা হয়, তা হলে গোটা পরিকল্পনাই অর্থহীন হয়ে যাবে। মহকুমার অনেকের মতে, বাঁকুড়ায় বেশি বৃষ্টি হলে দ্বারকেশ্বর বা কংসাবতীর জল এসে আমোদর ও তারাজুলি খাল উপচে গোঘাটের দু’টি ব্লকের বিস্তীর্ণ এলাকা ভাসিয়ে দেয়। ঘাটালের শিলাবতী এবং ঝুমি নদীর জলের চাপে সেই জল নামতে পারে না। উল্টে জলের চাপ গোঘাট ছাড়াও আরামবাগের সালেপুর ২ পঞ্চায়েত, খানাকুল-২ ব্লকের ধান্যগোড়ি, জগৎপুর, মাড়োখানা এবং খানাকুল-১ ব্লকের ঘোষপুর, ঠাকুরানিচক পঞ্চায়েত এলাকা প্লাবিত করে। ১৯৫০ থেকে ২০১১, ষাট বছরে সমস্যা জটিলতর হয়েছে।

সাম্প্রতিক খবরে প্রকাশ, হাই কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ নির্দেশ দিয়েছে, দ্রুত সেচ ও জলপথ পরিবহণ দফতরের প্রধান সচিবকে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়ন নিয়ে রিপোর্ট দিতে হবে। গত লোকসভা ভোটের আগে আরামবাগের এক সভা থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেন, ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান রাজ্য সরকার একাই করবে। ওই সময়ে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের পক্ষ থেকে ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্প শুরুর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। প্রশ্ন, রাজ্য এগিয়ে না এলে কোনও দিন সমস্যা মিটবে? আরও প্রশ্ন, কেবল ঘাটাল বা আরামবাগ অঞ্চল-ভিত্তিক প্ল্যানের জায়গায় সমগ্র নদী অববাহিকা জুড়ে পরিকল্পনা করলে কেমন হয়? সমস্যা তো সবার। সেখানে প্রবন্ধকার বর্ণিত ছোট ছোট নদী, খাল, ছোট-বড় নদীবাঁধ সব থাকবে। প্রবন্ধকার প্রস্তাবিত বাঁধ থেকে কৃষির জন্য জল পাওয়া অনুযায়ী চাষের মরসুমের সংস্কার আসবে। আর ভারতীয় গণতন্ত্রে কেন্দ্র-রাজ্য সুসম্পর্ক থাকলে জল ছাড়ার আগামবার্তা কোনও সমস্যাই নয়।

শুভ্রাংশু কুমার রায়, চন্দননগর, হুগলি

সুচিন্তিত নীতি

অগ্নি রায়ের ‘অথ সঙ্কটলগ্নে উপনীত’ (৭-১) একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ। স্কুলে যখন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সঙ্গে কোনও কারণে ঝগড়া বা মন কষাকষি হত, তখন অন্য বন্ধুর সঙ্গে সখ্য বেড়ে যেত। এখন দেখছি বিভিন্ন দেশের মধ্যে সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। যুদ্ধ ও ধর্মীয় উত্তেজনায় বিধ্বস্ত পৃথিবীতে কিছু সমৃদ্ধশালী দেশ তাদের আখের গোছাতে ব্যস্ত। তারা আপন দেশকে অর্থ, ক্ষমতা, প্রতিপত্তির শীর্ষে নিয়ে যাওয়ার জন্য যখন যে দেশকে দরকার মনে করছে, সেই দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করছে। আর্থিক দিক দিয়ে দুর্বল, কম ক্ষমতাসম্পন্ন উন্নয়নশীল দেশগুলো শক্তিশালী বন্ধুকে পেয়ে ভুলে যাচ্ছে দীর্ঘ দিনের বন্ধু, নিয়ত সাহায্যকারী প্রতিবেশীর কথা। সেই ঘটনার প্রতিচ্ছবিই দেখছি এখন ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে।

অথচ, কিছু দিন আগেও দু’টি দেশ এক ছিল। ভারত সব সময় বাংলাদেশের প্রতি পরম বন্ধুর মতো হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। সহনশীলতা ভারতের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত ভারতের বৈদেশিক নীতি অত্যন্ত সুচিন্তিত বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক। পৃথিবীর সব দেশেরই তাদের প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সমস্যা রয়েছে সীমান্ত, শরণার্থী, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি হরেক রকম বিষয় নিয়ে। তেমনই ভারতেরও কিছু সমস্যা রয়েছে। কিন্তু অহেতুক অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর অভ্যাস ভারতের নেই। বৈদেশিক সমস্যা চিরকালীন সমস্যা, কখনও সেটা সহজ-সরল থাকে, আবার কখনও জটিলতর হয়। কূটনীতি, অভিজ্ঞতা, গভীর পর্যবেক্ষণ এবং সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করবে। ভারতের কান্ডারিকে শক্ত হাতে হাল ধরে রাখতে হবে।

গৌতম পতি, তমলুক, পূর্ব মেদিনীপুর

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement