পরন্তপ বসুর ‘সুস্থায়ী উন্নয়নের পথ’ (১৭-৭) শীর্ষক প্রবন্ধটি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই প্রাসঙ্গিক। উন্নয়ন বর্তমান দিনে অপরিহার্য। কিন্তু সুস্থায়ী উন্নয়ন কী? এক কথায় পরিবেশের ক্ষতি না করে যে উন্নয়ন। উন্নয়ন করতে গিয়ে যদি পরিবেশের ক্ষতি করা হয় তা হলে সেই উন্নতি কাম্য নয়। কেননা পরিবেশের ক্ষতি মানেই আমাদের ক্ষতি। এই জন্য বলা হয়ে থাকে যে, শিল্পবিপ্লব আধুনিক যুগের উন্নতির যেমন প্রধান হাতিয়ার, তেমনই বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণও। আজ পৃথিবীতে উষ্ণায়ন, বৃষ্টিপাতের স্বল্পতা কিংবা অতিবৃষ্টি বা অনাবৃষ্টি, আচমকা নেমে আসা প্রাকৃতিক দুর্যোগ— এ সবই পরিবেশ দূষণের ফল। কাজেই মানুষকে বেঁচে থাকতে হলে পরিবেশকে ভাল রাখা অপরিহার্য। এই জন্য শিল্পকেও হতে হবে পরিবেশবান্ধব। বিদেশে এই চেষ্টা অনেক আগে থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছে। আমাদের দেশেও এই প্রচেষ্টা বর্তমানে শুরু হয়েছে। যেমন— জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে ব্যাটারিচালিত যানের ব্যবহার। তাপবিদ্যুতের জায়গায় সৌরচালিত ও বায়ুকলের সাহায্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন ইত্যাদি। মূল কথা হল— কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ কমাতে হবে। এবং এর পাশাপাশি ব্যাপক হারে গাছ লাগাতে হবে। একটা কথা সকলকেই মনে রাখতে হবে, পরিবেশকে বাঁচানো কারও একার কাজ নয়। এটি সমষ্টির কাজ এবং সমষ্টির আন্দোলন। কাজেই সকলকে নিয়ে যদি ভাল ভাবে বাঁচতে হয়, পরিবেশকে ভাল রাখার উপর সবাইকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। প্লাস্টিকের অপব্যবহার সম্পর্কে চার পাশের সকলকে সচেতন করে তুলতে হবে। জলাশয়গুলিকে রক্ষা করতে হবে।
সর্বোপরি, সরকারি উদ্যোগ এবং সামগ্রিক জনসচেতনতা ছাড়া সুস্থায়ী উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই সরকারি স্তর তো বটেই, বিদ্যালয় স্তর থেকেও এই উদ্যোগ শুরু করতে হবে। নয়তো বিপদ শিয়রে।
অভিজিৎ দত্ত, জিয়াগঞ্জ, মুর্শিদাবাদ
জল চুরি
‘জল চুরির চেষ্টা’ (১৮-৭) শীর্ষক খবরটিতে চোখ আটকে গেল। নিতান্ত ছোট একটা খবর।যেখানে দেখা যাচ্ছে হাওড়ার একটি চক্র চার ইঞ্চির পাইপ দিয়ে ২০টি বাড়িতে অবৈধ ভাবে পদ্মপুকুর জল প্রকল্পের মূল পাইপলাইন থেকে সংযোগ দেওয়া হবে বলে টাকা তুলছিল স্থানীয় ভাবে। হাওড়া পুরসভা ও বটানিক্যাল গার্ডেন থানার পুলিশের সক্রিয়তায় তা বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে। তবে এই ঘটনা অনেক বিষয়কে আমাদের সামনে তুলে ধরছে।
বাংলার বুকে জল সংরক্ষণের ক্ষেত্রে পুকুর এক বড় উপাদান। ‘জল ধরো জল ভরো’ প্রকল্পের অধীনে সরকারি হিসাবে যে পরিমাণ পুকুর কাটানো হয়েছিল বাংলার বুকে, তা যদি ঠিকঠাক থাকত, জলসঙ্কটের চোখরাঙানিকে কার্যত পাত্তা দেওয়ার প্রয়োজন ছিল না। তা হল না। কারণ, পঞ্চায়েত স্তরে দুর্নীতি। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরলে দেখা যাবে, জল চুরির প্রবণতা সারা দেশেই কম-বেশি রয়েছে। দিল্লিতে এক সময় ওয়াটার ট্যাঙ্কার মাফিয়াদের বাড়বাড়ন্ত ছিল। অনেক বস্তি এলাকাতে জলের ট্যাঙ্কার লুট করা হত। কারণ, বস্তি এলাকার বহু মানুষ দিল্লিতে এক সময় পানযোগ্য জল পেতেন না। এক ট্যাঙ্ক জলের যা মূল্য সরকারি ভাবে ধার্য করা থাকত, তার থেকে প্রচুর বেশি টাকাতে সেই জল বিক্রি করা হত। বহু এলাকায় সরকারি জলের ট্যাঙ্ককে ঢুকতেই দেওয়া হত না। বিভিন্ন এলাকার রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় থেকে স্থানীয় কিছু মাফিয়া এই কাজগুলোর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিল। দিল্লিতে কেজরীওয়ালের সরকার আসার পর জল মাফিয়াদের একচেটিয়া আধিপত্যের কোমর ভেঙে দেওয়া হয়। সরকারের এই উদ্যোগে দিল্লির বহু মানুষ উপকৃত হয়েছিলেন।
মহারাষ্ট্রেও জল চুরির ঘটনা আছে। এলাকার নদীগুলো থেকে দিনের আলোতে চুরি হয় গ্যালন গ্যালন জল। আর সেই জল চুরি করে পাইপলাইন পথে যায় চিনিকলের কারখানাগুলোতে। চিনিকলের কারখানাগুলোর বেশির ভাগের মালিক রাজনৈতিক বড় নেতাদের আত্মীয়। চিনিকল চালাতে প্রয়োজন হয় আখের। আর সেই আখ চাষ করতে বাধ্য করানো হয় সাধারণ চাষিদের। তা সত্ত্বেও চাষিরা লাভের মুখ দেখেন না। কারণ দাদনিতে এঁরা বাঁধা থাকেন চিনিকলের মালিকদের কাছে। কাজেই চাষিদের হাতে লভ্যাংশ কোনও ভাবেই পৌঁছতে পারে না। বেশ কিছু বছর আগে এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর পরিবারের আত্মীয় মহারাষ্ট্রের নদীর বুকে এক রিজ়ার্ভার থেকে জল চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েন। তাতে তাঁর কোনও শাস্তি হয় না। এই রকম ঘটনা হাতে গুনে রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, তেলঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশের ব্যাপারেও বলে দেওয়া যাবে।
ভারতের বিদর্ভ এলাকার অনেক গ্রামে ‘জল রাজা’ নামের লোকের কথা শোনা যাবে। মূলত গ্রামের কয়েক ঘর ক্ষমতাবান লোক, যাঁরা পুরো গ্রামের জলের উপর কব্জা করে রেখেছেন। ধরা যাক, এক গরিব কৃষক তাঁর জমিতে সেচ দেওয়ার জন্য একটি ছোট পাম্প কিনেছেন, যে পাম্পের সাহায্যে মাটির সামান্য নীচ থেকেই জল তোলা যায়। এই ঘটনা দেখার পরে গ্রামের ওই ক্ষমতাবান লোকটি একাধিক গভীর নলকূপ বসিয়ে মাটির অনেক গভীর থেকে জল তোলা শুরু করলেন। আর সেই কাজে ক্ষমতাবান মানুষটির জমির পরিমাণ বেশি বলে ব্যাঙ্ক সহজেই তাঁকে লোন দিল। প্রচুর ভর্তুকিতে বিদ্যুৎও পেলেন তিনি। কাজেই কয়েক দিনের মধ্যেই দেখা গেল গরিব কৃষকের ছোট পাম্প দিয়ে আর জল উঠছে না। তাঁর মাঠে তখন ভর্তি ফসল। যে ফসল চাষের খরচ জোগাড় করতে মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়েছেন তিনি। কাজেই ফসল বাঁচাতে বাধ্য হয়ে আরও বেশি টাকা দিয়ে গরিব কৃষক জল রাজাদের কাছ থেকে জল কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। এক চিলতে জমির কৃষককে বাঁচতে তাই প্রতি দিন লড়াই করতে হয় রাষ্ট্রের সঙ্গে।
হাওড়ার জল চুরির ঘটনা ব্যতিক্রমী নয়। বাড়ি বাড়ি নতুন জলের লাইন দেওয়ার সময় পুর ও গ্রামীণ এলাকাগুলোতে কিছু অর্থের বিনিময়ে অবৈধ ভাবে ‘ফেরুল’ খুলে মেন লাইন থেকে জলের সংযোগ টানা হয়। এই ঘটনা বিভিন্ন এলাকাতে হামেশাই ঘটে। নিয়ম বহির্ভূত অতিরিক্ত জল গ্রাহক নেন। আবার মফস্সল এলাকাগুলোতে একটু রাতের দিকে কলের মুখে এক বিশেষ যন্ত্র লাগিয়ে মূল লাইন থেকে জল টেনে নেওয়া হয় অনেক জায়গায়। এই ধরনের অভিযোগ থানায় রিপোর্ট হয় না। জল চুরি ধরার মতো কোনও পরিকাঠামো গ্রামীণ এলাকায় থাকে না। সিএসই-র প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, সারা ভারতে ২০২১ সালে পরিবেশ বিষয়ক অপরাধের অভিযোগ জমা পড়েছে ১,৩৬,৬২১টি। ২০২০ সালে অভিযোগের সংখ্যা ছিল ৬৪,৪৭১টি। আর ৩৪,৬৭৬টি অভিযোগ জমা পড়েছিল ২০১৯ সালে। কাজেই বোঝা যাচ্ছে, পরিবেশকেন্দ্রিক অপরাধ ক্রমশ বাড়ছে। হাওড়ার জল চুরির অপরাধ সামনে আসার পর থানায় অপরাধীদের বিরুদ্ধে এফআইআর করা হয়েছে। কিন্তু অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ফাইনাল চার্জশিট কি আদৌ তৈরি হবে? আদালত পর্যন্ত কি আদৌ পৌঁছবে? পরিসংখ্যান বলছে, ভারতে লক্ষ লক্ষ পরিবেশ অপরাধের মাত্র ৫৯,২২০টি কেসের আদালতে ট্রায়াল চলছে। ২০২২ সালে প্রকাশিত ক্যাগ রিপোর্টে জানা যাচ্ছে, খাস পূর্ব কলকাতার জলাভূমি সম্পর্কিত ১০১টি অপরাধ রুজু হয়েছে ২০১৫ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে, যার সিংহভাগ অপরাধ আদালত পর্যন্ত পৌঁছয়নি। এমনই অভিযোগ করেছেন পরিবেশকর্মীরা।
জল আর পরিবেশকে বাঁচাতে হলে অবিলম্বে পরিবেশ আইনের সংশোধন করা প্রয়োজন। জলের অপচয় রোধ করতে প্রয়োজন প্রতি বাড়িতে জলের মিটার বসানো। আর এলাকা-ভিত্তিক নজরদারি কমিটি গঠন করা।
সুপ্রতিম কর্মকার, কৃষ্ণনগর, নদিয়া