সাহিত্যিক দেবেশ রায়ের লেখা সম্পর্কে পূর্ণেন্দু পত্রী বলেছিলেন, ‘‘আধুনিক বাংলা উপন্যাস ঠিক যে যে জায়গায় দুর্বল,... ঠিক সেইখানেই দেবেশের রাজকীয় আধিপত্য।’’ শঙ্খ ঘোষ বলেছিলেন, ‘‘আমাদের সময়ের শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক দেবেশ রায়।’’ দেবেশ রায়ের লেখায় বার বার ফিরে আসত উত্তরবঙ্গ। উত্তরের প্রতিটি কোণ ছিল তাঁর নখদর্পণে। একটি লেখায় লিখেছিলেন, ‘‘আলিপুরদুয়ার ও কোচবিহারের লাগোয়া অংশের নিসর্গের এই এক বৈশিষ্ট্য যে মাইল-দেড় মাইলের মধ্যেই দৃশ্য বদলে-বদলে যায়।’’
তাঁর লেখায় ছিল স্বকীয়তা, ব্যতিক্রমী ভাবনার ছাপ। নিজের লেখালিখি সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘‘সেকেন্ড ইয়ারে পড়তে-পড়তেই (১৯৫৩-৫৪) নিজের কাছে এটা পরিষ্কার হয়ে আসছিল যে আমি গল্পই লিখব। আমি খুব মন দিয়ে কোন সময়েই ভাবিনি— কী করে এটা নিজের কাছে পরিষ্কার হয়েছিল... গল্প উপন্যাসই কেন লিখলেন? এই প্রশ্নের কী উত্তর দেব? কখনো বলি কবিতা লিখতে পারি না বলে। কখনো বা একটু হেসে এড়িয়ে যাই...পাল্টা একটা প্রশ্নও আমার করতে ইচ্ছা করে, কিন্তু কখনোই করি না— কোন কবিকে কি জিগগেস করেন, কবিতাই কেন লিখলেন।’’
অরিন্দম ঘোষ
মাস্টারপাড়া, শিলিগুড়ি
তাঁর গল্পচিন্তা
দেবেশ রায় লেখার ধরন নিয়ে গভীর কল্পনা এবং একই সঙ্গে যুক্তিব্যাখ্যায় মেতে উঠতেন। এই সে দিন (৩০ এপ্রিল, ২০২০) তাঁর লেখা গল্প (‘গীতাল যুগীনের টেকনোলজি গ্রহণ’) পড়ে হোয়াটসঅ্যাপে লিখেছিলাম, ‘‘আপনার এ গল্প অনায়াসে উপন্যাস হয়ে উঠতে পারত।’’ উত্তরে লিখলেন: ‘‘ওটা কোনও উপন্যাসের প্রধান ব্যক্তি হতে পারত। কিন্তু, যদ্দূর মনে পড়ছে, তেমন উদ্দেশ্য ছিল না। একটু ঠাট্টা লুকোনো ছিল। আমার উপন্যাস-কল্পনা একটু গোলমেলে। উপন্যাসের পুরো সংগঠন দেখতে না পারলে লিখতে পারি না। আবার খুব ছোট ছোট নভেল লিখেছি। সেগুলো কেউ পড়েছেন বলে শুনিনি। ‘আমার কীর্তিরে আমি করি না বিশ্বাস’।’’
প্রশ্ন করেছিলাম, গল্প লিখতে লিখতে যদি উপন্যাসের ভাবনা লেখকের মাথায় আসে, সে ক্ষেত্রে করণীয় কী? উত্তর: ‘‘গল্প লিখতে লিখতে উপন্যাসের কল্পনা আসতে পারে, তা হলে গল্পের কল্পনাটা থেকে সরে এসে উপন্যাসের কল্পনাকে লালন করা ভাল। আমার এক বার এমন হয়েছে। দুটো কল্পনার সংগঠন সম্পূর্ণ আলাদা। এই সচেতনতা বাংলা লেখকদের সবেমাত্র দেখা দিয়েছে। এটা খুব ভাল লক্ষণ।’’
‘উপন্যাস নিয়ে’ বই লেখার কিছু দিন পর আবার একটা বই লিখলেন, ‘উপন্যাসের নতুন ধরনের খোঁজে’। পাঠককে বলতেন, ‘‘আগের বইটা পুরনো, ওটা নয়, পরের বইটা পড়ুন।’’ নিজের পুরনো লেখাকে খারিজ করে চিন্তার ক্রম-উত্তরণকে তিনি এ ভাবেই হাজির করতেন।
সূক্ষ্ম অনুভূতি ও বিচার ছাড়া যে সাহিত্যের মূল্যায়ন করা যায় না, তার প্রমাণ ও চিহ্ন উৎকীর্ণ হয়ে আছে দেবেশ রায়ের সাহিত্যে। পাঠক তৈরি হয়নি, গল্প পাঠের পদ্ধতি নিয়ে চর্চা গড়ে উঠছে না, এ নিয়ে বই লেখা হচ্ছে না— এমন আক্ষেপ নিয়েই তিনি বিদায় নিলেন।
শিবাশিস দত্ত
কলকাতা-৮৪
তিনি ও তিস্তা
দেবেশ রায়ের জন্ম বাংলাদেশের পাবনার বাগমারা গ্রামে। বড় হয়ে ওঠা উত্তরবঙ্গে। তিনি বলতেন, ‘‘দেশ বিদেশের কোথাও আমার বাড়ির হদিস করলে আমি জলপাইগুড়িই বলি। ম্যাপে জলপাইগুড়ি বের করা মুশকিল। আমি তাই পূর্ব হিমালয়ের নেপাল-সিকিম-ভুটানের ওপর আঙ্গুল চালাই।’’
উত্তর জনপদের মানুষজন, তাঁদের বাঁচার যুদ্ধ, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ তিনি প্রত্যক্ষ ভাবে উপলব্ধি করেছেন। এই অভিজ্ঞতা থেকে সৃষ্টি করেছেন ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’, ‘তিস্তাপুরাণ’-এর মতো ব্যাপ্ত ও বিস্তৃত আখ্যান। হয়তো অনেকের অজানা, তিনি শেক্সপিয়রের ‘রোমিয়ো অ্যান্ড জুলিয়েট’-এর অনুবাদ করেছেন। সে বইয়ের ভূমিকার প্রথম লাইন ছিল: ‘‘অবিরত অকারণ মৃত্যুর তাড়া খেতে খেতে আমাদের প্রজন্মের জীবন কাটল।’’
১৯৯০ সালে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারের জন্য ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’র সঙ্গে বুদ্ধদেব গুহ-র ‘মাধুকরী’ও মনোনীত হয়েছিল। দেবেশ রায়ের লেখা সম্পর্কে বুদ্ধদেব গুহ বলেছেন, ‘‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের যেমন ‘হোসেন মিঞা’, তেমনই তিস্তাপারের বৃত্তান্তের ‘বাঘারু’। অসাধারণ চরিত্র। ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ নিজগুণেই বাংলা সাহিত্যে চিরস্থায়ী আসন পাবে।’’
‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ যখন নাটক হিসেবে মঞ্চস্থ হয়েছিল, তখন তার মহড়ায়, এমনকি একাধিক শো-তেও দেবেশবাবু উপস্থিত ছিলেন। তাঁর রচিত আর এক উপন্যাস ‘সময় অসময়ের বৃত্তান্ত’ও মঞ্চস্থ করেছিলেন পরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায়।
তিস্তা সম্পর্কে দেবেশ রায় লিখেছেন, ‘‘তিস্তা পৃথিবীর যে কোনো নদীর সমস্পর্ধী। এ এক অদ্ভুত বৈপরীত্য। তিস্তা যখন আমাদের ঘরের সিঁড়িতে বা দরজাতেই তখন সে দৈনন্দিনের অংশ হয়ে যায়। সে আর অচেনা থাকে না। আর যখন সে অচেনা তখন আর সে দৈনন্দিন থাকে না, জলপাইগুড়ি শহর নিয়ে ও তিস্তা নিয়ে দৈনন্দিন আর অচেনার এই দ্বন্দ্ব আমার মিটল না।’’
সায়ন তালুকদার
কলকাতা-৯০
আগামী দিনের
জনপ্রিয় লেখক বলতে যা বোঝায়, তা হয়তো দেবেশ রায় নন। কিন্তু পাঠক সমাজে তিনি নেহাতই এক লেখক— এই অভিধাও তাঁর ক্ষেত্রে অপ্রযোজ্য। কোনও কোনও সাহিত্যিক জীবদ্দশায় হয়তো অনেক সংখ্যক পাঠক পাননি। মৃত্যুর পরে পেয়েছেন। অনেকটা সেই রকমই আগামী দিনের জন্য রয়ে গেলেন দেবেশ রায়ও।
রঘুনাথ প্রামাণিক
কালীনগর, হাওড়া
দুই মৃত্যু
ভাগ হয়ে গেছে তাঁদের দেশ। পাবনার বাড়ি ছেড়ে এক জন উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি, অন্য জন বসিরহাট থেকে পার্ক সার্কাস হয়ে খুলনা। পুব থেকে পশ্চিমে আর পশ্চিম থেকে পুবে। দু’রকম ভাবে বেড়ে উঠলেন দু’জন। ধর্মে ভাঙা দুই বাংলায় কথা বলে গেলেন নিরন্তর একই ভাষায়।
১৯৩৬-৩৭ বাংলার দুই প্রান্তে জন্ম আনিসুজ্জামান ও দেবেশ রায়ের। চলার পথে দেবেশ রায় দেশকে ভেঙে ফেলতে লাগলেন ক্রমশ, যে ভাঙন গড়ে তোলার অধিক। পরাক্রমী কলমে জীর্ণ করে দিলেন ধর্মের আবরণ— প্রশ্ন করলেন দেশকে, ফিরিয়ে দিলেন তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গের খরশান উত্তর। ভেঙে যাওয়া ‘দেশ’ তখন ভারতবর্ষের মানচিত্র বদলে দিয়েছে।
অন্য প্রান্তে সেই ভাঙন থেকেই উঠে আসছে আর একটা আত্মদেশ, সেই নতুন দেশের পক্ষে সওয়াল করছেন আনিসুজ্জামান। আরও পুবের দিকে যেতে যেতে তিনি খুঁজে পেলেন বাঙালি মুসলিমের আত্মপরিচয়।
দেবেশ নিম্নবর্গের মানুষকে করে তুললেন আখ্যানের নায়ক, চাঁদ মাথায় নিয়ে তাঁর ‘আকাট’ বাঘারু পার হয়ে যায় সীমান্ত, পিছনে পড়ে থাকে নিজেরই গ্রাম। কী তার ধর্ম? কোন ‘দেশ’ তার? সেই খোঁজ চলতেই থাকে।
আনিসুজ্জামান বললেন, ধর্ম পালনের অধিকার যেমন সকলের, ধর্ম না-পালনের অধিকারও তেমনই দিতে হবে মানুষকে। চোখে চোখ রেখে কথা চালালেন রাষ্ট্রের সঙ্গে।
বাঙালির ধর্মনিরপেক্ষ সম্প্রীতির খোঁজে দুজনেই পথ চললেন আজীবন।
বাংলা ভাষার স্বজন এই দুই মানুষ মৃত্যুদিনেও এক হয়ে রইলেন।
মননকুমার মণ্ডল
কলকাতা-৬৪
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।