এআইসিটিই মাতৃভাষায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানোর কথা ঘোষণা করেছে। হয়তো একটা বড় সংখ্যক পড়ুয়াকে এই ঘোষণা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্যে উৎসাহিত করবে, কিন্তু মোটের উপর লাভ হবে কি? সুমন্ত্র চট্টোপাধ্যায় ঠিক প্রশ্নটিই তুলেছেন (‘মাতৃভাষায় পড়াই সমাধান নয়’, ২৪-৮)। প্রতিটি ইঞ্জিনিয়ারের স্বপ্ন ভাল একটি সংস্থায় চাকরি, অথবা কোনও নতুন কোম্পানি গড়ে তোলা। সে ক্ষেত্রে তো মাতৃভাষা কাজে আসবে না। বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে কাজ করার ইচ্ছে থাকলে ভাল ইংরেজি না জানলে কতটুকু লাভ হবে? যদি অন্য দেশি কোনও সংস্থার সঙ্গে কাজ করার কথাও ধরা হয়, তা হলেও তো সেই ইংরেজি শেখা দরকার। ৪৪ শতাংশ ছাত্রছাত্রী জানিয়েছে, তারা মাতৃভাষায় পড়তে চায়। বেশ। কিন্তু তাদের কি নিজেদের ভবিষ্যতের জন্য কোনটা যথার্থ, সে ধারণা আছে? সে ধারণা তো আসে অভিজ্ঞতার সঙ্গে। এআইসিটিই-র হয়তো উচিত ছিল, যে ইঞ্জিনিয়াররা ভাল সংস্থায় কর্মরত, তাঁদের কাছে এই প্রশ্ন করা। হয়তো উত্তরটা পুরো আলাদা হতে পারত। লেখকের সঙ্গে সহমত হয়ে বলব, আমার নিজের পড়াশোনা এবং চাকরির ক্ষেত্রেও এমন অনেক বইয়ের সাহায্য নিতে হয়েছে, যেগুলি বিদেশি লেখকের। পড়ুয়ারা সেই সব বইয়ের সাহায্য কী ভাবে নেবে?
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন প্রয়োজনে, কর্মক্ষেত্র, উচ্চশিক্ষা, বিভিন্ন রাজ্য ও দেশের মানুষের সঙ্গে মেলামেশা, সর্বোপরি সব রকম গুরুত্বপূর্ণ কাজে ইংরেজির প্রয়োজন অনস্বীকার্য। বাংলা মাধ্যমের পড়ুয়াদের ইংরেজির ভিত নড়বড়ে। ঘাটতি মেটাতে স্পোকেন ইংলিশ কোর্স অথবা কর্মক্ষেত্রে সফট স্কিল ট্রেনিং নিলেও তা পূরণ হয়নি। দরকার, গোড়া থেকে ইংরেজিতে পঠনপাঠন। ইঞ্জিনিয়ারিং-এ তো অবশ্যই। এতে ছাত্রছাত্রীদের আত্মবিশ্বাসও বাড়বে। তবে মনে রাখতে হবে, ভারতে শিক্ষাঋণে সুদের হার অনেক উন্নত দেশের থেকে বেশি। এমনকি এ দেশের গৃহঋণের সুদও শিক্ষাঋণের থেকে কম। শিক্ষায় উৎসাহ দিতে জরুরি হল, সুলভে শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা।
সুমন চক্রবর্তী
বেঙ্গালুরু
অকারণ বিতর্ক
গত ২২ অগস্ট, ২০২১ রাজ্য সরকারের সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা নিয়ে অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। রাজ্যের বিরোধী দলনেতা এবং বামপন্থীদের তরফে বলা হচ্ছে, সরকারি প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন দেওয়ার নামে সরকারের গুণকীর্তন করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তব ঘটনা হল, যে কোনও রাজ্য সরকারের পরীক্ষায় সেই রাজ্যের প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন আসবে, সেটাই দস্তুর। তা ছাড়া ভবিষ্যতের সরকারি আধিকারিকরা রাজ্যের প্রকল্পগুলি সম্পর্কে কতটা ওয়াকিবহাল, সেটা দেখে নেওয়া সরকারের কর্তব্য। এটা ‘গুণকীর্তন’ নয়। রাজ্যের বিরোধী শক্তির আরও গঠনমূলক পদক্ষেপ প্রয়োজন। শুধুমাত্র বিরোধী বলেই যে কোনও কিছু নিয়ে রাজনীতি করার কোনও অর্থ নেই। সেটা আখেরে রাজ্যের ক্ষতি করে। প্রসঙ্গত, যাঁরা রাজ্য সরকারের প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন করার বিরোধিতা করছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই এটাও দেখে থাকবেন সেই পরীক্ষায় ‘নমামি গঙ্গে’ নিয়েও প্রশ্ন এসেছে। সেটি তো কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্প।
চন্দ্র মোহন নন্দী
কলকাতা-৭৮
বদলির বিষ
শিক্ষিকাদের বদলির বিক্ষোভে বিষপান, ও একই দিনে মহামান্য হাই কোর্টের নির্দেশে বদলি শিক্ষকদের চার সপ্তাহের ভিতর ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট’ দেওয়ার আদেশ— এই দুই সংবাদের ভিত্তিতে এই চিঠি। বদলির জন্য বিক্ষোভ অসুখটা অনেক পুরনো। কর্মজীবনে ও বাবা সরকারি আধিকারিক থাকার সুবাদে দেখেছি, প্রায় প্রত্যেক সরকারি কর্মচারীই (স্কুল হোক বা অন্য সরকারি বিভাগ) কোনও বদলিতেই খুশি হন না। অথচ, চাকরির ফর্ম ভরার সময় কার্যত দেখেই সই করি, যে কোনও জায়গায় প্রার্থী যেতে সদা প্রস্তুত থাকবেন। এটা বাধ্যতামূলক। পরিবার ছেড়ে যাওয়ার বিষয়টা বাদ দিলে যেটা কাজ করে, সেটা নতুন, অপরিচিত জায়গায় অজ্ঞাত কাজের চাপ আর মানিয়ে নিতে না পারার মানসিকতা। বহু জায়গায় কর্মচারীদের থাকা-খাওয়া সংক্রান্ত এমন অসুবিধা ও খরচের সম্মুখীন হতে হয় যে, কাজের চেয়ে ওই বিষয়গুলোই প্রধান হয়। বলা বাহুল্য, সামান্য ভাতা ছাড়া আর কোনও সাহায্য জোটে না। সরকারি চাকুরেদের মনে গেঁথে থাকে যে, বদলি হয় রাজনৈতিক কারণে, চাকরির শর্ত মেনে নয়। রাজনীতির খেলায় যে যত পোক্ত, তার বদলি তত কম। তাই অন্যত্র বদলি হলে বিপরীত দলের থেকে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ও বিলক্ষণ কাজ করে। বেশির ভাগ কর্মচারী বদলিকে তাঁর চাকরির অঙ্গ হিসেবে না ধরে শাস্তি হিসেবে ধরেন। নতুন জায়গায় ভাল কাজের উদাহরণ রেখে আসার মানসিকতা নেই বললেই হয়।
শিক্ষকতা মহিলাদের একটি আর্থিক ও সামাজিক নিশ্চয়তা এবং নিরাপদ চাকরি। এই চাকরিতে সর্বত্র পরিকাঠামোগত সাযুজ্য যেমন থাকে না, তেমনই সব শিক্ষকের সমান প্রশিক্ষণও থাকে না। ফলে, বদলিতে বিষপানের মতো চরম পথ বেছে নিতেও অনেকে দ্বিধা করেন না। সরকার তার প্রশাসনিক অস্ত্রকে অরাজনৈতিক ভাবে ব্যবহার করে যত দ্রুত এই পরিকাঠামোগত ও বিভাগগত ত্রুটিগুলোকে মেরামতের পাশাপাশি কর্মী স্বাচ্ছন্দ্য ও সুবিধার দিকটা নজরে আনবে, ততই এই রকম অবাঞ্ছিত ঘটনা এড়ানো যাবে।
অরিত্র মুখোপাধ্যায়
শ্রীরামপুর, হুগলি
সমন্বয়ের ভাবনা
আবাহন দত্তের ‘ধর্ম যার যার, প্রাঙ্গণ সবার’ (১৭-৮) লেখাটির মূল কথা, রক্তক্ষয়-উত্তর সমন্বয়ী ভালবাসা। ধর্মীয় সংঘাত ও রক্তক্ষয়ের ইতিবৃত্ত আরও পুরনো। সমন্বয়ী ভাবনাও রয়েছে সেখানে। সপ্তম শতাব্দীতে রাজা শশাঙ্ক বোধিবৃক্ষ কেটে দিয়েছিলেন। পুষ্যমিত্র অশোকের স্তম্ভ ধ্বংস করেছিলেন, যেমন তালিবানরা বামিয়ান বুদ্ধমূর্তি ধ্বংস করেছে। সাঁচীস্তূপে ভাঙচুর চালিয়েছিল এরাই। দিব্যাবদান-এ বৌদ্ধধর্মের উপর অত্যাচারী শাসকের কথা রয়েছে। কৌশাম্বীতে বৌদ্ধমঠ পুড়িয়েছে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা। সারনাথে ব্রাহ্মণ্যবাদের যে নিদর্শন, সেটি বৌদ্ধধর্মের মূল তোরণ ভেঙে তৈরি হয়েছিল গুপ্তযুগে। মথুরার ভূতেশ্বর মন্দির দাঁড়িয়ে আছে বৌদ্ধ-পীঠস্থানের ধ্বংসস্তূপের উপর। কলহনের রাজতরঙ্গিনী-তে বৌদ্ধমঠ ধ্বংসের কাহিনি রয়েছে। দশম শতাব্দীতে সহস্রাধিক বৌদ্ধমঠ ধ্বংসের কথা পাওয়া যায়। এই সংঘাতের ইতিহাস রয়েছে বাংলাতেও। ভারতে নয়, বৌদ্ধধর্ম বাইরে বিস্তার লাভ করল কেন? আর্য-আধিপত্যই মূল কারণ। তবে সমন্বয়েও বাধ্য হয়েছিল তারা। যেমন, ‘অহিংসা’ আর্যভাবনায় নয়, ছিল বৌদ্ধদর্শনে। স্বয়ং বুদ্ধ এখন বিষ্ণুর অবতার— মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন, পরশুরাম, রাম, বলরাম, বুদ্ধ, কল্কি ইত্যাদি। অর্থাৎ, ইসলাম-হিন্দু রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পর যে সমন্বয়ী ভালবাসার কথা এসেছে, তার ভিত অতীতেই অনুশীলিত। স্বাধীনতার পর ৭৫ বছর ভারতের সাধারণ মানুষ জাতি, বর্ণ, ধর্ম, ভাষা নিরপেক্ষে সেই সমন্বয়ী উৎসাহে গণতন্ত্রের রক্ষায় সমর্থন জানিয়েছে, সমন্বয়ী সমাজের স্বপ্ন দেখেছে। অর্থ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা-সমৃদ্ধ দেশ গড়তে চেয়েছে। দুর্ভাগ্য, প্রধান রাজনৈতিক শক্তিগুলি অতীত-সংঘাতের অপস্রিয়মাণ ক্ষোভগুলি দূর করতে উদ্যোগ করেনি, বরং প্রশ্রয় দিয়েছে ক্ষমতার অলিন্দে প্রবেশের। তাকে মুখ্য হাতিয়ার করছে আর এক দল শাসক। ধর্মের অনুশীলন নয়, ধর্মতন্ত্র গড়ে তুলছে। আইন, প্রশাসন ও বিচার বিভাগকে ধর্মতন্ত্রের একটি বাঁধনে বাঁধতে চাইছে। আমরা আশাবাদী, বিশ্বাস আছে মানুষের ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক মননে। ধর্মতন্ত্রীরা সুশাসক হতেই পারে না। ধর্মের নিয়মেই, কারণ “ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে, অন্ধ সে জন শুধু মারে আর মরে।”
মহীদাস ভট্টাচার্য
কলকাতা-৮৪