‘ক্ষতিপূরণ’ (২৫-১০) সম্পাদকীয়ের বক্তব্যটি যথার্থ। প্রত্যন্ত গ্ৰামের স্কুলে শিক্ষকতার সূত্রে বলতে পারি, অনলাইন শিক্ষা কখনওই শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার পরিপূরক হতে পারে না। এখন তো অষ্টম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীরাও নিজেদের বক্তব্য গুছিয়ে লিখতে পারছে না, নিজের নামের বানান, সাধারণ যোগবিয়োগ, রিডিং পড়া— কিছুই সঠিক ভাবে করতে পারছে না! আগের পড়াও বেমালুম ভুলে গিয়েছে। অধিকাংশই পড়াশোনার প্রতি যেন আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে! নিয়মিত স্কুলে আসতেও তাদের প্রবল অনীহা! এ বারের মূল্যায়নের দিনগুলোতেও অনেকে পুরোপুরি অনুপস্থিত থেকেছে, কেউ কেউ আবার কিছু পরীক্ষা দিয়েছে, কিছু দেয়নি। পরে পরীক্ষা না দেওয়ার কারণ হিসাবে শ্রাদ্ধবাড়ি, বিয়েবাড়ি, পুজো— নানা অজুহাত খাড়া করেছে। এমতাবস্থায় ছাত্রছাত্রীদের শ্রেণি উপযোগী করে গড়ে তোলা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কাছে রীতিমতো চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই শিক্ষাবর্ষে দেরি করে ক্লাস শুরু হয়েছে, তার উপর অযথা দীর্ঘায়িত হয়েছে গরমের ছুটি, অথচ সিলেবাস এতটুকু কমানো হয়নি। এক দিকে সিলেবাসের বহর, অপর দিকে ছাত্রছাত্রীদের অনাগ্রহ ও তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতার অবনমন, সিলেবাস শেষ করতে আমরা যেন হিমশিম খাচ্ছি। ভেবেছিলাম, শিক্ষা দফতর থেকে এ ব্যাপারে একটা গাইডলাইন পাব। কিন্তু শিক্ষাবর্ষ শেষ হতে চলল, তেমন কিছুই পেলাম না! আমার স্কুল প্রত্যন্ত গ্রামে, পুজোর ছুটিতে কিছু ছাত্রছাত্রী ক্লাস করলেও বেশির ভাগই করেনি, তাই ঘাটতি পূরণ পুরোপুরি সম্ভব হচ্ছে না। সামনেই ফাইনাল পরীক্ষা। সিলেবাস পুরোপুরি আয়ত্ত না করে ছাত্রছাত্রীরা যে পরীক্ষা দেবে, সেটা নিশ্চিত। সুতরাং ফলাফল কী হবে, অনুমান করে আমরা যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। এখন অভিভাবকরা ইচ্ছে করলে ছেলেমেয়েদের একই ক্লাসে দু’বছর রাখতে পারেন না। একটি ছেলে বা মেয়ে, যতই পড়াশোনায় দুর্বল হোক, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী তাকে পরের ক্লাসে তুলে দেওয়া হয়। ফলে ছাত্রছাত্রীরা ফাঁপা বিদ্যার ‘শিক্ষিত’ তকমাধারী নাগরিক হিসাবে সমাজে আত্মপ্রকাশ করছে। এতে সামাজিক বনিয়াদ যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে!
শুভ্রা সামন্ত, বালিচক, পশ্চিম মেদিনীপুর
শিক্ষায় কার্পণ্য
বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্য বিদ্যায়তনগুলিতে আর্থিক সঙ্কটের মোকাবিলার জন্য প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের কাছে সহযোগিতার আবেদন রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলিকে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎকর্ষ বজায় রাখতে উপাচার্যের অর্থসংস্থানের এই পদক্ষেপকে সমর্থন জানিয়ে সম্পাদকীয়ের (‘দৃষ্টান্ত’, ২৯-১০) সঙ্গে সহমত পোষণ করতে পারছি না। গত বছর কয়েক ধরে সরকারি শিক্ষালয়গুলিতে তীব্র অর্থসঙ্কট চলছে। কেবলমাত্র শিক্ষক ও কর্মচারীদের বেতন দেওয়া ছাড়া পরিকাঠামো উন্নয়ন, গ্রন্থাগার বা গবেষণার মতো আবশ্যক কাজকর্ম চালানো প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠছে। রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকার, কেউই যথাযথ দায়িত্ব পালন করছে না। নেহাত শিক্ষানুরাগী ছাড়া কে-ই বা তা করবেন? ভোট পিছয় না, অর্জিত ছাত্রবৃত্তির টাকা প্রায়ই পিছয়। নতুন বই বা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কত দিনে পাওয়া যাবে, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। আমলা বা করণিকবাবুদের টেবিল থেকে টেবিলে প্রাপ্যটুকুর জন্য ঠোক্কর খেতে খেতে কত প্রতিভা হতাশ হতে শুরু করে, তার খবর আমরা ক’জন রাখি। অন্য দিকে, আগ্রহী ও মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের কাছে বিদেশে অনেক সম্মানজনক ও অনুকূল পরিস্থিতিতে কাজ করার সুযোগ হাতছানি দিতে থাকে। আকাশ ফুঁড়ে-ওঠা আশ্বাস-সিক্ত ভাষণে ভোটের ঝুলি স্ফীত হতে পারে, কিন্তু একনিষ্ঠ তরুণ-তরুণীদের উদ্দীপনায় জ্বালানি সরবরাহে একেবারেই অক্ষম। অবহেলিত হওয়ার ক্ষোভ সেই শিক্ষাব্রতীদের যত দ্রুত সম্ভব বাধ্য করে বিদেশে পাড়ি দিতে। তাতে রাজনীতির কারবারিদের আপাতলাভে ব্যতিক্রম না ঘটলেও, ক্ষতিগ্রস্ত হয় এই দেশের কোটি কোটি গরিব ও সাধারণ মানুষের স্বার্থ। অবহেলিত শিক্ষাক্ষেত্রের এই জগদ্দল সমস্যার প্রকৃত ক্ষেত্র নির্ধারণ করেও উল্লিখিত সম্পাদকীয়তে পাকাপাকি সমাধানের আলোচনায় এক চটজলদি পথের কথা বলা হয়েছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের ‘দৃষ্টান্ত’ অনুসরণ করে এ রাজ্যের বাদবাকি বিদ্যায়তনের অধিকর্তারাও যদি তাঁদের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের দিকে প্রত্যাশার ঝুলি এগিয়ে ধরেন, তাতে তাঁদের প্রতিষ্ঠানেরও প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান হবে, সম্পাদকীয়ের সঙ্গে সুর মিলিয়ে এমন বলা যায় না।
ওই দিনের কাগজেই একটি সংবাদ প্রতিবেদনে (‘যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থকষ্টে সরব বিরোধীরা’) বলা হয়েছে, দেশ এবং বিদেশের বিভিন্ন নামকরা সংস্থার সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গরিষ্ঠ সংখ্যক প্রাক্তনীদের মেধাকৌলীন্য সারা পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত। স্বাভাবিক ভাবেই সেই শিক্ষক-গবেষকরা সারা বিশ্বে উপযুক্ত পদে অধিষ্ঠিত। আহ্বান পেলে তাঁরা এই প্রাক্তন বিদ্যায়তনের জন্য আর্থিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবেন, সেটাই স্বাভাবিক। অন্য অনেকের পক্ষেই সে আশা দুরাশা। র্যাঙ্কিং-এর দিক থেকে একটু পিছিয়ে থাকা প্রতিষ্ঠান থেকে বেরোনো ছাত্রছাত্রীদের অনেকের পক্ষেই একটা সম্মানজনক উপার্জনের পথ বার করতে নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। সহযোগিতার ইচ্ছে থাকলেও সীমাবদ্ধতা বর্তমান, এবং তা ক্রমবর্ধমান। অনেকের পক্ষে অসুবিধা, এমন একটি বিচ্ছিন্ন উদাহরণ কখনওই সকলের ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হিসেবে পরিগণিত হতে পারে না। যাদবপুরের অনুসরণে যাঁরা আর্থিক সঙ্কটের সুরাহার পথ খুঁজতে পারবেন না, তাঁরা পিছনেই পড়ে থাকবেন চিরকাল। এ ভাবে ভাবা অযৌক্তিক।
কেউ বলছেন, কোভিডের কারণে বিশ্ব জুড়েই শিক্ষাক্ষেত্রে আর্থিক সঙ্কট রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, সরকারি শিক্ষাক্ষেত্রে অর্থাল্পতার এই ব্যাধি ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে অন্তত শুরু হয়েছে কোভিডকালের অনেক আগে। মূল সমস্যা আর্থিক অপ্রতুলতা নয়। শিক্ষার বিষয়ে প্রয়োজন রাজনীতির প্রভাবমুক্ত স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি এবং প্রাথমিক গুরুত্ব আরোপ করে তার যথাযথ রূপায়ণ। এ ব্যাপারে কুণ্ঠিত হলে আজ ক্ষতি, আগামী কাল সর্বনাশ।
বিশ্বনাথ পাকড়াশি, শ্রীরামপুর, হুগলি
শিক্ষকের কাজ
সম্পাদকীয় ‘দায়িত্ববোধ’ (২৯-১০) পড়ে মন ভাল হয়ে গেল। সত্যিই এখন শিক্ষা পণ্যে পরিণত হয়েছে। স্কুল নয়, প্রাইভেট টিউশনির উপর ভরসা সব ছেলেমেয়ের। শিক্ষকদেরও (অবশ্যই সবাই নন) স্কুলে পড়ানোর চেয়ে প্রাইভেট টিউশনির প্রতি বেশি মনোযোগ। তার উপর অঢেল ছুটি। দু’বছর লকডাউনের জন্য ছেলেমেয়েরা এমনিতেই পিছিয়ে গিয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গ্রামাঞ্চলে বা যাদের বাড়িতে পড়াশোনা দেখানোর কেউ নেই, অর্থাৎ প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থী, তারা কী ভাবে পড়া রপ্ত করবে, তার জন্য কোনও চিন্তা নেই। সরকারও জনপ্রিয়তা বাড়াতে অগাধ ছুটির ব্যবস্থা করে দিচ্ছে! এর মধ্যে গোপালনগর চৌবেড়িয়া দীনবন্ধু বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রচেষ্টা প্রশংসনীয়। শিশুর সার্বিক উন্নতি শিক্ষকের হাতেই হয়। তার সুস্থ মানসিকতা তৈরির দায়িত্বও শিক্ষকদেরই। তাই ভুললে চলবে না, আর পাঁচটা পেশার থেকে শিক্ষকতা আলাদা। শুধু পেশার তাগিদে পড়িয়ে বেতন নেওয়াই একমাত্র কাজ নয়। ছাত্রদের সমস্ত ত্রুটি-দুর্বলতা দূর করে স্বাধীন চিন্তাধারার বীজ বপন করা, সুস্থ মানসিকতার অধিকারী করে তোলাই তাঁদের কাজ।
সর্বানী গুপ্ত, বড়জোড়া, বাঁকুড়া