সম্প্রতি জাতীয় শিক্ষানীতি, অ-হিন্দিভাষী অঞ্চলে হিন্দি ভাষা চালু করার প্রস্তাব ও সর্বোপরি বাংলা ভাষার হালহকিকত নিয়ে বেশ কিছু আলোচনা সম্পাদকীয় ও পাঠকদের কলম থেকে উঠে এসেছে।
রাজীব গান্ধীর আমলে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করার ব্যাপারে বিষয়টি কেন্দ্র-রাজ্য যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত হবে, এমনটাই কথা হয়েছিল। কিন্তু এ নিয়ে বিস্তর সমালোচনা হয়েছে। বিশেষত, পশ্চিমবঙ্গ ও তামিলনাড়ুতে শিক্ষানীতি রাজ্যের দ্বারা প্রস্তুত হবে, এমন ধারণায় তারা অনড় অবস্থানে ছিল ও এখনও আছে। হিন্দিকে সারা ভারতে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চালু করার বিষয়টি অনেক রাজ্যই মেনে নিতে পারেনি, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গ ও তামিলনাড়ু। ইংরেজি ভাষার ব্যাপক চাহিদার কথাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বহু ভাষাভাষীর দেশ ভারতবর্ষে চাকরির ক্ষেত্রেও নানা রকম কার্যক্রমে ইংরেজি কার্যকর ভাষা। এ রাজ্যেও কিন্তু ইংরেজি ভাষার কদর বেশি। পশ্চিমবঙ্গে পড়াশোনা করার জন্য বাংলা মাধ্যম স্কুল থাকলেও পড়ুয়ারা শেষে হিন্দি বা ইংরেজিরই দ্বারস্থ হয়। সরকারি কাজকর্মের জন্যও বাংলা ভাষা এখনও পুরোপুরি চালু করা যায়নি।
কেবল কিছু ব্যতিক্রমী মানুষ আছেন, যাঁরা অন্য ভাষায় পারদর্শী হয়েও বাংলা ভাষার মর্যাদা রাখতে জীবন পণ করে বসে আছেন। ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই তাঁদের। বাংলা যেন প্রাণের ভাষা হিসেবে গড়ে ওঠে। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার সেন বা দীনেশচন্দ্র সেন-এর গবেষণা যেন বিফলে না যায়।
বাসুদেব সেন
বাণীপুর, উত্তর ২৪ পরগনা
বিভেদ কেন
মানুষের নিজস্ব সত্তা প্রকাশের অনেক উপায় থাকলেও, ভাষার বন্ধন সহজ এবং শক্তিশালী। এখানে বৈপরীত্য অনুভূত হয় না, যদিও ভাবনাচিন্তা এবং ধর্মমতের ভিন্নতা থাকে। ভাষা এমন এক শক্তি, যা দেশের মানুষের মধ্যে জাত্যভিমান এনে দেয় এবং একে অপরের প্রতি একাত্ম করে তোলে।
ভারতের ক্ষেত্রে এই চিত্র ভিন্ন। এখানে সরকারি ভাবে স্বীকৃত আটাশটি ভাষা আছে। খুব স্বাভাবিক ভাবে একটি ভাষার মানুষ অন্য ভাষার মানুষের থেকে আলাদা। কিন্তু তারা ভাষার মাধ্যমে পৃথকীকরণ করে নিজেদের মধ্যে একটা দেওয়াল গড়ে তোলে। সর্বদাই উৎসাহী থাকে ভিন্ন ভাষার লোকেদের কোথায় কী দোষ-ত্রুটি আছে, তা খুঁজতে। অপর ভাষার লোকের সম্বন্ধে কটূক্তি বা অশ্রদ্ধার ভাব অনেক ক্ষেত্রে আমাদের একাত্মবোধকে দুর্বল করে, বিভেদের দরজা খুলে দেয়। কর্মক্ষেত্রে এই বিভেদের দৃষ্টান্ত যথেষ্ট তীব্র, বিশেষ করে যেখানে ভাষার ভিত্তিতে লবি সৃষ্টি হয়ে থাকে।
আনন্দ মুখোপাধ্যায়
কলকাতা-২৯
বাংলা বাঁচাও
‘ঝকঝকে বাংলা’ শীর্ষক চিঠিটি (২২-৪) অবাক করল। পত্রলেখক বলেছেন, “এখনকার ঝকঝকে ছেলেমেয়েরা সঠিক ব্যবহারে বাংলা ভাষাকে আরও ঝকঝকে বানিয়ে দেবে।” তিনি পরামর্শ দিয়েছেন— এখনকার স্মার্ট ছেলেমেয়েদের মাথার মধ্যে ভাষাগত বিষয়ের কূটকচালি না ঢোকালেই ভাল। বাংলা ভাষার কোনও অবনতি হয়নি। এবং অভিযোগ, বাংলা বলার সময় ইংরেজি শব্দের ব্যবহার নিয়ে মশকরার কোনও মানে হয় না। এ প্রসঙ্গে সবিনয়ে কয়েকটি কথা নিবেদন করি। এক, আমি যেতে পারি, ‘বাট’ সে যাবে না বলেছে। ‘বিকজ়’ অফিসে তার ‘হ্যাভক’ কাজের চাপ— অনাবশ্যক ইংরেজি শব্দগুলি কেমন লাগে শুনতে? দুই, খুব সুন্দর বা ভারী মিষ্টি-র বদলে ‘ভীষণ সুন্দর’, ‘ভীষণ ভাল’ শব্দবন্ধ যথার্থ তো? তিন, ‘ট্রেন টির’ যাত্রাপথে, কিংবা ‘বন্ধু কে’ বলে দিস, বা ‘বিশু দা’ আসবে বলেছে ইত্যাদি শব্দ এ ভাবে ভেঙে লিখলে ভাল লাগে? চার, চিঠিপত্রে, দেওয়াল লিখনে, দূরদর্শনে, পত্রপত্রিকায় প্রায় সর্বত্রই যে সব বাংলা বানান লেখা হচ্ছে, তা কি দৃষ্টিদূষণ ঘটাচ্ছে না? না কি এটাও সহজ সরলীকরণ হবে এ ভাবেই— বক্তা বা লেখক যেটা বলছেন বা লিখেছেন, তা বোঝা গেলেই হল। আমাদের প্রিয় ভাষা বাংলাকে বাঁচানোর লক্ষ্যে লড়াই-আন্দোলনের অর্থ ‘আগডুম-বাগডুম ব্যাপার’ নিয়ে অকারণ মাথা ঘামানো বা সময় নষ্ট, এ-হেন মানসিকতাও বাংলা ভাষার অবনমনের অন্যতম কারণ। আজকের ‘ঝকঝকে যুব-সমাজ’ যারা সাধারণ ভাবে বাংলা ভাষাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে বেশ আনন্দ পায়, তারা এই ভাষার কী মঙ্গল ঘটাবে, তা ভেবে দেখতে অনুরোধ রইল।
শক্তিশঙ্কর সামন্ত
ধাড়সা, হাওড়া
অবহেলিত ভাষা
‘শুধু গরিব মানুষের ভাষা’ (২৪-৪) শীর্ষক প্রবন্ধে সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায় খুব সুন্দর ভাবে বলেছেন, কী ভাবে বিগত চল্লিশ বছরে বাংলা ভাষা অবহেলিত হতে হতে শুধু গরিবের ভাষায় পরিণত হয়েছে। গরিবের ভাষা হওয়া দোষের নয়, কিন্তু একটা পাপ ঘটিয়েছে উচ্চাকাঙ্ক্ষায় প্রতিষ্ঠিত ইংরেজি-হিন্দির আধিপত্য। আধিপত্যবাদীরা বাজারের লোভ দেখিয়ে হিন্দির গা-জোয়ারি প্রতিষ্ঠা করে চলেছে আর চকচকে রুপোর জালে ধরা দিতে বাধ্য হচ্ছে বাংলার দক্ষ সিনেমা-নির্মাতা থেকে শিল্পীরা। দুঃখী বাংলার বাজার দুবাই পর্যন্ত প্রসারিত নয় যে। সিনেমার প্রবল প্রভাব অবহেলার বিষয় নয়।
কিন্তু গত চল্লিশ বছরে বাংলা বইয়ের বাজার সঙ্কুচিত হয়নি। নতুন নতুন কবি, সাহিত্যিক এসেছেন, প্রকাশক এসেছেন, ডিজিটাল-বইয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হাতে-ধরা বই প্রকাশিত হয়ে চলেছে। পাঠক না থাকলে এত বই প্রকাশিত হয় কী ভাবে? বইমেলা নিয়মিত হয়ে চলেছে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে। বই কি একটি ভাষার প্রাণের লক্ষণ নয়? অনেক মধ্যবিত্ত বাঙালি নিজের টাকায় বই প্রকাশ করেন এই ঘটনা মেনে নিয়েও বলা যায় যে, প্রকাশকরা এখনও ভাল বই কিংবা পুরনো বইয়ের নতুন সংস্করণ প্রকাশ করতে আগ্রহী।
বাংলা সংবাদপত্রের সংখ্যা এবং প্রসার বেড়েছে। টেলিভিশনের সঙ্গে চরম প্রতিদ্বন্দ্বিতা সত্ত্বেও ভাল সংবাদপত্রের বিক্রি সম্ভবত কমেনি। বাংলা ভাষা যে বেঁচে আছে, তার একটি জ্বলন্ত প্রমাণ সংবাদপত্রের চাহিদা।
একই সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে আছে বাংলা থিয়েটার। আছে বাংলা লোকনাটক, লোকগান। লোকগানের চাহিদা বেড়েই চলেছে। বাংলা সিনেমাও নিজেকে জীবন্ত রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সরকার যদি এদের মদত দেয়, ভাল হয়। হিন্দি সিনেমার প্রতি অমোঘ টান থেকে দর্শকদের ফেরাতে হবে বাংলা সিনেমায়।
চল্লিশ বছর আগে অনেক মেধাবী ছাত্রছাত্রী বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করে উচ্চপদে আসীন হয়েছেন। তাঁরা কিন্তু ইংরেজি ভাষাতেও খুব দক্ষ ছিলেন। বাংলাকে তখন হেনস্থার চোখে দেখা হত না। বাংলা পড়লে অবধারিত ব্যর্থ হবে, এমন মিথ্যে প্রচারের ঢক্কানিনাদ ছিল না। অনেক খ্যাতনামা অধ্যাপক, শিক্ষক, উচ্চপদের আধিকারিক নিজের চেষ্টায় ইংরেজি লিখতে এবং বলতে কারও চেয়ে কম ছিলেন না। এখন রাজ্যের কাজের ভাষা বাংলা হলেও উচ্চপদে যাঁরা অধিষ্ঠিত, তাঁদের অধিকাংশই ফাইলে বাংলা নোট বা মন্তব্য লিখতে পারেন না। এর দায় কার?
এ কথা অনস্বীকার্য যে, আজকের দুনিয়ায় বিশ্বায়নের সৌজন্যে ইংরেজি শিখতেই হবে। কিন্তু ভারতে হিন্দি শেখার বাধ্যবাধকতা থাকবে কেন? কেন্দ্রীয় সরকার ‘তিন ভাষার সূত্র’ কি মানবে না? গায়ের জোরে বলা হচ্ছে, হিন্দিতে কাজ করতে হবে, কথা বলতে হবে।
লেখকের প্রবন্ধে বাংলা ভাষার অধোগতি নিয়ে যে হতাশা প্রকাশ পেয়েছে, তা থেকে পরিত্রাণের উপায় নিয়ে ভাবার সময় এসেছে এ বার। যা-ই হোক, বাংলার সচেতন জনগণকে প্রতারিত করার ছল ভাঙতে হবে বাংলা ভাষার শক্তি দিয়েই। ভাবতে হবে, কেন এখনকার ছেলেমেয়েরা বাংলাকে এমন অবহেলা করছে?
তরুণ কুমার ঘটক
কলকাতা-৭৫