দেশভাগের স্মৃতি ভোলা কঠিন, মনে করা হয়তো আরও বিপজ্জনক। —ফাইল চিত্র।
নিখিল সুরের ‘যে বেদনা আজও অমলিন’ (রবিবাসরীয়, ১৩-৮) স্মৃতিভারে নিমজ্জিত এক বিষাদ-কথা। নীরবতা এবং কথা, স্মৃতি ও বিস্মৃতি, ব্যথা ও আরোগ্য— এই নিয়েই গড়ে ওঠে স্মৃতির বয়ান। দেশভাগের স্মৃতি ভোলা কঠিন, মনে করা হয়তো আরও বিপজ্জনক। তাই অবদমন থাকে যেমন ব্যক্তির মনে, তেমনই সরকারি, বেসরকারি ভাষ্যেও। উর্বশী বুটালিয়া লিখেছেন, এক কোটির অধিক মানুষ বিতাড়িত, গৃহহীন, দশ লক্ষেরও বেশি নিহত, পঁচাত্তর হাজারেরও অধিক নারী ধর্ষিত— দেশভাগের এই বাস্তব মনে করা কঠিন হলেও এর উদ্ঘাটন জরুরি (দি আদার সাইড অব সাইলেন্স)।
স্মৃতি যদি হয় অতীতে সংঘটিত ঘটনার পুনরুদ্রেক, তা হলে স্মৃতি কি ইতিহাসের ‘গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ’-এরই একটি অংশ, যা কাটছাঁট করে প্রকৃত ইতিহাস গড়ে ওঠে? ইতিহাসবিদ রণজিৎ গুহ আনন্দবাজার পত্রিকা-য় এক সাক্ষাৎকারে (১৫ অগস্ট, ২০০৭) বলেছিলেন, “স্মৃতি এমনিতে মিথ্যেবাদী। যত সময় যায় যে কোনও ব্যক্তির স্মৃতিতেই মিথ্যের ভারে সত্য চাপা পড়ে যেতে পারে।” এর কাছাকাছি ধারণার কথা বলেছেন রণবীর সমাদ্দার তাঁর মার্জিনাল নেশন: ট্রান্সবর্ডার মাইগ্রেশন ফ্রম বাংলাদেশ টু ওয়েস্ট বেঙ্গল গ্রন্থে। তাঁর মতে, দেশভাগের মতো বিষয়ে বক্তা তাঁর রাজনৈতিক প্রয়োজনে জ্ঞানে বা অজ্ঞানে বয়ান উপস্থাপন করেন। দীপেশ চক্রবর্তী যেমন মনে করেন, দেশভাগের মতো ট্রমার মধ্যে দিয়ে যাঁরা গিয়েছেন, তাঁরা সচেতন ভাবেই বিস্মৃতি চান।
লেখক দেশহারা মানুষের অমলিন বেদনার কথা লিখতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন দক্ষিণারঞ্জন বসু সম্পাদিত ছেড়ে আসা গ্রাম গ্রন্থটির। এতে আছে পূর্ববঙ্গের ৩২টি গ্রামের পরিচয় কথা। গ্রন্থটির কোনও রচনার সঙ্গে লেখকদের নাম, বয়স নেই, লেখক পুরুষ না মহিলা, তাঁদের রাজনৈতিক বা অন্য কোনও পরিচয় জানা যায় না। মিল একটাই, তাঁরা তাঁদের ফেলে আসা গ্রামের কথা বলেন স্মৃতিঘোরে, এক শান্তির নীড় ছিল তাঁদের বাড়ি ঘর, গেরস্তালি। আর ছিল গৌরব করার মতো অসংখ্য গাথা, ইতিহাসের উত্তরাধিকার। মনে হয় যেন কল্পলোকের স্বর্গ ছিল কথকদের গ্রামগুলি। সেখানে বন্যা নেই, নেই মহামারি, মন্বন্তর, দারিদ্র, মানসিক বা ধর্মীয় অত্যাচারের কথা। তাঁদের কাছে দেশভাগ এক যুক্তিহীন অঘটন মাত্র, তাঁরা যেন কোনও এক অজ্ঞাত ঘটনার শিকার। গ্রন্থের কথকরা কেউ চালচুলোহীন, গোত্রহীন নন। এঁরা মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক, ভূমিজ সম্পর্কে বিত্তশালী, উচ্চবর্গের প্রতিনিধি, হিন্দুত্বের গরিমায় উজ্জ্বল। অথচ, তাঁরা গণপ্রব্রাজন সম্পর্কে প্রায় নীরব! এই নীরবতা হয়তো ছিল ভদ্রোচিত ঔদার্য, হয়তো পরবর্তী বামমার্গী ধারণার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। ‘সাম্প্রদায়িক’ বলে চিহ্নিত না হওয়ার উপায়। এখানেই তাঁদের বয়ানে ইতিহাস রচনার বস্তুগত ভিত্তির বিড়ম্বনা লুকিয়ে আছে!
তবে সত্যি যে, স্মৃতিচারণায় এক বৃহত্তর সামাজিক চেতনা তৈরি হয় এবং এর মাধ্যমে আমরা এক বৃহত্তর সামাজিক ইতিহাসের সন্ধান পাই। সেমন্তী ঘোষ যেমন তাঁর দেশভাগ: স্মৃতি আর স্তব্ধতা গ্রন্থের সম্পাদনা মুখবন্ধে বলেছেন, কোনও কোনও ঘটনা নিজের বিশিষ্টতার গুণেই স্মৃতিপটে লালিত ও উত্তরাধিকার সূত্রে প্রবাহিত হয়। দেশভাগ তেমনই এক ঘটনা। তাই দেশভাগ কেবল একটা ঘটনা নয়, ঘটনার অভিঘাতও বটে। অভিঘাতের সঙ্গেই জুড়ে যায় বেদনার অমলিন স্মৃতি।
প্রলয় চক্রবর্তী, কলকাতা-১২৪
‘মাসিমা’
নিখিল সুরের প্রবন্ধ পড়ে মনে উদয় হল বিস্মৃতপ্রায় বরিশালের মনোরমা বসুর কথা। তিনি বরিশালে মাসিমা নামে পরিচিত ছিলেন। খুব অল্প বয়সেই বৈধব্য জীবনে প্রবেশ করেন। রাজনৈতিক জীবনে হাতেখড়ি সেই থেকেই। তার পর আর রাজনীতি থেকে সরে যাননি।
গান্ধীজি এসেছেন বরিশালে। মেয়ে-পুরুষে ঘর ভর্তি। দেশের কাজে গান্ধীজি সবাইকে আহ্বান জানালেন। ঘোমটা মাথায় তুলে এগিয়ে গেলেন মনোরমা বসু। একটা-একটা করে সব গয়না খুলে দিলেন গান্ধীজির হাতে। নিজেকে সম্পূর্ণ ভাবে জড়িয়ে ফেললেন দেশের কাজে। বড় পরিবারের গৃহিণী হওয়া সত্ত্বেও তিনি নিজেকে সংস্কারের নাগপাশে আবদ্ধ রাখেননি। নিজের বাড়িতে তৈরি করলেন এক মন্দির। নাম দিলেন ‘মাতৃমন্দির’। না, সেখানে ঠাঁই মেলেনি কোনও আরাধ্য দেবতার মূর্তির। সমাজের পরিত্যক্ত ও বিপথগামী মেয়েদের আশ্রয় দিয়েছিলেন। শিশুদের জন্যও শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন। শহরে এ নিয়ে চাঞ্চল্য শুরু হয়েছিল, কিন্তু তিনি পিছপা হননি। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্র জোগাড় করতেন। অল্পবয়সিদের বোঝাতেন তাঁকে সহযোগিতা করার জন্য। পরে মাসিমা কমিউনিস্ট হলেন। দেশ ভাগের পর রয়ে গেলেন পূর্ব বাংলায় তাঁর মাতৃমন্দির প্রতিষ্ঠানের টানে। ইতিহাস তাঁর মতো মানুষদের কতটুকু খোঁজ রাখে?
নারায়ণ সাহা, কলকাতা-৮৪
বেদনার স্মৃতি
‘যে বেদনা আজও অমলিন’ পড়ে সুখস্মৃতির চেয়ে বেশি বেদনাই জাগল। জীবনের প্রথম বারো বছর খুলনা জেলার রাড়ুলি গ্রামের কপোতাক্ষ নদের বালুকাবেলায় আমার যে বালিকাবেলা রেখে এসেছি, সে স্থানের প্রতি দীর্ঘ সময় মন বিরূপ ছিল। যে আমাকে উৎখাত করে দিয়েছে, তার মুখ আর এ জীবনে দেখব না। কিন্তু বাহান্ন বছর বিচ্ছেদের পরে জীবনের অপরাহ্ণ বেলায় এসে একটা টান অনুভব করি। প্রতিবেশী ভদ্রলোক ঢাকার কাছে পূর্বপুরুষের ভিটেবাড়ি দেখতে গিয়ে ফিরে এসে বললেন, “না গেলেই ভাল ছিল। জমিজমা, বাগান, পুকুর সব জবরদখল হয়ে গেছে, ভিটেবাড়ি, মন্দির সব ভেঙে নতুন বিল্ডিং উঠেছে।” গ্রামবাসীরা এখনও উত্তরের কোঠায় আমাদের চণ্ডীমণ্ডপে দুর্গাপুজো করেন। কিন্তু আমরা পশ্চিমের ভিটের দোতলায় লম্বা বারান্দা-সহ যে বড় ঘরগুলোতে থাকতাম, তার ভগ্নদশা দেখলে চোখে জল আসে।
আমাদের গ্রাম থেকে আরও দক্ষিণে কপিলমুনি আশাশুনি অঞ্চলের আবাদজমি থেকে নৌকা বোঝাই ধান আসত। সে দিন আমাদের সদর পুকুর থেকে টানা জাল ফেলে বড় বড় রুই কাতলা মাছ ধরা হত। চাষিদের প্রাপ্য পারিশ্রমিক ছাড়াও এক তলার ভিতরের লম্বা বারান্দায় তাদের পেটভর্তি গরম ভাত ডাল, মাছভাজা, মাছের ঝোল, রসগোল্লা খাওয়ানো হত। হিন্দুপ্রধান গ্রামে আমাদের বাড়ির চণ্ডীমণ্ডপে একমাত্র দুর্গাপুজো হত। অষ্টমী-নবমীতে সেই উঠোনে স্টেজ বেঁধে হত যাত্রাপালা। ’৬৪ সালের কাছাকাছি বাগেরহাটে ভয়ানক দাঙ্গায় হিন্দুনিধন চলতে থাকে। আমরা খুলনা শহর থেকে ট্রেনে পেট্রাপোল বর্ডার হয়ে ভারতে চলে আসি। কিছু দিন সিউড়িতে মামার বাড়ি থেকে অশোকনগরে বাবা তৈরি বাড়ি জমি কেনেন। ’৬৫-তে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শেষ হয়ে অবস্থা স্বাভাবিক হলে, এখানে কোনও স্থায়ী আয়ের ব্যবস্থা না থাকায় বাবা আমাদের নিয়ে আবার পূর্ব পাকিস্তানের গ্রামে ফিরে যান। সেখানে সব ঠিকঠাক চললেও একটা রাজনৈতিক অস্থিরতা টের পাওয়া যাচ্ছিল। উর্দু শাসনের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে উঠছিল। ধানজমির চাষিরা, বাবার মুক্তিযোদ্ধা ছাত্ররা বলেছিল, “স্যর, দেশ ছেড়ে যাবেন না। এ মাটি আমাদের, আমরা ঠিক প্রতিষ্ঠিত হব।”
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হল, গ্রামের অধিকাংশ মানুষ চলে গেলেও বাবা আমাদের নিয়ে বাড়িতেই ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধারা কপোতাক্ষের এ পাড়ে আমাদের গ্রাম ঘিরে রেখে পাহারা দিত। অগস্ট মাসে, তখনও ভারতীয় সেনাবাহিনী সাহায্যের জন্য ঢোকেনি, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নদীর ও পাড় পর্যন্ত চলে এল। অসম যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা মারা পড়তে লাগল। রাতারাতি নদীর অন্য দিক দিয়ে নৌকায় করে প্রায় সর্বহারার মতো আমরা হাসনাবাদের ঘাটে এসে উঠলাম। আর ফিরে যাওয়া হয়নি। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে ভুগে মা বলেছিলেন, “নুনভাত খাব তবু ও দেশে আর ফিরে যাব না।” এই স্মৃতি শুধু বেদনাই বয়ে আনে।
শিখা সেনগুপ্ত, বিরাটি, উত্তর ২৪ পরগনা