সুমন ঘোষের ‘সত্যজিতের নারীরা’ (১-৫) প্রবন্ধটি খুব আগ্রহ সহকারে পড়লাম। ছবিতে যৌনতা প্রদর্শনের ব্যাপারে সত্যজিতের একটা অস্বস্তিবোধ ছিল, কিন্তু এর কারণগুলি ভাবা প্রয়োজন। অরণ্যের দিনরাত্রি-তে (ছবিতে) শুধু কাবেরী বসুর চরিত্রটি নয়, সিমি গারেওয়াল অভিনীত সেই ছোট্ট, অথচ অবিস্মরণীয় আদিবাসী রমণীর চরিত্রটির কথাও বলতে হয়। এই ছবিতে দু’টি চরিত্রই যৌনমিলনে আগ্রহী, তবে সামাজিক অবস্থানের কারণে উচ্চ মধ্যবিত্ত বিধবা নারীচরিত্রটি বিফল মনোরথ হয়। কিন্তু সুস্থ এক মানবীর অবদমিত আকাঙ্ক্ষা এই ছবিতে অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও নান্দনিক ভাবে দেখানো হয়েছে। বিবাহিত সম্পর্কে অপ্রাপ্তিবোধ থেকে শুরু হওয়া যৌন অভিসারের অন্যতম সেরা ছবি লুই বুনুয়েলের বেল দ্য জ্যুর মুক্তি পায় ১৯৬৭ সালে। সেই সময়ের কিছু পরে (১৯৭০) মুক্তি পায় অরণ্যের দিনরাত্রি। বুনুয়েলের মতো সাহসী, প্রাপ্তবয়স্ক ছবি সত্যজিৎ রায় পরিচালনা করতে চাইলেও নিঃসন্দেহে বাধাপ্রাপ্ত হতেন সেন্সর বোর্ডের কাছে। কাজেই আমার ধারণা, সত্যজিতের ছবিতে এই সমস্ত কারণেই আমরা আজকের দিনের সম্পূর্ণ স্বাধীনচেতা, নিজস্ব চাহিদা বিষয়ে সচেতন আধুনিকাকে দেখতে পাইনি। প্রাপ্তবয়স্ক ছবির জন্য প্রয়োজন মুক্তমনা দর্শক, যেটা পেয়েছেন একবিংশ শতাব্দীর বাংলার পরিচালকরা।
রিমি পতি
কলকাতা-৪০
একমুখী দৃষ্টি
সুমন ঘোষের প্রবন্ধ প্রসঙ্গে কিছু কথা। পিকু ছবির সেই দৃশ্যটি খেয়াল করুন, যেখানে অন্তরঙ্গ মুহূর্তে ব্যাঘাত ঘটায় শিশু পিকুর একটি সরল জিজ্ঞাসা— মা সাদা রং নেই, সাদা ফুল কালো দিয়ে আঁকব? কী মারাত্মক শ্লেষ লুকিয়ে রয়েছে এই একটি সংলাপে, শিশুদের নিষ্পাপ মন সাদা-কালোর ফারাক বোঝে না। আর তার বিপ্রতীপে সত্যজিৎ ধরতে চেয়েছেন স্বামীর অনুপস্থিতিতে পরকীয়ারত মাকে।
পিকু ছবিতে সত্যজিৎ রায়ের অবস্থান নিয়ে অনেকেরই আপত্তি আছে। সত্যজিৎ রায়ের ‘জাজমেন্টাল’ মানসিকতাকে সমালোচনা করে এক লেখিকা-সমালোচক বলেছিলেন, এই ছবিতে সত্যজিৎ রায় কেবলমাত্র পুরুষের প্রেক্ষিত থেকে সাধারণীকরণ করেছেন। ব্যক্তিগত ভাবে আমারও খুব একটা দ্বিমত নেই। গোটা ছবিতে পিকুর অবহেলা থেকে শুরু করে পিকুর দাদুর হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু— সমস্ত কিছুর জন্যই যেন সত্যজিৎ পিকুর মাকে দায়ী করতে চান। একটি দমবন্ধ করা সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে থাকার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা একটি মানুষকে বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কের দিকে ঠেলে দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে কি এমনটা বলা যায় যে, সেই মানুষটি (বিশেষ করে তিনি যদি মহিলা হন) তাঁর সন্তানের প্রতি অবিচার করলেন? ভারতের মতো গরিব তৃতীয় বিশ্বের দেশে এমনটা প্রায়ই লক্ষ করা গিয়েছে শুধুমাত্র ‘সমাজ কী বলবে’ এই ভেবে। একটা মৃত, স্থবির সম্পর্ককে মহিলারা টেনে নিয়ে গিয়েছেন স্বামীর শত অত্যাচার সহ্য করেও, ‘বিয়ে’ নামক এই প্রাচীন পুরুষতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানটির প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এক জন পুরুষের নিজের সুখ খুঁজে নেওয়ার অধিকার থাকলেও নারীকে সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। আর যদি নারী সমাজের এঁকে-দেওয়া এই লক্ষ্মণরেখা অতিক্রম করেন, তখন তাঁর দিকে ধেয়ে আসে নানা গুঞ্জন, এমনকি সমাজ তাঁর চরিত্রহনন করতেও পিছপা হয় না। চলচ্চিত্র-তাত্ত্বিক লরা মালভি তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধে ‘ক্যাস্ট্রেশন অ্যাংজ়াইটি’-র কথা উল্লেখ করেছেন, নারীকে অবদমিত করে রাখার এই সমস্ত চেষ্টার মূলে। ভাবতে অবাক লাগে, চারুলতা, মহানগর-এর নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের মতো এক জন গুণী মেধাবী পরিচালক কী করে নারীর বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কে সুখ খুঁজে নেওয়ার মতো এক জটিল, বহুস্তরীয় এবং আর্থ-সামাজিক কারণে বেষ্টিত সূক্ষ্ম বিষয়কে কেবলমাত্র একমুখী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলেন, যেখানে ষাটের দশকে একের পর এক ছবিতে কখনও নারী এসেছে কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে, কখনও বিবেকের ভূমিকায় পুরুষ চরিত্রগুলির সামনে আয়নার মতো করে, তাদের ত্রুটিবিচ্যুতি সম্পর্কে অবগত করতে।
সৌরনীল ঘোষ
দুর্গাপুর, পশ্চিম বর্ধমান
দিশারি
শক্তিসাধন মুখোপাধ্যায়ের ‘ভাষার আড়াল সরিয়ে মুক্ত করেছিলেন শাস্ত্রজ্ঞান’ (রবিবাসরীয়, ২৪-৪) প্রবন্ধ সম্পর্কে কিছু কথা। আজকাল আমরা যে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব আলোচনা করি, রাজা রামমোহন রায় সে ব্যাপারে যে এক জন দিশারি, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। ১৮৬১ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সিলেক্ট কমিটির ৫৪টি প্রশ্ন-উত্তরের মধ্য দিয়ে রাজস্বব্যবস্থা, ভূমিব্যবস্থা ও বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে তাঁর জ্ঞানের পরিচয় পাই। রামমোহন ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রাম করেছেন। আজকাল সমাজমাধ্যমে অপপ্রচার চালানো হয় যে, উনি নাকি সংস্কৃত ভাষার বিরোধী ছিলেন। বস্তুত তিনি সংস্কৃতের আধুনিকীকরণের জন্য ১৮২৬ সালে বেদান্ত কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮২২ সালে সম্বাদ কৌমুদী-তে লেখেন যে, মাতৃভাষা না শিখে ইংরেজি ভাষা শিখতে গেলে কোনও ভাষাই ঠিক ভাবে আয়ত্ত হয় না। সংস্কৃত শাস্ত্রকে বাঙালি সমাজের কাছে তুলে ধরতেই তিনি বাংলায় অনুবাদ করেন উপনিষদ। শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলার প্রচারে তাঁর গৌড়ীয় ব্যাকরণ-এর প্রকাশ গুরুত্বপূর্ণ।
রাজা রামমোহন রায়কে নিয়ে চর্চার প্রয়োজন, এবং তার জন্য তৎকালীন বঙ্গসমাজের পরিস্থিতিও জানা দরকার। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই জন্যে বলেছিলেন, “সেই অজন্মার দিনে রামমোহন রায় জন্মেছিলেন সত্যের ক্ষুধা নিয়ে।” সময়কাল ও তার তাৎপর্য বিচার না করেই আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ১৮৯ বছর আগের এক জন ব্যক্তি সম্পর্কে নানা অভিযোগ তোলা হচ্ছে। শিবনাথ শাস্ত্রী রামমোহন রায় সম্পর্কে যথার্থই বলেছেন, “তিনি স্বদেশবাসীদিগের মুখ পূর্ব হইতে পশ্চিমদিকে ফিরাইয়া দিলেন। তবে নবীনের অভ্যর্থনা করিতে গিয়া প্রাচীন হইতে পা তুলিয়া লন নাই।” প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মিলনে রাজা রামমোহন রায় যথার্থ পথিকৃৎ।
দেবজ্যোতি বিশ্বাস
কৃষ্ণনগর, নদিয়া
উদার ধর্ম
শক্তিসাধন মুখোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ প্রসঙ্গে বলতে চাই, আজকের জাতপাত নিয়ে ঘৃণার এই দেশে রামমোহনের মতো এক ধর্ম সংস্কারকের প্রয়োজনীয়তা বহুলাংশে বেড়ে গিয়েছে। তাঁর একেশ্বরবাদ ও নিরাকার ব্রহ্মের সাধনা আজকের পরধর্ম-অসহিষ্ণু, বিভেদকামী ভারতীয় সমাজে একমুঠো ঠান্ডা বাতাস বলেই মনে হয়। রামমোহন দু’শো বছর আগে অনুভব করেন, বেশির ভাগ হিন্দুধর্মের কান্ডারি সংস্কৃত শাস্ত্রগুলি যথার্থ অনুধাবন না করে ধর্মের ব্যবসায়ে লিপ্ত রয়েছেন। জাতি-ধর্মের বিভেদ সৃষ্টি করছেন। এতে হিন্দুধর্মের ক্ষতি হচ্ছে। তাই তিনি প্রথমে এগুলি সরল বাংলায় অনুবাদ করে সাধারণ মানুষের কাছে শুধু পৌঁছেই দিলেন না, তা কতটুকু গ্রহণযোগ্য যুক্তি সহকারে বুঝিয়ে দিলেন। সংস্কারমুক্ত এই নতুন ধর্ম তবু খুব বেশি জনমানসে সাড়া ফেলেনি। যে নিম্নবর্গের হিন্দুরা উচ্চবর্ণের কাছে চরম ভাবে নির্যাতিত ও লাঞ্ছিত, তাঁরাও খুব একটা সাড়া দিলেন না কেন? সাধারণ মানুষকে টানার জন্য যথেষ্ট প্রচার হয়নি, মানতেই হবে। এর পরেও আমরা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেশব সেনের হাতে ব্রাহ্ম সমাজেও অনেক বিভাজন, পরিমার্জন দেখেছি। দেখেছি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীত সাধনায় ব্রাহ্মধর্মের এক অনবদ্য রূপকে। তবুও ব্রাহ্মধর্ম ‘এলিট’ তকমায় আবদ্ধ হয়েই রয়েছে।
আজকের এই অশান্ত ভারতে আরও এক বার ভাবার অবকাশ রয়েছে, সাধারণ মানুষ রামমোহনের এই জাত-ধর্ম মুক্ত মানবীয় ধারাটির সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন কি না, তার দ্বারা মনে-প্রাণে পরিচালিত হতে চান কি না। সমাজে আজও যাঁরা উদারবাদী চিন্তাধারার মানুষ, তাঁরা আসলে রামমোহনের এই মানবতাবাদের এক প্রকার সমর্থক।
মৃণাল মুখোপাধ্যায়
কলকাতা-১০৭