স্বাতী ভট্টাচার্য তাঁর ‘মহাভারতের নায়িকা’ (৮-১২) প্রবন্ধে সুদীপ্ত কবিরাজকে উদ্ধৃত করে বলেছেন, মহাভারতের নায়ক নেই, কেবল এক নায়িকা আছে— দ্রৌপদী। ঠিকই, মহাকাব্যের নায়ক বলে দেশে দেশে যাঁরা বন্দিত হয়েছেন যুগে যুগে, তাঁরা হয় মারেন, নয় মরেন। তাঁদের মারণ ক্ষমতার যূপকাষ্ঠে অহরহ বলি হয় অযুত নারীর ব্যক্তিস্বাধীনতা ও সম্ভ্রম। হত্যা ও অপমানের ধারক ও বাহকেরা জীবনের নায়ক হতে পারেন না। তাঁদের বিপরীতে আছেন জীবনদাত্রী ও জীবনধাত্রীরা। সেই যুক্তিতে, দ্রৌপদী মহাভারতের নায়িকা অবশ্যই।
তবে নায়িকা কি তিনি একাই? যুদ্ধগামী সন্তান এসেছে মরণযুদ্ধে যাওয়ার আগে মায়ের আশীর্বাদ নিতে, তাকে ‘জয়ী হও’ না বলে, “যেখানে ধর্ম সেখানেই জয়” বলার সিদ্ধান্ত নিতে এক জন মায়ের ঠিক কতটা সাহস, বুদ্ধি, ও সহনশক্তি থাকতে হয়? যিনি এ কাজ করেন, তিনি ‘মেধা’র মূর্ত রূপ। মেধা শব্দটির অর্থ, প্রজ্ঞান। মহাভারতের পর্ব থেকে পর্বান্তরে গেলে যে গান্ধারীর দর্শন মেলে, তিনি সর্বদা স্থিতধী। চূড়ান্ত সঙ্কটের মুহূর্তেও তাঁকে অবিচলিত থাকতে হয়। তিনি এক অসামান্য নারী যাঁকে মহাকবি গড়ে তুলেছিলেন ধৈর্য এবং সুচিন্তার আধাররূপে। যদিও সুচিন্তক হিসেবে স্বীকৃত হওয়ার পথে তাঁর ছিল প্রতিবন্ধকতা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ চিন্তনের দখল নেয়, গড়ে তুলতে চায় তার নিজস্ব চিন্তন-উপনিবেশ। এই পরিস্থিতিতে নারীর যে প্রতিবন্ধকতা, তা এক প্রবহমান সত্য, তেমন ইঙ্গিতও আছে মহাকাব্যে।
ভাবতে ইচ্ছা করে, মহাকাব্যের কবি কি বলতে চেয়েছিলেন, আপন আবেগ সংযত করে কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব যুগে যুগে নারীকেই অর্পণ করেছে সমাজ? সেই নারী, যিনি স্বেচ্ছায় চোখ বেঁধে রেখেছিলেন? এই চোখ বেঁধে রাখার বৃত্তান্ত অনুধাবনের পথ ধরে হয়তো পৌঁছনো যেতে পারে গান্ধারী চরিত্রের বিপুলতায়, যার প্রতিরূপ আজকেও দেখা যায় গ্রাম থেকে শহরে অনেক ভারতীয় নারীর দিনযাপনেই।
সেই জন্যই কি মহাভারতের মহাকবি তাঁর মহাকাব্যে গান্ধার রাজকন্যার কোনও নামকরণ করেননি, তিনি থেকে গিয়েছেন গান্ধারী হিসেবে? দ্রুপদ রাজার মেয়ে দ্রৌপদী যদি কৃষ্ণা হন, তা হলে কেন নাম পেলেন না গান্ধারী? মহাকবি কি বলতে চেয়েছিলেন, ভয়ঙ্কর পুরুষতান্ত্রিক দাপট দেখতে অস্বীকার করে নিজের চোখ বেঁধে রাখেন গান্ধারী; অথচ বার বার প্রতিবাদ করেন দুর্যোধন, ধৃতরাষ্ট্র, যুধিষ্ঠির এবং কৃষ্ণের কার্যকলাপের— তিনি সেই নারী যাঁকে যুগে যুগে এই কঠিন কাজ করার দায়িত্ব নিতে হবে? তাই কি তিনি গান্ধারীকে নাম না দিয়ে বিশেষণ দিয়েছিলেন ‘দীর্ঘদর্শিনী’ (ফার-সাইটেড)?
ধৃতরাষ্ট্রের জন্মান্ধতা হয়তো পুরুষতান্ত্রিক অন্ধত্বের দ্যোতক। তিনি আগাগোড়া যে ধর্ম পালন করে গিয়েছেন, তার নাম পুরুষতন্ত্র। ভয়ঙ্কর সেই পুরুষতন্ত্র, যা শুধুই ক্ষমতালোভী এবং ক্ষমতা কায়েম রাখতে জানে, যা একাধারে তঞ্চক ও অত্যাচারী। নিজের চোখ বেঁধে রেখেও রাষ্ট্রের এই পুরুষতন্ত্র-ধর্ম যিনি দেখতে পান, তিনিই তো দীর্ঘদর্শিনী। তাঁর ক্ষেত্রেই সেই শ্লোক প্রযোজ্য, ‘সম্ভবামি যুগে যুগে’।
মহাকবি জানতেন, তাঁরা বার বার জন্ম নেবেন। তাই মনে হয়, গান্ধারী, সেই অনাম্নী অঙ্গনা, সেই আবহমান নারী যিনি কুরুক্ষেত্রের লাশের পাহাড় দেখতে পেয়েছিলেন ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে বিবাহপ্রস্তাব আসামাত্রই, সম্মুখদৃষ্টি অবরুদ্ধ করে চোখ মেলে দিয়েছিলেন অমোঘ মানবযন্ত্রণা-কাতর বৃহত্তর জীবনের দিকে— তিনিও কি মহানায়িকা নন ?
অনিরুদ্ধ রাহা, কলকাতা-১০
সাদৃশ্য
‘মহাভারতের নায়িকা’ পড়ে ঋদ্ধ হলাম। সাম্প্রতিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দ্রৌপদীর চরিত্র চিত্রণের প্রয়াস পরিপূর্ণতা পেয়েছে। পেয়েছে সাফল্য। বার্তা দিতে পেরেছেন নারীজাতিকে, সমাজকে। মহাভারতে চরিত্র সৃষ্টির উপাদান হিসেবে ব্যাস মায়া, মমতা, স্নেহ, ভালবাসার পাশাপাশি ঘৃণা, রাগ, দ্বেষ, ঈর্ষা, হিংসা, অহঙ্কার, প্রতিহিংসাকে স্থান দিয়েছেন। স্থান দিয়েছেন দান, সহযোগিতা, সহমর্মিতা, প্রতিজ্ঞা পালনকে। তৎকালীন সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে কিছু লজ্জা, কুৎসা, সমস্যাকে আড়াল করার জন্য মহাকাব্যের রচয়িতাকে ঈশ্বরের সহায়তা নিতে হয়েছে। কিন্তু গভীর অনুসন্ধানে সেই সব অলৌকিক ঘটনারও বাস্তবসম্মত চিত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। মহাভারত বিশেষজ্ঞরা এ সব নিয়ে গবেষণার কাজ করেছেন।
একটি অনন্য চরিত্র দ্রৌপদী। নানা ঘাত-প্রতিঘাতে জর্জরিত, বহুবিধ চমকপ্রদ ঘটনার সঙ্গে জড়িত চরিত্রটিকে মহাভারতের নায়িকা বললে অত্যুক্তি হবে না। তিনি দ্রুপদ কন্যা তাই দ্রৌপদী, পাঞ্চালের রাজকন্যা তাই পাঞ্চালী, গায়ের রং কালো বলে কৃষ্ণা, আবার যজ্ঞ থেকে জন্ম বলে যাজ্ঞসেনী। মহাভারত থেকে জানা যায়, দ্রৌপদী এবং তাঁর ভাই ধৃষ্টদ্যুম্ন পাঞ্চালের রাজা দ্রুপদের করা একটি যজ্ঞ থেকে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাই দ্রৌপদীর জন্ম রহস্যাবৃত। মহাভারতের বিভিন্ন পর্বে তাঁর বাগ্মিতার পরিচয় পাওয়া যায়। জয়দ্রথ ও কীচককে তিনি ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিয়েছিলেন। তাই তিনি অবলা নন। তিনি তেজস্বিনী, স্পষ্টবাদিনী, তীক্ষ্ণ বাক্যবাণে নিষ্ক্রিয় পুরুষদের উত্তেজিত করতে পারেন। বুদ্ধিমতী, সহমর্মী, রন্ধন শিল্পে পারদর্শী। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সুখ-দুঃখে, বিপদে-আপদে তিনি পাঁচ স্বামীকে এক সঙ্গে বেঁধে রাখতে পেরেছিলেন, এ কম কথা নয়। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের জন্য তাঁকে অনেক দাম দিতে হয়েছিল, অনেক দুঃখ সহ্য করতে হয়েছিল। বাবা, ভাই এবং পাঁচ সন্তানকে তিনি হারিয়েছিলেন। তবু যুদ্ধের পর, ছত্রিশ বছর ধরে সম্রাজ্ঞী হিসাবে তাঁর ভূমিকা পালন করেছিলেন।
মহাভারতের ঘটনাবলি আমাদের সমাজে, সংসারে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে। কৌরব রাজসভায় অত্যাচারিতা, লাঞ্ছিতা দ্রৌপদী বার বার বিচার চেয়েও বিচার পাননি। রাজার বিরুদ্ধে দু’-এক জন ছাড়া কেউ মুখ খোলেননি। আজও প্রতি দিন ঘটে চলা এমন অনেক ঘটনা কি সেই দিকেই নির্দেশ করে না? আমাদের সমাজে হাজার হাজার কীচক, জয়দ্রথ, দুর্যোধন, দুঃশাসন ঘুরে বেড়াচ্ছে, কিন্তু তাদের শাস্তি দেওয়ার উপায় কই? দ্রৌপদী যথার্থ ভাবেই নারী-সমাজের অসাধারণ শক্তির প্রতীক, এবং তার সঙ্গে বিচারের অভাবে বিপন্নতারও।
গৌতম পতি, তমলুক, পূর্ব মেদিনীপুর
আস্ফালন
স্বাতী ভট্টাচার্য পৌরাণিক উদাহরণ দিয়ে বর্তমান সময়ের প্রাসঙ্গিক একটি প্রশ্ন তুলেছেন, শাসকের কি ধর্ম বলে কিছু হয়? গণতান্ত্রিক দেশে শাসকের একমাত্র ধর্ম হওয়া উচিত ‘রাজধর্ম’ তথা দেশের সংবিধান। কিন্তু কী রাজ্য, কী কেন্দ্র, যে দল যখন যেখানেই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, কোথাও তার ছিটেফোঁটাও বাস্তবায়িত হয় না। এমনকি যখনই ‘প্রয়োজন’ হয়, দেশের সর্বোচ্চ আদালত ও আইনব্যবস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে সুবিধামতো সংবিধান সংশোধনও করে নেন। ফলে ক্ষেত্রবিশেষে সংবিধানের মৌলিক চরিত্রটি বিপন্ন হয়ে পড়ে। অনেক দিন আগেই শাসকের চরিত্র সম্বন্ধে কবি শঙ্খ ঘোষ লিখে গেছেন, “আমি তো আমার শপথ রেখেছি/ অক্ষরে অক্ষরে/ যারা প্রতিবাদী তাদের জীবন/ দিয়েছি নরক করে।/ দাপিয়ে বেড়াবে আমাদের দল/ অন্যে কবে না কথা/ বজ্র কঠিন রাজ্যশাসনে/ সেটাই স্বাভাবিকতা।” শাসক বদলালেও সেই পরম্পরার এখনও কোনও পরিবর্তন হয়নি।
রাজ্য বা কেন্দ্র উভয় ক্ষেত্রেই ক্ষমতাসীন হওয়ার জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের ছলের কোনও ত্রুটি থাকে না। কিন্তু ক্ষমতা হাতে পেয়েই ব্যক্তি, পরিবার বা দলের স্বার্থে ‘বিরোধী’ মতবাদের নাগরিক সমাজকে ‘শত্রু’ হিসেবে গণ্য করে তাঁদের জীবন নরক করে তোলেন, অত্যাচারিত হয় দেশ, দেশের মানুষ। শাসকের ‘আমিত্ব’ তাকে নিষ্ঠুর করে তোলে। দুর্ভাগ্য, সংবিধানপ্রদত্ত বিচার ব্যবস্থাকে অগ্রাহ্য করে ধর্ষণের নালিশ শুনতেই চান না মহিলা মুখ্যমন্ত্রীও। অনায়াসেই তিনি বলতে পারেন, ‘ওটা সাজানো ঘটনা’। প্রবন্ধকারের মতে, তখন ‘কারও নামে অভিযোগ থাকলেই তাকে অভিযুক্ত বলা যায় না’, কিংবা ধর্ষণের বিচার যারা চাইছে, তারা আসলে অরাজকতা চাইছে— এমন অদ্ভুত কথা শোনা যায়। গণতন্ত্রেও ‘মানুষ সত্য’ না হয়ে দলই সত্য হয়, এবং হিংসা, বিভেদ ও মারামারির প্ররোচনা দেন শাসকই।
নিকুঞ্জবিহারী ঘোড়াই, পাঁশকুড়া, পূর্ব মেদিনীপুর