লকডাউনে স্তব্ধ মুম্বই।
আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিন দশক পূর্বে কিশোর বয়সেই জীবিকার সন্ধানে মেদিনীপুর জেলার দাসপুর থানার এক প্রত্যন্ত গ্রাম ইসবপুর থেকে পাড়ি দিয়েছিলাম ভারতের অন্যতম আর্থিক পীঠস্থান বোম্বাই শহরে। যার অধুনা নাম হয়েছে মুম্বই। তাই কিশোর বয়সে কর্মজীবনের মধ্যে থেকেই এই শহরের সঙ্গে সুখ, দুঃখ, আনন্দ ভাগাভাগি করেই পথ চলেছি। আর এই শহরের বুকেই চলছে আজও সেই বিরামহীন পথ চলা।
সে দিনের সেই জীবিকার শহর সময়ের সঙ্গেই বদল হয়েছে তার নিজস্ব ঢঙে, ভাল-মন্দের গরিমায়। ভিন্ রাজ্যের শহর হলেও আপন ভাবতে বেশি সময় লাগেনি। তাই প্রবাসী থেকেও এই শহরের আঘাতে যেমন কেঁদেছি, তেমনি সুখের আনন্দে হেসেছি। আমার এই সুখ দুঃখের শহর, দেশের অন্যান্য শহরের তুলনায় অনেক বেশি আঘাত সয়েছে সময়-সময়ে। কদর্য আঘাত সয়ে প্রত্যক্ষ সাক্ষী করেছে শহরের বক্ষস্থলের ক্ষতস্থান। সেই আঘাতের চিহ্ন শুধু স্মৃতির পাতাতেই নয়, সহস্র শরীরে যা আজও বিদ্যমান।
২০০৫-এর ২৬ জুলাই সমুদ্র জলস্তরের উচ্চ চাপ, তার দোসর হয়ে ঝরে পড়েছিল শ্রাবণের অবিরাম ধারা। কয়েক ঘন্টায় ঐ দুই দোসরের সাঁড়াশি পেষণও প্রত্যক্ষ করেছি। এর ঠিক পরের বছর ২০০৬-এর ১১ জুলাই মুম্বইয়ের পশ্চিম শাখার যাত্রী ভিড়ে ঠাসা সাত-সাতটি লোকাল ট্রেনে বোমা বিস্ফোরণ। আবার ২৬/১১-র ঘটনারও সাক্ষী থেকেছি। সেই সমস্ত আঘাতের ক্ষতচিহ্ন নিয়েই এগিয়ে চলেছে শহরবাসীর জীবন-ছন্দ। ওই সব দিনগুলোয় কিন্তু আজকের মতো এত নৈরাশ্য ভিড় করেনি। কারণ, ওই ঘটনা গুলোর পর যথারীতি স্বাভাবিক হয়েছিল শহরবাসীর রোজনামচা। তাই রোজকার জীবন যাত্রায় সে ভাবে বাধা আসেনি। আর আজ? মাসাধিককাল বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে টিভির পর্দায় করোনা-অলিম্পিকের ধারাবাহিক রেজাল্ট দেখতে-দেখতে সম্পূর্ণ এক অচেনা, অজানা হতাশায় দুর্বিষহ, যন্ত্রণাময় সময়ের দিন গুনে চলেছি।
আমার বাসস্থান উত্তর মুম্বইয়ের কান্দিভালিতে। কর্মস্থল আবার মুম্বইয়ের জাভেরি বাজার এলাকায়। আমাদের স্বর্ণশিল্পের কাজটি মুষ্টিমেয় কিছু ক্ষেত্র সংগঠিত হলেও ৯০/৯৫ শতাংশই অসংগঠিত ক্ষেত্র। মুম্বইয়ের জাভেরি বাজার এলাকায়, আমাদের পশ্চিমবাংলার বেশ কয়েকটি জেলার বিপুল সংখ্যক স্বর্ণশিল্পী (কারিগর) তাঁদের কাজের জায়গাতেই রাত্রিবাস করে থাকেন। যে জায়গায় কাজকর্ম, সেখানেই নাওয়া খাওয়া, সে খানেই ক্লান্তির ঘুমে রাত-যাপন। এ ব্যবস্থা যুগ-যুগ ধরে চলে আসছে। এক কথায়, রবিবারের সন্ধ্যা বেলা বাদ দিলে, আর হাতে কাজ না (কাজ কর্ম যখন মন্দা চলে) থাকলে, মুম্বইয়ের স্বর্ণশিল্পীদের দিনলিপি একই তারে বাঁধা। ব্যতিক্রম ছাড়া, খাওয়া থাকার অসুবিধে কারও কোন দিন হয় না। পঁয়ত্রিশ বছর ধরে এই শিল্প তথা এই কর্মস্থলের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে থাকায়, দৃঢ় বিশ্বাস নিয়েই একথা বলতে পারি।
কিন্তু, বাধ সেধেছে বর্তমান সময়ের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র করোনাভাইরাস। যা নিত্য দিনের স্বাভাবিক ছন্দ ভারত বর্ষের বিভিন্ন জায়গা এলোমেলো করে কঠিন এক বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে জীবন-সুধার অসুবিধাগুলোই এখন চাবুক মারছে। যেন অবাঞ্ছিত অতিথি হয়ে দিকে-দিকে ক্ষুধার্ত প্রাণ প্রতিক্ষণে বিদ্রোহ করে চলেছে।
এই দুঃসময়ে লকডাউনের ভয়াবহতা উপলব্ধি করে, ৩১শে মার্চ থেকেই মুম্বইয়ের কয়েকটি জায়গায় যথাসাধ্যে সাহায্যের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই লেখাটি পাঠানোর সময় পর্যন্ত ঐ পরিষেবা আরও বাড়ানো হয়েছে। এই বিপর্যয়ের দিনে দীর্ঘমেয়াদী পর্বে সাহায্য করে যাওয়া সেটাই বা কত দিন সম্ভব? মারণ ভাইরাসের মৃত্যু ভয় উপেক্ষা করে যাঁরা সরাসরি পরিষেবা করে চলেছেন, তাঁরাই বা কত দিন পারবেন? রাশি-রাশি বিস্ময়ের নানান প্রশ্নে মন ভারাক্রান্ত করে তুলে!
আবার এই রাজ্যেই অন্যত্র বা দেশের নানান প্রান্তে অধিকাংশই অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের অসহায় কান্নার ছবি? এর মধ্যেই করোনার মৃত্যু ভয় সরিয়ে, ক্ষুধার আর্তনাদ বুকে চেপে ছোট,ছোট সন্তানদের কাঁধে নিয়ে রুগ্ন, জীর্ণ শরীরের পথ চলা? মাইলের পর মাইল পথ চলতে- চলতে মৃত্যুর বুকে ঢলে পড়া?ঐ ভয়াবহ দিনগুলোর চেয়ে, এ যে আরও চরম হতাশার, চরম বিষাদের! আরও বেশি নৈরাশ্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছে দেশবাসীকে! এর শেষ কোথায়?
তাই আজ বলতে দ্বিধা নেই, অসচ্ছল থেকে সচ্ছল, বিলাসী থেকে বৈভবের জীবনও আজ হয়েছে অর্থহীন, মূল্যহীন। যাঁর টাকাপয়সা কোনও ভাবেই নেই, তাঁর জীবনটাই ভাবনার কাছে অর্থহীন, একথা যেমন সত্য? যাঁর টাকা আছে সে টাকাও সময়ে কাজে না লাগলে, হয়ে যায় মূল্যহীন টাকা। এই মুহূর্তে এটাই বাস্তব ও সত্য।
অমলেন্দু মাইতি
কান্দিভলি, মুম্বই
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)