Corona

আমরা পেরেছি, আপনারা কি পারবেন না কয়েকটা দিন কষ্ট করতে?

এই লকডাউন পরিস্থিতিতে পাঠকদের থেকে তাঁদের অবস্থার কথা, তাঁদের চারপাশের অবস্থার কথা জানতে চাইছি আমরা। সেই সূত্রেই নানান ধরনের সমস্যা পাঠকরা লিখে জানাচ্ছেন। পাঠাচ্ছেন অন্যান্য খবরাখবরও। সমস্যায় পড়া মানুষদের কথা সরকার, প্রশাসন, এবং অবশ্যই আমাদের সব পাঠকের সামনে তুলে ধরতে আমরা ম‌নোনীত লেখাগুলি প্রকাশ করছি। এই লকডাউন পরিস্থিতিতে পাঠকদের থেকে তাঁদের অবস্থার কথা, তাঁদের চারপাশের অবস্থার কথা জানতে চাইছি আমরা। সেই সূত্রেই নানান ধরনের সমস্যা পাঠকরা লিখে জানাচ্ছেন। পাঠাচ্ছেন অন্যান্য খবরাখবরও। সমস্যায় পড়া মানুষদের কথা সরকার, প্রশাসন, এবং অবশ্যই আমাদের সব পাঠকের সামনে তুলে ধরতে আমরা ম‌নোনীত লেখাগুলি প্রকাশ করছি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০২০ ১৫:৪৭
Share:

সুনসান হংকংয়ের রাস্তা। —নিজস্ব চিত্র।

ঘড়ি বলছে সকাল ১০টা ৩৫। অবশ্য ঘড়ি না দেখলেও সময়টা মোটামুটি আন্দাজ করে নিতে পারতাম। আমার দোতলার জানলার বাইরে ভ্যানটার আওয়াজটা শুনতে পাচ্ছি। জল ছিটিয়ে, সাবান ও জীবাণুমুক্ত করার স্যানিটাইজার স্প্রে করে আমার বাসস্থানের পাশের রাস্তাগুলো প্রত্যেকদিন ধোয়া শুরু হয়েছে যে দিন থেকে আমার আবাসনে করোনা সংক্রমণের খবর এসেছে।

Advertisement

গত তিন বছর ধরে আমি হংকংয়ে কর্মরত। পরিবার কলকাতায়। চিনের থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে অবস্থিত হয়েও, জনঘনত্বে বিশ্বব্যাপী তালিকার উপর দিকে থাকা প্রাচ্যের বাণিজ্যিক প্রাণকেন্দ্র এই ছোট্ট দেশটা কী ভাবে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে, তা হয়তো কারওরই অজানা নয়।

গোড়ার দিকের ‘প্যানিক শপিং’ কিংবা বৌদ্ধমন্দির, গির্জায় জমায়েতের মতো ঘটনাগুলোর সঙ্গে যুঝে নিয়ে এখানকার সরকারের প্রচেষ্টা আর নাগরিকদের সচেতনতা এবং সাবধানতা হংকংকে ইতালি, স্পেন বা আমেরিকা হওয়া থেকে কী ভাবে প্রাথমিক ভাবে আটকে দিয়েছে, তা-ও জানেন সবাই। কিন্তু এই মারণ ভাইরাসের সমাপ্তির শুরুটা দেখা না গেলে কি নিশ্চিন্ত হওয়া যাবে?

Advertisement

আরও পড়ুন: করোনা আতঙ্ক? স্বাস্থ্যকর্মীদের পর এ বার সাফাইকর্মীদের উপর হামলা মধ্যপ্রদেশে

এখানে পূর্ণ লকডাউন কিন্তু কখনওই ঘোষণা হয়নি। অনেক রকম নিষেধাজ্ঞা জারি হলেও, সরকারি ভাবে স্তব্ধ করে দেওয়া হয়নি শহরটাকে। আজ প্রায় আড়াই মাস হয়ে এল, সরকারি-বেসরকারি কর্মচারীরা প্রত্যেকেই বাড়ি থেকে কাজ করছেন।

দোকানবাজার তাড়াতাড়ি বন্ধ হয়ে যাওয়া, মেট্রো ও বাস চলাচলের সংখ্যা ও সময়সীমা কমিয়ে দেওয়া, ট্যাক্সির অভাব চোখে পড়া, যে শহর কখনও ‘উইকএন্ডের’ রাতে ঘুমতো না, সেই শহরকে রাত আটটা বাজলেই সুনসান হতে দেখা— এগুলো অবশ্য চোখে পড়ছে গত কয়েক মাস ধরে। বলাই বাহুল্য, হংকং এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশ করোনার এই যুদ্ধে অভিজ্ঞ যোদ্ধা। চিনের পরে করোনাভাইরাসের ঝড়টা শুরুতে তো এই দেশগুলোর উপর দিয়েই বয়েছিল।

সপ্তাহ কয়েক আগে আমার দৈনন্দিন রোজনামচার তালটা একটু কেটে গিয়েছিলো যেন। খবর পেলাম, আমাদেরই আবাসনে না কি সংক্রমণ ধরা পড়েছে। অতএব ‘হাই-রিস্ক’ তালিকায় এখন আবাসনে বসবাসকারী প্রায় প্রত্যেকেই।

আতঙ্কিত হতে সবাই বারণ করছেন, তাই ভয় পাইনি। এও জানতাম যে, আমি যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করে এসেছি প্রথম থেকেই। কিন্তু মনের খুঁতখুঁতানি কি আর এ রকম সময়ে যুক্তি মানে?

আমাদের আবাসনের লবিতে অনেকগুলো নোটিস পড়ল। প্রায় বোমা নিষ্ক্রিয় করার মতো পোশাক পরে ক’জন এসে পুরো আবাসনটা জীবাণুমুক্ত করলেন। বারোতলা বিল্ডিংয়ের অনেকগুলি পরিবারের সঙ্গেই কথা বলা হল। আর সর্বোপরি, নিজেদের পর্যবেক্ষণে রাখার এবং কোনওরকম প্রয়োজন দেখা দিলেই কর্তৃপক্ষ বা স্বাস্থকর্মীদের জানানোর নির্দেশ দেওয়া হল। তার পর কাটতে থাকল দিনগুলো। রোজ সকালে ঘুম ভেঙেই মনে হত, গলাটা কেমন ব্যথা করছে। ল্যাপটপে অফিসের কাজ করতে করতে মাথাটা একটু ধরলেই থার্মোমিটারটার দিকে তাকাতাম। রান্নার মশলার ঝাঁঝের হাঁচিকাশিটাও অস্বাভাবিক লাগতো যেন একটু। বাড়িতে জানাতে পারিনি খবরটা। মা-বাবা হয়তো চিন্তা করেই শরীর খারাপ বাঁধিয়ে ফেলতেন। জানিয়েছিলাম ১৪ দিন নির্বিঘ্নে অসুস্থতাহীন কাটাবার পরে।

কিন্তু নিশ্চিন্ত হওয়ার সময় যে তখনও আসেনি, তা ভালই বুঝেছিলাম। আমার স্বেচ্ছায় গৃহবন্দির দিনগুলো যখন শেষ হল, ভারতে তখন করোনা যুদ্ধের মোকাবিলায় লকডাউন ঘোষিত হয়ে গিয়েছে।

সত্যি কথা বলতে গেলে, বিগত এক মাস হংকংয়ে খবর পড়া প্রায় বন্ধই করে দিয়েছি। হংকংয়ে এখন আক্রান্তের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে গেলেও, আগামী এক মাস অফিস-স্কুলগুলি বন্ধ থাকলেও আমি জানি হংকং ঠিক সামলে নেবে। আমার চোখ আর মন এখন পড়ে থাকে ভারতের দিকে, বাংলার দিকে। আমার পরিবার, বন্ধু, আত্মীয় পরিজনেরা যেখানে লকডাউনে মনে আশঙ্কা নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন।

ভারতে এই মহামারি প্রবেশ করার অনেক আগে, পরিবারের শত-সহস্র অনুরোধ সত্ত্বেও দেশে ফিরিনি। কেন জানেন? চাইনি আমার পরিবারের উপর কোনও অনাকাঙ্খিত বিপদ ডেকে আনতে। আমার পাড়া, আমার হাঁটতে শেখার, বেড়ে ওঠার শহরটিতে একটি টাইম বোমা হিসেবে দেখা দেওয়ার ন্যূনতম আশঙ্কাটুকুও রাখতে চাইনি। প্রায় বার চারেক ফ্লাইটের আসন পছন্দ করেও শেষ মুহূর্তে ক্রেডিট কার্ডে পেমেন্টের ‘কনফার্ম’-এর জায়গায় ‘ক্যানসেল’ টিপেছি।

আরও পড়ুন: করোনা আতঙ্ক? স্বাস্থ্যকর্মীদের পর এ বার সাফাইকর্মীদের উপর হামলা মধ্যপ্রদেশে

দেশে ফেরার ইচ্ছা তো আমারও ছিল। কিন্তু নিজের কথা ভেবে ফেরার চেয়ে, দেশের কথা, দশের কথা ভেবে না ফেরাটাই উচিত মনে করলাম। ফ্রন্টলাইনে থাকা স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ বা জরুরি পরিষেবার কর্মীদের মতো না হোক, অন্তত এটুকুই না হয় আপনাদের সবার জন্য করলাম। আপনারাও কি পারবেন না কয়েকটা দিন কষ্ট করতে? দেখুন না চেষ্টা করে।

কে বলতে পারে হয়তো এই লেখাটি এখন পড়ছেন এমন এক জনের প্রয়াসেই করোনাভাইরাসের ধ্বংসলীলার 'চেইন'-টা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।

সৌরদীপ্ত সেন, হংকং

(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement