—প্রতীকী ছবি।
ঈশা দাশগুপ্তের প্রবন্ধ ‘এই ধ্বংসের দায়ভাগে’ (১-২)-র বক্তব্য প্রাসঙ্গিক। প্রবন্ধকার সঠিক ভাবেই বলেছেন, আমাদের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে রাজনীতির বোধকে জন্মাতে না দিয়ে আমরা একটি প্রজন্ম তৈরি করছি, যারা আত্মকেন্দ্রিক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করছে। এই প্রজন্মকে কেরিয়ার-সচেতন করতে গিয়ে তাদের মধ্যে সমাজ-সচেতনতায় ব্যাপক ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক কালের ঘটনাগুলি ছাত্রছাত্রীদের মনে কোনও প্রভাব ফেলে না। ফলে এই প্রজন্ম সুস্থ-সচেতন চিন্তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আমি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত। সাম্প্রতিক ঘটনাবলির ব্যাপারে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে উদাসীনতা চোখে পড়ার মতো। তাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় উপলব্ধি করেছি, তাদের বাড়িতে বা পারিপার্শ্বিক ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক ঘটনাবলি নিয়ে আলোচনা হয় না সেই ভাবে। আমরাও শিক্ষক হিসাবে তাদের দেশের বা বিশ্বের ঘটনা সম্পর্কে এবং সেগুলি চর্চার বিষয়ে সচেতন করতে পারিনি। এই অচলায়তন থেকে বেরিয়ে আসতে গেলে সাম্প্রতিক ঘটনাবলির উপর আলোচনা নিয়ে একটি পেপার পাঠ্য হিসাবে চালু করতে হবে। নতুন শিক্ষানীতিতে এটি অন্তর্ভুক্ত করা যায় কি না ভেবে দেখা যেতে পারে। আমরা যদি ছাত্রছাত্রীদের আর্থসামাজিক এবং রাজনৈতিক ভাবে সচেতন করতে না পারি, তবে আমরা একটি ভোগবাদী ইহকালসর্বস্ব প্রজন্ম তৈরি করব, তা বলা বাহুল্য।
সরোজ উপাধ্যায়, কলকাতা-৫০
দায় কার
‘এই ধ্বংসের দায়ভাগে’ প্রবন্ধ প্রসঙ্গে এই লেখা। ‘রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে চাই’ ভাষ্যটাই যে একটা মারাত্মক অর্থহীনতা বহনকারী, তা আমাদের মতো অভিভাবক, শিক্ষক বা গুরুজনরাও কত জন জানেন, ভেবে দেখার বিষয়। বাড়িতে আমাদের ছেলেমেয়েদের রোজ খবরের কাগজ পড়ার কথা অভিভাবকরা ক’জন বলি? অথচ, ২৫-৩০ বছর আগেও বিষয়টি এমন ছিল না। বাড়ির সবাই সে সময় দিনের কখনও না কখনও খবরের কাগজ পড়ত। নতুন জাতীয় শিক্ষানীতির উপর বক্তৃতা করার মতো জ্ঞান না থাক, এক জন মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার্থীর অন্তত নতুন প্রণয়ন করা নীতির বিশেষ বৈশিষ্ট্য বা লক্ষণীয় বিষয়ের উপর কিছু তথ্য জানা থাকবে— এটাই স্বাভাবিক ভাবনা। অথচ, বাড়িতে এ সব নিয়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে কোনও পড়ুয়া আলোচনা করলে অভিভাবকরা উৎসাহ দেন না।
এই পড়ুয়াদের বৃহত্তম অংশকে পড়াশোনা শেষে চলে যেতে হয় উপার্জনের ব্যবস্থা করার প্রতিযোগিতায়। এখন প্যাকেজ ব্যবস্থাপনাটাই সর্বস্ব। বেতন বা ওয়েজ বলতে কী বোঝায়, অধিকাংশ পড়ুয়ার চাকরির বাজারে আসার পরেও অজানা থাকে। সব আয় যে বেতন নয়, তা এ প্রজন্মের বেশির ভাগ নতুন চাকরি পাওয়া ছেলেমেয়েদের জানা নেই। যারা রাজনীতির সঙ্গে কখনও থাকেনি, তারা চাকরিতে এসে শ্রম আইন নিয়ে আগ্রহী হবে বা শ্রম বিরোধ হলে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে থাকবে, তা আশা করাই ভুল। এ ছাড়াও ব্যক্তিগত দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি শ্রম সংগঠনেরই তাত্ত্বিক ও সংগঠনের শেষ কথা বলা নেতাদের ছেলেমেয়েদের এমন বিশেষ বিষয়ে পড়াশোনা করানো হয়, তাতে বেসরকারি ক্ষেত্রে আধিকারিকের চাকরি ছাড়া অন্য পেশায় কর্মসংস্থানের কোনও সুযোগও থাকে না। সে কাজের মাধ্যমে শ্রমজীবী মানুষের সহায়তা হবে, এমন সুযোগও থাকে না। আজীবন সংগঠনের সঙ্গে নিবিড় ভাবে থেকে চাকরি করেছেন, এমন অনেকেই শ্রম সংগঠনের ত্রিসীমানায় ছেলেমেয়েদের যাওয়া থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেন।
বর্তমানে যুবসমাজ চাকরি ক্ষেত্রে কেবলমাত্র তাদের নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। নিজের ও নিজের বাইরে কোনও কিছুই ভাবার সময় নেই। এটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে।
গত শতাব্দীতে প্রথমে দেশ ভাগ এবং এর পর থেকে মোটামুটি ষাটের দশকের শেষের দিক থেকে যৌথ পরিবারগুলো ভাঙা, আশির দশকের শেষের দিক থেকে সরকারি চাকরিতে আয় বৃদ্ধি, নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে দেশের অর্থনীতিতে আমূল পরিবর্তন ও ঋণ পাওয়ার ঢালাও ব্যবস্থা এবং এর সুযোগ নিয়ে নিজের বাসস্থানের স্থায়ী ব্যবস্থা করা, বেসরকারি বহু সংখ্যক স্কুল চালু হওয়া, গ্রামীণ জনগণের বিভিন্ন কারণে স্থায়ী ভাবে শহরমুখী হওয়া, শহরের বস্তি, পুরনো বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাট তৈরি হওয়া, বাম রাজনৈতিক ধারার সঙ্গে সাধারণ মানুষের যোগাযোগ দ্রুত কমতে থাকা, ছাত্র যুবকদের আন্দোলন বিমুখ করে রাখা, দলীয় রাজনীতিতে দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষদের অবাধ বিচরণ প্রভৃতির সূচনা হয়। একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, শাসক দলগুলো সমাজে এই দ্রুত পরিবর্তনে প্রতি দিন সহায়ক ভূমিকা নিয়ে চলেছে। সুতরাং, রাজনৈতিক ক্ষমতার বলে শাসকদেরই সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষদের সামাজিক ন্যায়, নীতি, সংস্কৃতি রক্ষা করা ও তাকে আরও উন্নত করা এবং রাজনৈতিক ভাবে মানুষের মনের উন্নতি ঘটানোর দায়িত্ব বিশেষ ভাবে থেকে যায়।
বর্তমান ব্যবস্থা ও অনিয়মের মধ্যে এখনকার ছাত্রছাত্রীদের দোষ দেওয়া যায় না। এর দায়ভার বাংলার রাজনৈতিক দলসমূহের, যাদের বাংলার মানুষ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্তরের ভোটে উজাড় করা ভোট দিয়ে বিভিন্ন সময়ে জিতিয়েছে ও তাদের শাসনভার দিয়েছিল।
সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা-৫৯
চেতনার অভাব
ঈশা দাশগুপ্ত তাঁর প্রবন্ধে সঙ্গত ভাবেই আজকের সময়ে অধিকাংশ শিক্ষার্থীর ‘রাজনীতির বোধ’ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন। ‘রাজনীতি’ বিষয়টি নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইদানীং যে উদাসীনতা পরিলক্ষিত হচ্ছে, তাকে অনায়াসে বৃহত্তর সমাজের অস্বাস্থ্যকর চিত্র হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। সুস্থ রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার মানুষেরা সর্বদাই সমাজের নিয়মশৃঙ্খলা বজায় রাখতে সচেষ্ট থাকেন। দুর্ভাগ্যের বিষয়, বর্তমান সমাজে তার বড় অভাব। এখন এক দল মানুষ অর্থের বিনিময়ে নিজের রাজনৈতিক অবস্থান বিক্রি করে দিতেও প্রস্তুত। এরা সংখ্যায় বাড়লে সমাজের বিপদ। সেই রাষ্ট্রীয় বিপদ সম্পর্কে ছাত্রছাত্রীরা উদাসীন থাকবে, ভাবতে কষ্ট হয়। ভরসাযোগ্য রাজনৈতিক আশ্রয়স্থল ও নেতৃত্ব খুঁজে পাচ্ছে না বলে চোখ বুজে সব মেনে নেওয়াটাও যে এক ধরনের সুবিধাবাদ, এই সত্য শিক্ষার্থীদের দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়ার কথা নয়। রাজনৈতিক বোধের অভাবেই এমন ঘটে চলেছে। ‘সুবিধাবাদ’ জীবনের মন্ত্র হতে পারে না।
শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, পরিকাঠামো উন্নয়ন ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয় পুরোটাই নির্ভর করে দেশের সরকার পরিচালনাকারী রাজনৈতিক দলের নীতি ও সেই দলের শীর্ষ নেতার দৃষ্টিভঙ্গির উপর। এ দেশে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য যেমন ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে, তেমনই বৃদ্ধি পাচ্ছে ধর্মীয় ও জাতিগত মেরুকরণের প্রচেষ্টা। তবুও আমরা ‘অভিভাবক হিসাবে, শিক্ষক হিসাবে, গুরুজন হিসাবে ক্রমাগত শিখিয়ে গেলাম অন্যদের ভাল-মন্দ নিয়ে মাথা ঘামিয়ে সময় নষ্ট না করে আত্মকেন্দ্রিক হওয়ার মন্ত্র’।
আমরা বড়রা যদি ছোটদের শুধু পাঠ্যক্রমের পড়ালেখায় আবদ্ধ না রেখে, নিয়মিত সংবাদপত্র পাঠের দিকে একটু নজর দিতে শেখাতাম, তা হলে হয়তো এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হত না। আমাদের আত্মজ-আত্মজারা প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগের সুযোগ পেয়ে গেল বটে, কিন্তু তা সঠিক ভাবে প্রয়োগের জন্য যে রাজনৈতিক চেতনা ও বিচক্ষণতার প্রয়োজন, তা কি ওরা পেল? ফলে ওদের সমাজমাধ্যমের দ্বারা অতি সহজেই প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাচ্ছে। আর সে সুযোগটাই যে জাতপাত ও ধর্মের কারবারিরা নিতে শুরু করেছে, তার প্রমাণ আমরা প্রতিনিয়ত পাচ্ছি।
রতন রায়চৌধুরী, পানিহাটি, উত্তর ২৪ পরগনা