—ফাইল চিত্র।
‘অঙ্ক কষা শুরু’ (৬-৬) শীর্ষক দেবাশিস ভট্টাচার্যের প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। কেন্দ্রে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় বিজেপি যে দুর্বল হবে, এটা বলা বাহুল্য। এটা রাজনীতির অঙ্কের প্রশ্ন। কিন্তু যেটা খুব প্রয়োজনীয় সেটা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলছেন না। বঙ্গে তৃণমূল ২৯টি আসন পেয়েছে। তার পর কী হবে বঙ্গের? যা চলছে তাই? অর্থনীতি, শিল্পায়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান ও কর্মসংস্কৃতির কী হবে? বিজেপির হারে কি মরা গাঙে বান আসবে?
বিগত বারো বছর দান-অনুদানের প্রতিশ্রুতি যে ভাবে বেড়েছে, তার একাংশ কি মানুষের মৌলিক বিষয়ে কোনও অগ্রগতি লক্ষ করা গেছে? আমজনতা কি চিরকাল শুধু দান-অনুদান প্রকল্পের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকবে? সাধারণ মানুষদের অর্থনৈতিক ভাবে স্বনির্ভর করে তোলার কোনও প্রতিশ্রুতি কি থাকবে না? কেন রাজ্যের ছেলেমেয়েদের টাকার বিনিময়ে অবৈধ উপায়ে চাকরি পেতে হবে? কেনই বা যোগ্য চাকরিপ্রার্থীরা রাস্তায় দিনের পর দিন কাটাবে? এই মৌলিক প্রশ্নগুলির উত্তর কে দেবে?
মোদী কতটা বিপাকে পড়েছেন, তার বিশ্লেষণ করার থেকে বেশি জরুরি এই প্রশ্ন যে, এ রাজ্য থেকে শিক্ষিত ছেলেমেয়ে বা শ্রমিকরা বিদেশে বা অন্য রাজ্যে চলে যাওয়ার স্রোত এ বার বন্ধ হবে কি? ভোটের মনোনয়ন দেওয়ার দিন থেকে, ভোটের দিন ও ভোট-পরবর্তী হিংসা-প্রতিহিংসায় কেন বঙ্গভূমি রক্তে লাল হয়ে উঠবে? বিপুল জনসমর্থন পাওয়া সরকার থাকতে কেন আদালতকে সব বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে হবে?
দান-অনুদানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিপুল ভোটে জেতার চেয়ে মানুষের মৌলিক অধিকারগুলির নিশ্চয়তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচন হেরে যাওয়া বোধ হয় অনেক সম্মানের। রাজ্যে রাজ্যে রাজনৈতিক দলগুলির ক্ষমতা দখলের জন্য দান-অনুদানের প্রতিযোগিতা দেখলে মূর্ছা যেতে হয়। দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে মানুষকে দলের ক্রীতদাস করে রাখাটাই যেন মুখ্য উদ্দেশ্য। ভোট দিলে অনুদান, নইলে বন্ধ— এই কি নীতি? শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, বাসস্থান, সামাজিক সুস্থ চেতনা— এ সব আর রাজনীতির মুখ্য বিষয় নয়। মানুষকে আজ আওয়াজ তুলতে হবে। দান-অনুদানের প্রতিশ্রুতি আর নয়, কবে আমরা অর্থনৈতিক ভাবে স্বনির্ভর হব, সেই প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। অনুদানের ভিক্ষা নয়, সম্মানের রোজগার চাই।
মিহির কানুনগো, কলকাতা-৮১
দুর্বল বিজেপি
দেবাশিস ভট্টাচার্য সত্যিটাই বলেছেন— এখনই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপযুক্ত সময় ঘর গুছিয়ে নেওয়ার, রাজ্য রাজনীতি হোক বা জাতীয় রাজনীতি। উনি কখন কোন দিকে যাবেন, তা জানা অসম্ভব। এক সময় এনডিএ-র শরিক ছিলেন, প্রয়োজন ফুরোতে জোট ছেড়েছেন এবং ইউপিএ-তে যোগ দিয়েছিলেন, পরবর্তী কালে তা-ও ছেড়েছেন। এখন দেখার, তিনি কতটা অঙ্ক কষতে পারেন ২৯টা সিট নিয়ে?
রাজ্যে বিজেপির ব্যর্থতার কারণ সাংগঠনিক দুর্বলতা, ভুল প্রার্থী নির্বাচন, অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস, দিল্লি-নির্ভরতা, অকারণে বিভিন্ন পর্যবেক্ষক নিয়োগ এবং সংগঠনের কাঠামো বার বার পরিবর্তন। সেই সঙ্গে, নিচুস্তরে সংগঠন মজবুত করা ও বুথস্তরে প্রচারের বদলে বেশি মাত্রায় সাংগঠনিক বৈঠকে সময় নষ্ট করা। সাংগঠনিক দুর্বলতা এমন স্তরে পৌঁছেছে যে দেখা গিয়েছে ৫০% ক্ষেত্রে ৬-৭ কিলোমিটারের মধ্যে কোনও পার্টি অফিস নেই, ভোটের সময় কোনও ঘর কিছু দিনের জন্যে ভাড়া নিয়ে কর্মী-সমর্থকদের কাজ চালাতে হয়। নতুন-পুরনো দ্বন্দ্বও দলকে দুর্বল করেছে। সেই সঙ্গে রয়েছে প্রতিযোগী দলের বুথ স্তরে প্রচার, তা যতই মিথ্যা হোক না কেন? যেমন— সিএএ নিয়ে গ্রামের একটা সম্প্রদায়কে বোঝানো যে, এটা চালু হলে তোমাদের দেশ ছেড়ে যেতে হবে, একশো দিনের টাকা কোনও কারণ ছাড়াই আটকে রেখেছে কেন্দ্র, গরিব মানুষকে ভাতে মারার চেষ্টা করছে, ইত্যাদি। সবার উপর লক্ষ্মীর ভান্ডারে অনুদানের অঙ্ক ৫০০ টাকা থেকে ১০০০ টাকায় নিয়ে যাওয়া মহিলাদের উপর ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
রাজ্য সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি সত্ত্বেও ভোটে তার কোনও প্রভাব যদি না পড়ে, তা হলে মেনে নিতেই হবে ‘মমতা ম্যাজিক’ বলে কিছু আছে। যদি বিজেপি দল বিরোধী হিসেবে আরও ভাল কাজ প্রদর্শন করে, তা রাজ্যবাসীর পক্ষে মঙ্গলের।
স্বপন চক্রবর্তী, জগৎবল্লভপুর, হাওড়া
বামের ভোট
তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উচিত এ বার সিপিএমকে ধন্যবাদ দেওয়া। লোকসভা ভোটে অনেকগুলো আসন বিজেপির থেকে ছিনিয়ে নিতে বামেরা তৃণমূলকে সাহায্য করেছে। গত বার বামের বিস্তর ভোট রামে গিয়েছিল। এ বার বামেরা কংগ্রেসকে সঙ্গে নিয়ে নাকি যুবশক্তির উপর ভর করে প্রবল বেগে ঘুরে দাঁড়াবে, এমনই ভরসা করেছিল তারা। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটল কই, প্রচণ্ড লড়াই করে ভাঁড়ারে সেই শূন্য। ভোটের শতকরা হিসাবে সামান্য বৃদ্ধি ঘটলেও এ বার সিপিএম ‘ভোট কাটুয়া’ হয়ে অন্যের সুবিধা করে দিয়েছে। এ কথা অস্বীকার করার জো নেই যে, যুবপ্রার্থীরা খুব খেটেছেন, সভা সমাবেশে ভিড়ও হয়েছে চোখে পড়ার মতো। কিন্তু জয় তো দূরের কথা, প্রায় সব জায়গায় ভাল ভোট টেনে তৃতীয় স্থানে রইল সিপিএম। এর ফলেই বিজেপির কাছ থেকে আসন ছিনিয়ে নিয়েছে তৃণমূল। সিপিএম এতে একটা সান্ত্বনা অবশ্য পেতে পারে, তাদের জাতশত্রু বিজেপির ক্ষমতা কিছুটা কমাতে পেরেছে বাংলায়। কিন্তু তাদের নিজের লাভ কিছু হয়নি। তৃণমূল না বিজেপি, কে যে বেশি বড় শত্রু, সে কথা মানুষকে তারা বোঝাতে পারেনি, নিজেরাও বোধ হয় ঠিক বোঝে না। বামেদের রক্তক্ষরণ আরও কত দিন চলবে, জানা নেই।
অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা-৮৪
সেই শূন্য
ভোট আসে ভোট যায়, তবু এ রাজ্যে সিপিআইএম দলের আসনসংখ্যা শূন্যই থেকে যায়। কেন এমন দশা? সিপিএম প্রার্থীদের জয়ের সম্ভাবনা উধাও হয়ে গেল কেন? মানুষ তো তাঁকেই ভোটে জেতান, যিনি শক্তিশালী কোনও দলের প্রার্থী, এবং যাঁর জয়লাভের সম্ভাবনা আছে। রাজনীতির জগতে যথেষ্ট অবদান আছে এবং লড়াকু নেতা হিসেবে যাঁর গুরুত্ব অনস্বীকার্য, মানুষ তেমন প্রার্থীকেও জয়ের তালিকায় দেখতে চান। বাস্তবিক, সিপিআইএম দলে এ ধরনের প্রার্থী আজ বিরল।
এ রাজ্যের রাজনৈতিক চিত্রটা কী? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক জন দুর্ধর্ষ জননেত্রী এবং তুমুল জনপ্রিয় মুখ্যমন্ত্রীও বটে। জনগণের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে তিনি আজও এক এবং অদ্বিতীয়। সরকারবিরোধী ক্ষোভ কিংবা অসন্তোষ নেই তা নয়, কিন্তু অনুদান-রাজনীতির সাফল্য সে ক্ষোভকে নিষ্ক্রিয় করে রাখে। সে কারণে শাসক-বিরোধী আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে না, তেমনটা গড়ে ওঠার সম্ভাবনা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যায়। আসন না থাকায় বিধানসভার ভিতরেও সিপিআইএম দলের ভূমিকা নেই। অতীতে বামের ভোট রামে যাওয়ার রসায়ন গড়ে উঠেছিল কারণ, শাসক দলের আক্রমণে ভীত মানুষ দল নির্বিশেষে বিজেপি দলেই আশ্রয় খুঁজেছিলেন। পরিস্থিতি কিছুটা বদলেছে বটে, তবে আক্রান্ত মানুষ সিপিআইএম দলে ভরসা খুঁজছেন এমন কথা বলা যাবে না। তৃণমূল সরকারের আমলে সিপিআইএম এমন কোনও দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি, যাতে দলে রাজ্যের বিপুলসংখ্যক মানুষের বলভরসা হয়ে উঠতে পারে। এ সমস্ত কারণে রাজ্যে সিপিআইএম দলের যথার্থ প্রয়োজন বা প্রাসঙ্গিকতা গড়ে ওঠার প্রক্রিয়াটাই থমকে গেছে। সংগঠনের হাল ফিরেছে, মিটিং-মিছিলে মানুষের ভিড়ও হচ্ছে, কিন্তু জননেতার অভাবে দল আস্থাযোগ্য হয়ে উঠতে পারছে না।
শিবাশিস দত্ত, কলকাতা-৮৪