হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। —ফাইল চিত্র।
দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের ‘জোর করে শুদ্ধ সংস্কৃত দরকার নেই’ (রবিবাসরীয়, ৩-১২) শীর্ষক প্রবন্ধ-সূত্রে কিছু কথা। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ভাষারীতি অতীব প্রশংসনীয় হলেও কেউ কেউ তার মধ্যে দুর্বলতা খুঁজে পেয়েছিলেন। গুরুতর প্রবন্ধ লেখার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত তাঁর মজলিশি, আলাপচারী ভাষা কখনও কখনও বিষয়ের গুরুত্ব কমিয়ে দিত বলে তাঁদের অভিমত। তাঁরা আরও লক্ষ করতেন মননের গভীরতা ও বৈচিত্রের অভাব। তবে লেখার সময় ব্যবহৃত তাঁর বৈঠকি ধরনের হালকা চালের ভাষা ফরাসিরা পছন্দ করতেন। আর তাঁর বাংলা ভাষা সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বিশিষ্ট ভাষাবিদ সুকুমার সেন লিখেছিলেন, “...মোটামুটিভাবে হরপ্রসাদ বঙ্কিমচন্দ্রের অপেক্ষাও ভালো— অর্থাৎ সহজ সরল সতেজ ও তীক্ষ্ণ— বাংলা লিখতেন।” এ প্রসঙ্গে ‘ভারতমহিলা’, ‘বাল্মীকির জয়’ প্রভৃতি মৌলিক গদ্য রচনা ছাড়াও বিশেষ ভাবে উল্লেখ করতে হয় তাঁর ‘মেঘদূত ব্যাখ্যা’, ‘প্রাচীন বাংলার গৌরব’ প্রভৃতি রচনার কথা।
সংস্কৃত কলেজের সেরা ছাত্র (পরবর্তী কালে অধ্যক্ষ) হরপ্রসাদ সংস্কৃত শাস্ত্রসংহিতা, সাহিত্য-সহ ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব প্রভৃতি বিভাগেও পদচারণা করেছিলেন অবলীলায়। হয়েছিলেন ঢাকা ইউনিভার্সিটির সংস্কৃত ও বাংলার প্রধান। আবার বিদ্যাসাগরের আশীর্বাদ নিয়ে পড়াতে গিয়েছিলেন লখনউয়ের ক্যানিং কলেজে। তাঁর মানসিক চরিত্র গঠনে এই মানুষটির গভীর প্রভাব ছিল। বিচিত্র বিষয়ের পুঁথি সংগ্রাহক মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর অভাবনীয় আবিষ্কার ‘চর্যাপদ’ হলেও তিনি কিন্তু ‘চণ্ডীদাস সমস্যা’-র সমাধানেও এগিয়ে এসেছিলেন। দীনেশচন্দ্র সেন এক জন চণ্ডীদাসের কথা বললেও, তিনি কিন্তু মনে করতেন তিন জন চণ্ডীদাস ছিলেন— বড়ু চণ্ডীদাস (চৈতন্য-পূর্ব), পদাবলির চণ্ডীদাস (চৈতন্য-পূর্ব) এবং দীন চণ্ডীদাস (চৈতন্য-পরবর্তী)। আবার বাংলার গ্রাম-গ্রামান্তরে ঘুরে ধর্মমঙ্গল, ধর্মঠাকুরের ছড়া বিষয়ক নানা পুঁথি আবিষ্কার করে তিনি অনুমান করেছিলেন ধর্মঠাকুর বৌদ্ধধর্মের প্রচ্ছন্ন রূপ, হয়তো বৌদ্ধ দেবতা। যে ‘ভারতমহিলা’ প্রবন্ধ লিখে সংস্কৃত কলেজের মেধাবী তরুণ হরপ্রসাদ ‘হোলকার’ পুরস্কার জিতেছিলেন, সে লেখা প্রাথমিক ভাবে যোগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বিদ্যাভূষণের আর্যদর্শন-এ পাঠিয়ে তিনি প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন। পরবর্তী কালে বঙ্কিমচন্দ্র সেই লেখাকেই ‘কাঁচা সোনা’ ভেবে ছেপেছিলেন নিজের বঙ্গদর্শন-এ। দুর্ভাগ্যের যে, জ্ঞানে প্রতিভায় অনন্যসাধারণ হরপ্রসাদ শাস্ত্রীকে আজ আমরা ভুলতে বসেছি।
সুদেব মাল, খরসরাই, হুগলি
বিতর্কিত
অমিতাভ গুপ্তের ‘ধ্বংসের ধারাবিবরণী’ (৬-১২) শীর্ষক প্রবন্ধ দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন প্রতিটি নাগরিকের কাছে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে গান্ধী হত্যার পর অন্যতম হিংসাত্মক ঘটনা হল যে দিন বাবরি মসজিদ উন্মত্ত জনতার হাতে ধূলিসাৎ হয়েছিল। ২০১৯ সালে সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের রায়ে বিবাদের মীমাংসা হয়েছে। মহামান্য আদালতের রায় শিরোধার্য। মহাসমারোহে রামমন্দির উদ্বোধনের শুভ দিন আসন্নপ্রায়।
মধ্যযুগে সামন্তরাজাদের কাছে ধনসম্পদ লুকিয়ে রাখার নিরাপদ ভল্টের নাম ছিল মন্দির। ধর্মের সঙ্গে যখন থেকে রাজশক্তির মিলন ঘটেছে, বাইরের শত্রুর আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠেছে মন্দির, মসজিদ, গুরুদ্বার, গির্জা। ১৫২৮ সনে বাবরের সেনাপতি মির বাকি অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। এবং কোনও মন্দির ভেঙে তা নির্মিত হয়েছিল কি না, এ ব্যাপারে কোনও সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক উল্লেখ পাওয়া যায়নি। অন্য দিকে, ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত বিদ্রোহে অযোধ্যার নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের পৃষ্ঠপোষকতার বিশেষ ভূমিকা ছিল। এই যৌথ সংগ্রামে চিড় ধরানোর লক্ষ্যে রাম জন্মভূমি-বাবরি মসজিদ নামক ধর্মীয় বিভাজনের পরিকল্পনা করা হয়েছিল বলে এক শ্রেণির ইতিহাসবিদের অভিমত। ১৮৫৯ সালে ব্রিটিশ সরকার বেড়া দিয়ে দুই ধর্মের উপাসনাস্থল পৃথক করে দিয়েছিল এই বিভাজন জিইয়ে রাখার লক্ষ্যে।
১৮৮৫ সালে মোহন্ত রঘুবীর দাস তৎকালীন স্বরাষ্ট্রসচিবের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে চবুতরা চত্বরে একটি ছোট্ট মন্দির নির্মাণের আবেদন জানিয়েছিলেন। তাঁর এই আবেদন খারিজ করে তৎকালীন সাব জজের পর্যবেক্ষণ ছিল, তিনশো বছর আগে যে মসজিদ তৈরি হয়েছে, যদি ধরেও নেওয়া যায় মন্দির ভেঙেই তা তৈরি, তথাপি তিনশো বছর পর পরিস্থিতি বদল করে দেওয়া যায় না। ১৯৪৯-এর ডিসেম্বরের রাতের অন্ধকারে কে বা কারা মসজিদের অভ্যন্তরে রামলালার বিগ্রহ স্থাপন করে আসে। পণ্ডিত নেহরু নির্দেশ দিয়েছিলেন মূর্তিটি বাইরে বার করে নিয়ে আসার জন্য। কিন্তু প্রশাসনে হিন্দুত্ববাদীদের প্রভাবের জন্য তাঁর সেই নির্দেশ কার্যকর হয়নি। মসজিদে তালা ঝোলানো হয়। ১৯৮৬ সালে রাজীব গান্ধী সেই তালা খুলে দিয়ে বিতর্কিত স্থানে শিলান্যাসের অনুমতি দেওয়ায় রামজন্মভূমি পুনরুদ্ধারের আন্দোলন বল্গাহীন হয়ে ওঠে। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর ঘণ্টা চারেকের অপারেশনে সৌধ ধূলিসাৎ হয়। ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১০ সালে ইলাহাবাদ হাই কোর্টের লখনউ বেঞ্চের রায়ে বিতর্কিত জমি তিন টুকরো করে হিন্দু, মুসলিম ও নির্মোহী আখড়ার মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হল। ইতিমধ্যে মসজিদ ভাঙার নেপথ্য ঘটনা উন্মোচনের জন্য গঠিত লিবারহান তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা পড়েছে। কিন্তু কোনও এক অজ্ঞাত কারণে জনসমক্ষে আসেনি। হাই কোর্টের রায় পছন্দ না হওয়ায় মামলা সুপ্রিম কোর্টে। অবশেষে ২০১৯ সালে বিবাদের নিষ্পত্তি।
তাই দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে এবং আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রাপ্ত রামের জন্মস্থানে গড়ে ওঠা রামমন্দিরের উদ্বোধন রুটিরুজি, সম্প্রীতির অভাবজনিত মৌলিক প্রশ্নকে জোয়ারের জলে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে— এটাই স্বাভাবিক। অন্তরের বেদনা লুকিয়ে রেখে দেশের কুড়ি কোটি মুসলমানকে এই আধিপত্যের জাঁকে সুর মিলিয়ে জাতীয়তাবাদী হয়ে ওঠার পরীক্ষায় বসতে হবে।
সরিৎশেখর দাস, কলকাতা-১২২
শিশুমেধ
‘মৃত্যুর প্রহর গুনছে শৈশব’ (১২-১২) শীর্ষক মালবী গুপ্তের প্রবন্ধটি তথ্যভিত্তিক। শিশুমৃত্যুর এমন পরিসংখ্যানে আমরা শঙ্কিত। ঘৃণা, প্রতিহিংসা কোথায় পৌঁছলে আমরা এমন নিষ্ঠুর হয়ে উঠতে পারি, তা ভাবার দিন কি এখনও আসেনি?
চায়ের দোকানে আড্ডা চলছিল। বিষয় ছিল প্যালেস্টাইন আর ইজ়রায়েলের চলমান সংঘর্ষ। হঠাৎ এক জন বলে ওঠেন “আরে, এই জাতটাই এমন। নিজের ওজন না বুঝে যুদ্ধে নেমেছে।” অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, কেন করল আক্রমণ, জানেন কি বিষয়টি? প্যালেস্টাইন স্বাধীন হলেও পরাধীন। ইজ়রায়েল তাদের স্বাধীন জীবনযাপনের অধিকার দেয়নি। প্যালেস্টাইনের চতুঃসীমা অবরুদ্ধ করে রেখেছে দশকের পর দশক। তাদের অর্থনৈতিক দিক থেকে পঙ্গু করে রেখেছে। আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার রক্ষার্থেই অতর্কিতে এই আক্রমণ। কানে এল নানা তির্যক মন্তব্য। কথা না বাড়িয়ে ফিরে এলাম।
ইজ়রায়েলি যুদ্ধবিমান লোকালয়, স্কুল, শরণার্থী শিবির আর হাসপাতালগুলোকে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। অদূরদর্শীদের অভিমত, জঙ্গি হামাসদের তো ওখানেই আত্মগোপনে সাহায্য করেছে প্যালেস্টাইনিরা। ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’ সংস্থার মতে, ২০১৯ থেকে পৃথিবীতে ঘটে চলা সমস্ত যুদ্ধ বা সংঘর্ষে বছরে যত শিশুর মৃত্যু হয়েছে, ৭ অক্টোবর শুরু হওয়া সংঘর্ষে শুধু গাজ়া স্ট্রিপেই মাত্র তিন সপ্তাহে ইজ়রায়েলি হানায় নিহত হয়েছে তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি।
যেখানেই যত যুদ্ধ বা সংঘর্ষ, তার মূলে আছে অর্থনীতির দখলদারি, ফ্যাসিবাদ। বিবেকহীন শাসকদের লাগাতার এই সংঘর্ষে শুধু শিশুর মৃত্যু নয়, যারা বেঁচে থাকে তাদের মনের উপর ভয়ঙ্কর প্রভাব পড়ে। তথ্য বলছে, গাজ়ায় প্রতি পাঁচ জন শিশুর মধ্যে চার জনই আতঙ্কিত, মানসিক বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত। মা-বাবা হারানো শিশুদের সংখ্যাও সংখ্যাতীত। লক্ষ লক্ষ শিশুর এ ভাবে বাঁচার অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। আমরা আজও পথে নামিনি, কারণ আমরা শঙ্কিত নই। এ সব আমাদের এখন গা-সওয়া। বিবেকের দংশনকে ধামাচাপা দিয়েছি; ধামাচাপা দিয়েছি আমাদের মনুষ্যত্বকে।
সূর্যকান্ত মণ্ডল, কলকাতা-৮৪