প্লাস্টিক ব্যবহারের পরিণতি ভয়ঙ্কর হতে পারে। —ফাইল চিত্র।
কল্যাণ রুদ্রের ‘প্লাস্টিক নামক ব্যাধি’ (৫-৬) প্রবন্ধটির পরিপ্রেক্ষিতে এই পত্রের অবতারণা। আমি রাজপুর সোনারপুর পুরসভা অঞ্চলের বাসিন্দা। এই অঞ্চলের প্রায় প্রতিটি দোকান-বাজারে চলছে নিষিদ্ধ প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগের লেনদেন। অথচ, রাজ্য সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী ১ জুলাই, ২০২২ থেকে ৭৫ মাইক্রনের কম পুরু প্লাস্টিক বন্ধ হওয়ার কথা ছিল। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পরিষদের নির্দেশিকা অনুসারেই প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগের এই ব্যবহারযোগ্য মাপ ঠিক করে দেওয়া হয়েছিল। নির্ধারিত দিনটি থেকে বেশ কিছু দিন কড়া পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা চালু ছিল। ফলে অবৈধ প্লাস্টিকের ব্যবহারের উপর অনেকাংশেই রাশ টানা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু জানুয়ারি, ২০২৩ থেকে ফের আগের অবস্থা ফিরেছে। নির্দেশিকা পালিত হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখার প্রায় কোনও পর্যবেক্ষণই নেই। পুরসভার ৩৫টি ওয়র্ডে প্রায় সাড়ে চার লক্ষ মানুষের বসবাস। সহজেই অনুমান করা যায়, প্রতি দিন কী পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য এই অঞ্চলে উৎপাদিত হচ্ছে।
স্থানীয় দোকানদারদের কিছু বললে তাঁরা বলছেন, ৭৫ মাইক্রনের কম পুরু ক্যারিব্যাগের উৎপাদন এত বেশি যে, তাঁরা চাইলেও ব্যবহার বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে বাধ্য হয়েই তাঁরা ‘অবৈধ’ ক্যারিব্যাগ ব্যবহার করছেন। দু’টি প্রশ্ন। এক, কেন নির্দেশিকা জারি করার পর, বাস্তবে তা পালিত হচ্ছে কি না দেখার জন্য নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে না? দুই, সরকার থেকে কেন অবৈধ ক্যারিব্যাগের উৎপাদন কেন্দ্রগুলি সম্পর্কে খোঁজ নেওয়া এবং উৎপাদন বন্ধের জন্য উদ্যোগ করা হচ্ছে না?
সম্প্রতি ‘নিষিদ্ধ প্লাস্টিকের আঁতুড়’ (১৯-৫) শীর্ষক প্রতিবেদনে উল্লিখিত হয়েছে যে, কেন্দ্রীয় পরিবেশ, বন এবং জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গ, বিহার এবং দিল্লিতে এখনও নিষিদ্ধ প্লাস্টিক তৈরি হচ্ছে, এবং তা সরবরাহ হচ্ছে অন্য রাজ্যগুলিতেও। কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ অভিযান চালিয়ে যে ৭৭টি বেআইনি প্লাস্টিক প্রস্তুতকারী সংস্থাকে চিহ্নিত করেছে, তার মধ্যে ৬০টিই এই রাজ্যের। চিহ্নিত হওয়ার পরও কেন এই কারখানাগুলির বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হচ্ছে না?
এর আগেও, প্লাস্টিকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের জন্য রাজ্য এবং স্থানীয় প্রশাসনের তরফ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ করা হয়েছে। স্থানীয়দের প্লাস্টিকের ভয়ঙ্কর প্রভাব নিয়ে সচেতন করার জন্য আয়োজিত হয়েছে বিভিন্ন শিক্ষামূলক শিবিরও। কিন্তু অবৈধ প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগের উৎপাদন ব্যবস্থা বহাল থাকার দরুন, শেষ অবধি প্রায় সব উদ্যোগই, কার্যত পরিণত হয়েছে প্রহসনে। তার সুযোগ নিয়ে চলেছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। কল্যাণ রুদ্রের প্রবন্ধটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে, যথেচ্ছ প্লাস্টিক ব্যবহারের পরিণতি কী ভয়ঙ্কর হতে পারে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অবিলম্বে যথোপযুক্ত ব্যবস্থার আবেদন রাখছি।
রাজীব রায় গোস্বামী, সোনারপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
শুধু পরিসংখ্যান
কল্যাণ রুদ্রের প্রবন্ধটিতে আশা করা গিয়েছিল, প্লাস্টিক দূষণ-সংক্রান্ত গত বছর জুলাই মাসের রাজ্য সরকারের নির্দেশিকা, এবং তার পরবর্তী পদক্ষেপ কার্যকর করার বিষয়টি নিয়ে তিনি অন্তত কয়েক লাইন ব্যয় করবেন। বদলে তাঁর ‘প্লাস্টিক নামক ব্যাধি’ শীর্ষক প্রবন্ধে যা পাওয়া গেল, তা কিছু পরিসংখ্যান মাত্র। যেমন ভারতে বছরে ৩৬ লক্ষ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন হলেও, আমাদের রাজ্যে এর পরিমাণ মাত্র তিন লক্ষ টন।
এ সব পরিসংখ্যানের আড়ালে লুকিয়ে থাকে আরও অনেক বাস্তব তথ্য। যেমন, সরকারি লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্লাস্টিক উৎপাদন কারখানার বাইরে অনুমোদনহীন কারখানার সংখ্যা অনেক বেশি। কল্যাণবাবু লিখেছেন, পরিবর্তিত আইন অনুযায়ী অনুমোদিত কারখানাগুলিকে নিজেদের উৎপাদিত দ্রব্যের পুনর্ব্যবহারের ব্যবস্থা করতে হবে। তা হলে, এই যে বিপুল পরিমাণ ‘সিঙ্গল-ইউজ়’ প্লাস্টিকের দ্রব্য, ক্যারিব্যাগ ইত্যাদি তৈরি হচ্ছে, এবং বাজারজাত হচ্ছে, তার গতি কী হবে? সে বিষয়ে কোনও দিকনির্দেশ পাওয়া গেল না। গত বছর জুলাই ও ডিসেম্বরে যে দু’টি বিশদ নির্দেশিকার মাধ্যমে সমস্ত ধরনের প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগ ও অন্যান্য দ্রব্য নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, সেই দুই নির্দেশিকা কত দূরকার্যকর হয়েছে, অথবা কার্যকর করার জন্য কী প্রশাসনিক ব্যবস্থা করা হয়েছে, তারও যথাযথ দিশা পাওয়া গেল না।
কম মাইক্রনের ক্যারিব্যাগ নিষিদ্ধ করতে হলে গোড়াতেই ঘা দেওয়া উচিত। অর্থাৎ, এই ধরনের ক্যারিব্যাগ উৎপাদন কেন্দ্রগুলিই বন্ধ করে দেওয়া দরকার। পরিবেশবান্ধব ব্যাগ ইতিমধ্যেই চালু আছে, কিন্তু অবৈধ প্লাস্টিকের ব্যাগের তুলনায় সেগুলি দামি বলে বাজারে কম ব্যবহার হয়। পরিবেশবান্ধব ব্যাগ গ্রামে বা শহরে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, সমবায় সমিতি বা স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির মাধ্যমে উৎপাদিত হলে বেকার সমস্যার কিছুটা সুরাহা হবে। পাশাপাশি, বিপুল পরিমাণে উৎপাদিত হলে দামও অনেকটাই কমবে, এবং পুনর্ব্যবহারের পদ্ধতির হ্যাপা পোহাতে হবে না। ধীরে ধীরে এটি বাধ্যতামূলক করা হলে কম মাইক্রন বা ‘সিঙ্গল ইউজ়’ প্লাস্টিকের ব্যবহার অনেকটাই কমানো সম্ভব হতে পারে। এ ছাড়া প্রতিটি গ্রামে ও মফস্সলে ‘বায়ো-মাইনিং’ বা বর্জ্যকে পরিবেশ উপযোগী করে তোলার জন্য বহুসংখ্যক কারখানা স্থাপন অত্যন্ত জরুরি। এক বার চালু হলে এই সমস্যার অনেকটাই মোকাবিলা করা যাবে।
শেষে একটা কথা বলা জরুরি। শুধুমাত্র প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগ বা বোতল নয়, পান, জর্দা, গুটখা, লজেন্সের মোড়ক, ওষুধের মোড়ক ইত্যাদি অসংখ্য নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যে প্লাস্টিকজাত সামগ্রীর বহুল ব্যবহার হয়। বায়ো মাইনিং পদ্ধতিতে কি এই জাতীয় অপচনশীল বস্তুগুলিরও সদ্গতি হওয়া সম্ভব? কারণ, অনেক ক্ষেত্রেই প্লাস্টিকের মোড়কের সঙ্গে অ্যালুমিনিয়াম বা অন্য কোনও বস্তুর আস্তরণ থাকে, যা পৃথক করা ব্যয়সাধ্য। আর একটি কথা— দুধের পাউচ অনেক শক্ত জাতের প্লাস্টিকের তৈরি, কিন্তু ব্যবহারের ক্ষেত্রে পাউচের কোণের কাটা টুকরোগুলি অন্যান্য আবর্জনার সঙ্গে মিশে যায়। এর পৃথকীকরণ সহজ নয়। আপাতত আমাদের সমস্যার আশু সমাধানের জন্য অনেক বেশি পরিমাণে পুনর্ব্যবহার করার প্লান্ট স্থাপন করা দরকার।
সুকান্ত মুখোপাধ্যায়, হাওড়া
দুর্বিষহ দূষণ
সরকার ও প্রশাসনের নির্দেশ অমান্য করে খোলা বাজারে এক বার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের রমরমা বেড়েছে, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় সঠিক বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ ব্যবস্থা না থাকায় নদ-নদী, জলা, পুকুরের পাড়ে, কোথাও বা জমিতে ফেলার দরুন জীবনযাত্রা দুর্বিষহ আকার ধারণ করেছে। পরে সেগুলিকে পুড়িয়ে ফেলার ভয়াবহ প্রবণতা দূষণ বাড়াচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে জলজ বাস্তুতন্ত্র, জীববৈচিত্র ও কৃষিকাজের উপরে কুপ্রভাব পড়ছে।
শহরের অবস্থাও খারাপ, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সঙ্গে প্লাস্টিক যেমন জড়িয়ে রয়েছে, তেমনই নানান ধরনের প্যাকেটজাত পণ্যদ্রব্যের সঙ্গেও ওতপ্রোত ভাবে প্লাস্টিকের ব্যবহার বেড়েছে। এ সব যত্রতত্র পড়ে থাকার জন্য নিকাশি ব্যবস্থাও সমস্যার মুখে পড়েছে। তাই কলকাতা, হাওড়ার মতো শহরে একটু বৃষ্টিতেই জল জমে জীবনযাত্রা বিপন্ন হচ্ছে। মূল সমস্যা হল, প্লাস্টিক উৎপাদন ও খোলা বাজারে প্লাস্টিকের জোগান। এই বিষয়ে সরকারকে আরও কঠিন পদক্ষেপ করতেই হবে। বিভিন্ন সরকারি অফিস, স্কুল, কলেজ ও বাজারগুলিকে প্লাস্টিকশূন্য এলাকা হিসাবে চিহ্নিত করতে হবে।
সর্বোপরি, বিধি লঙ্ঘন করলে জরিমানার ব্যবস্থা করতে হবে। পরিবেশ দফতর, জেলা প্রশাসন, বিভিন্ন কর্পোরেশন ও পঞ্চায়েতগুলিকে একত্রিত হয়ে আরও কঠিন পদক্ষেপ করতে হবে। তবেই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব।
সম্রাট মণ্ডল, হাওড়া