—ফাইল চিত্র।
গৌতম চক্রবর্তী তাঁর প্রবন্ধে (‘উন্নয়নের সড়ক এমনই নিষ্ঠুর’, ৩০-১১) উন্নয়নের ‘পাক্বী সড়ক’-এর যে ছবি তুলে ধরেছেন, তা যে কোনও সচেতন মানুষকে স্পর্শ করবে। হিমালয়ের উপর যে চরম অত্যাচার সাম্প্রতিক কালে চলছে, তার হাতে-গরম প্রতিক্রিয়ার ছবি অনেক। এই অবস্থাতেও রাষ্ট্র নির্বিকার, বিরোধী শক্তি দুর্বল, ছন্নছাড়া, বাক্শক্তিহীন বুদ্ধিজীবী-সমাজকর্মী, জনসমাজের অবস্থাও সেই রকমই।
এই কঠিন সময়ে দাঁড়িয়ে শিকড়ে ফিরে তাকানো জরুরি। ‘ইকোলজি’ বা প্রাকৃতিক সমতাবিজ্ঞান আমাদের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক নির্ণয় করে। প্রকৃতির দেওয়া পরিবেশ জীবনের সহায়ক, তার উপাদানগুলির মধ্যে রয়েছে গভীর আন্তঃসংযোগ। পাশাপাশি, প্রাচীন কাল থেকে বিশ্বের নানা ধর্ম-দর্শনেও ঈশ্বরের সঙ্গে মানুষের সংযোগের স্থল হিসাবে প্রকৃতিকে দেখা হয়েছে। পৃথিবীকে মা বলে কল্পনা করার রেওয়াজটি বহু প্রাচীন। প্রকৃতির কাছে আমরা যা পাচ্ছি, তাকে আবার যজ্ঞরূপে দান করতে হবে তাকেই, বলা হয়েছে ধর্মের উপদেশে। বেশ কয়েক বছর আগের এক হিসাবে দেখা যায়, প্রকৃতি থেকে মানুষ প্রতি বছর যা কিছু গ্রহণ করে, তার আর্থিক মূল্য ৩৩ ট্রিলিয়ন ডলার। এই অঙ্ক সমস্ত দেশের গড় জাতীয় উৎপাদনের দ্বিগুণ। বলা বাহুল্য, এই পরিসংখ্যান ক্রমবর্ধমান। কিন্তু প্রতিদান কোথায়? সে কথাটা বেশি করে আলোচিত হওয়া দরকার। রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপের পাশাপাশি, আমাদের দৈনন্দিন জীবনচর্যাতেও তা যুক্ত হওয়া দরকার।
মানুষকে প্রতিনিয়ত সচেতন ভাবে মনে করতে হবে তার নিজস্ব কিছুই নেই। জীবজগতের উদ্ভব প্রকৃতির লীলায়, মানুষ সেই লীলার অংশমাত্র। এই বোধেই মানুষের লাভ হতে পারে। আজ আমরা আত্মঘাতের পথে ছুটে চলেছি। কবে ভোগতৃষ্ণা সঙ্কুচিত করতে শিখব?
তাপস সিংহ রায়, কলকাতা-৫৭
উদ্ধারকারী
যন্ত্র যে মানুষের বিকল্প হতে পারে না, তা আবারও প্রমাণিত হল উত্তরকাশীর সিল্কিয়ারার সুড়ঙ্গে উদ্ধারকাজ চলার সময়ে। ন’বছর আগে র্যাট-হোল খনন প্রক্রিয়াকে বেআইনি বলে ঘোষণা করেছিল ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইবুনাল (এনজিটি)। উত্তরকাশীর সুড়ঙ্গে গত নভেম্বরে ১৭ দিন ধরে আটক থাকা ৪১ জন শ্রমিকের উদ্ধারে উন্নত প্রযুক্তি, বিদেশি যন্ত্রপাতি শেষ পর্যায়ে মুখ থুবড়ে পড়ার পরে অগতির গতি হয়ে এল এই পদ্ধতি, যা শেষ বাধা দূর করে শ্রমিকদের উদ্ধার করল। মূলত মাটির নীচে সরু জায়গায় কয়লা সংগ্রহের জন্য ‘র্যাট-হোল মাইনিং’ করা হয়। এক বার গর্ত খোঁড়ার পরে দড়ি কিংবা বাঁশের সিড়ি বেয়ে সেখানে প্রবেশ করেন খননকারীরা। র্যাট-হোল মাইনিং-এ গর্তগুলি চওড়ায় সাধারণত চার ফুটেরও কম হয়ে থাকে। খননকারীরা কয়লাস্তরে পৌঁছনোর পরে সুড়ঙ্গের পাশ থেকে খুঁড়তে শুরু করা হয়। উত্তোলন করা হয় কয়লা। বিভিন্ন যন্ত্রের মাধ্যমে গোটাটাই হাতে করা হয়। মেঘালয়ে অপরিসর কয়লাখনিতে এই ভাবে খননকাজ চালানো হয়, যার পোশাকি নাম ‘সাইড কাটিং’। এক বার কয়লার সন্ধান পেয়ে গেলে ইঁদুরের মতো গর্ত খুঁড়ে প্রবেশ করেন খননকারীরা। এ ছাড়া ‘বক্স কাটিং’-এর মাধ্যমেও কয়লা সংগ্রহ করা হয়।
বিপদসঙ্কুল ও অবৈজ্ঞানিক বলে ২০১৪ সালে এই প্রক্রিয়ার উপরে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল এনজিটি। কিন্তু তার পরেও ভারতের নানা জায়গায়, বিশেষত উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিতে র্যাট-হোল মাইনিং পদ্ধতিটি চালু রয়েছে। ২০১৮ সালে অবৈধ খাদানে বন্যার জেরে আটকে পড়েছিলেন পনেরো জন। সেখানে শুধুমাত্র দু’জনের দেহ উদ্ধার করা গিয়েছিল। ২০২১ সালেও একই রকম পরিস্থিতিতে পাঁচ জন আটকে পড়েন। সে বার মিলেছিল তিন জনের দেহ।
উত্তরকাশীতে উদ্ধারকাজের শেষ পর্বে র্যাট-হোল মাইনিং-এর জন্য দিল্লি থেকে দু’টি বিশেষজ্ঞ দল আনা হয়েছিল, যেখানে ছিলেন মোট বারো জন। তাঁদের সঙ্গে ছিল বেলচা, কুঠার ও অন্যান্য যন্ত্র। অক্সিজেন সরবরাহ বজায় রাখতে ব্লোয়ারও রাখা হয়। উদ্ধারকাজের জন্য এক জন খননকাজ চালান, আর এক জন ধ্বংসস্তূপ সংগ্রহ করেন এবং তৃতীয় জন সেই সমস্ত পদার্থ ট্রলিতে তুলে সুড়ঙ্গের বাইরে বার করতে সাহায্য করেন। সমগ্র কাজটিতে যথেষ্ট সময়, দক্ষতা ও ধৈর্যের প্রয়োজন।
প্রযুক্তির হাত ধরে সভ্যতা এগিয়ে চলেছে ঠিকই, কিন্তু বিপদসঙ্কুল পরিস্থিতিতে যন্ত্র নয়, মানুষের বুদ্ধিই তার ত্রাতা হয়ে নেমে আসে। যন্ত্র যেখানে দম ছেড়ে দেয়, মানুষের অদম্য জেদ আর সাহস সেখানে পথ দেখায়।
শুভজিৎ বসাক, কলকাতা-৫০
বিপন্ন পর্যটক
‘চিন্তা তবু মিটল না’ (৩০-১১) শীর্ষক সম্পাদকীয় পড়ে চিন্তা আরও বেড়েই গেল। আমরা জানি প্রতিকূল পরিস্থিতির জন্য চারধাম যাত্রা শীতকালে বন্ধ থাকে। শীতের শুরুতেই পুজোর জন্য সেখান থেকে বিগ্রহ নীচে নামিয়ে আনা হয়, এবং এটা ধর্মীয় রীতি বলেই মান্যতা পায়। কিন্তু সেই রীতিকে উপেক্ষা করে শুধুমাত্র রাজনৈতিক সুবিধা লাভের জন্য, সারা বছর ধরে দর্শনের সুবিধা করে দেওয়ার জন্যই উত্তরকাশীর সিল্কিয়ারায় তৈরি হচ্ছিল সুড়ঙ্গটি, যা কিছু দিন আগে ভেঙে পড়ে। এই এলাকায় যে-কোনও বড় রকমের নির্মাণই যে ভূপ্রকৃতির পক্ষে মারাত্মক বিপজ্জনক হতে পারে, সে কথা সর্বজনবিদিত। সম্পাদকীয়তেও তা বিস্তৃত ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। কর্মরত অবস্থায় সুড়ঙ্গে আটকে পড়া ৪১ জন শ্রমিককেই যে জীবন্ত উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে, তার বেশির ভাগ কৃতিত্ব কিন্তু র্যাট-হোল মাইনারদেরই প্রাপ্য। যদিও তাঁদের কাজ বৈধ নয়, তবুও তাঁদেরই ধন্যবাদ দেওয়া উচিত প্রয়োজনে কাজে আসার জন্য।
এই সুড়ঙ্গ নির্মাণের যৌক্তিকতা কতখানি, কেনই বা আপৎকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য কোনও বিকল্প পথের সন্ধান রাখা হয়নি, এই ধরনের প্রশ্ন ক্রমে আড়ালে চলে যাবে। জিয়োলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া-র সমীক্ষা অনুযায়ী, যে সমস্ত অঞ্চল ধসপ্রবণ এলাকা বলে চিহ্নিত, সেখানে পাহাড় চিরে এই নির্মাণের ফলে আগামী দিনে পর্যটকরাও অসুবিধার মুখোমুখি হতে পারেন। সম্পাদকীয়তে যথার্থই বলা হয়েছে, শ্রমিকরা উদ্ধার পাওয়ার স্বস্তি নিতান্তই ক্ষণস্থায়ী হতে পারে।
অশোক দাশ, রিষড়া, হুগলি
পথের বিপদ
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহণ দফতর ২০১৮-২০২২ সালের সময়কালে পথ-দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। এই সময়ে পথ-দুর্ঘটনায় সারা দেশে পাঁচ লক্ষেরও বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। কেবল ২০২২ সালেই দেড় লক্ষেরও বেশি মানুষ মারা গিয়েছেন।
সারা দেশে মোট পথ-দুর্ঘটনার এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি ঘটেছে জাতীয় সড়কে। ভুল লেনে গাড়ি চালানো, চালকের ভুল, বেআইনি ভাবে রাস্তায় গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকা, মদ্যপ অবস্থায় থাকা, মোবাইলে কথা বলা, লাগামহীন গতিতে গাড়ি চালানো, এমন নানাবিধ কারণ এই সমস্ত দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। এই তথ্য যথেষ্ট উদ্বেগজনক, কারণ কমবয়সিদের মধ্যে বেপরোয়া গতিতে দুই-চাকা ও চার-চাকা গাড়ি চালানোর প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। কেবল অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় বেপরোয়া হতে গিয়ে বহু যুবকের মৃত্যু হচ্ছে। প্রশাসনের বিশেষ নজরদারি জরুরি।
পথ-দুর্ঘটনার সংখ্যায় লাগাম টানতে হলে সমস্ত দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা চিহ্নিত করা, রাস্তা নিয়মিত মেরামত করা, আধুনিক সিগন্যাল ব্যবস্থা নির্মাণ প্রয়োজন। চালকদের একটানা গাড়ি চালানো, সার্ভিস রোড ও মূল রাস্তায় গাড়ি দাঁড়ানো বন্ধ করাও জরুরি। গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণ করতে তৎপর হতে হবে। যথাযথ জায়গায় উড়ালপুল ও সাবওয়ে তৈরি করা দরকার।
অপূর্বলাল নস্কর, ভান্ডারদহ, হাওড়া