New Criminal Laws

সম্পাদক সমীপেষু: নয়া আইন, পুরনো ভয়

আধুনিক প্রজাতন্ত্রে রাষ্ট্র তার নাগরিকদের কাছে দায়বদ্ধ। ফৌজদারি আইন হওয়া উচিত ন্যায্যতার উপর ভিত্তি করে। জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৮ মে ২০২৪ ০৫:৪১
Share:

—প্রতীকী ছবি।

অর্ঘ্য সেনগুপ্তের ‘উপনিবেশের প্রত্যাবর্তন’ (২২-৪) প্রবন্ধটি যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনই প্রাসঙ্গিক। ১ জুলাই থেকে ভারতে তিনটি নতুন ফৌজদারি আইন কার্যকর হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছেন, এই তিনটি আইন ভারতকে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে একবিংশ শতকে নিয়ে আসবে। সত্যিই কি তা-ই? না কি ফের অতীতের অন্ধকারের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে?

Advertisement

সকলেই জানে, রাজনৈতিক নেতাদের কথায় ও কাজে বিস্তর ফারাক। এখন প্রশ্ন হল, আইনগুলো চালু হল কেন? আসলে পূর্ববর্তী ফৌজদারি আইনগুলো পরাধীন ভারতের সামাজিক চুক্তির উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল। নতুন আইনগুলির নকশাও সেই পুরনো ধাঁচের— নাগরিক এবং প্রশাসনের মধ্যে অবিশ্বাস, শাসক ও শাসিতের মধ্যে দূরত্ব বজায় রাখা, এবং নাগরিককে সন্দেহের চোখে দেখা। ফলে পুলিশকে বিপুল ও বিস্তৃত ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে।

আধুনিক প্রজাতন্ত্রে রাষ্ট্র তার নাগরিকদের কাছে দায়বদ্ধ। ফৌজদারি আইন হওয়া উচিত ন্যায্যতার উপর ভিত্তি করে। জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে। কিন্তু নতুন বিধিগুলি ঔপনিবেশিক বিচারধারার প্রতিফলন। রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধ তার একটি মোক্ষম উদাহরণ। নতুন আইনগুলো গোপনে, একটি ছোট কমিটির দ্বারা তৈরি করা হয়। যদিও বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে মতামত চাওয়া হয়েছিল, কিন্তু যে মতামতগুলি পাওয়া গিয়েছিল তার কোনও প্রভাব পড়েছে কি না, জানা যায়নি। নতুন আইনগুলি তার ঘোষিত উদ্দেশ্য পূরণে যথেষ্ট কার্যকর না-ও হতে পারে। প্রথমত, এত দিন যে আইনগুলি বহাল ছিল, নতুন বিধিতে খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। দ্বিতীয়ত, যেখানে পরিবর্তন হয়েছে, সেখানে আইনব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে অপ্রস্তুত। সবচেয়ে বড় কথা, নতুন আইনগুলি চালু করতে গিয়ে বিভিন্ন অপরাধের ধারা পাল্টে গিয়েছে। ফলে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ বা প্রস্তুতি না থাকলে ভুল অনিবার্য।

Advertisement

কাজেই গুরুত্বপূর্ণ আইন আনতে গেলে তার আগে তার ফলাফলের পরিমাপ (লিগাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট) করা অপরিহার্য ছিল। কিন্তু তা না করে, বিনা প্রস্তুতিতে আইনগুলিকে কার্যকর করে এক অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করা হয়েছে, যা গণতন্ত্রের পক্ষে শুভ নয়।

অভিজিৎ দত্ত, জিয়াগঞ্জ, মুর্শিদাবাদ

ঠিকাদারতন্ত্র

‘কেবল সাময়িক নয়’ (১৯-৪) সম্পাদকীয়ের পরিপ্রেক্ষিতে এই চিঠি। বর্তমানে সমস্ত সরকারি সংস্থায় অধিকাংশ শ্রমিক নিয়োগ হচ্ছে বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে। রেলের ক্ষেত্রে— স্টেশনের বুকিং কাউন্টার, অনুসন্ধান বিভাগ, এসি অ্যাটেনডেন্ট, সাফাই কর্মচারী প্রভৃতি পদে বেসরকারি নিয়োগ হয়ে চলেছে। কোনও বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে রেলের চুক্তির ভিত্তিতে এ সমস্ত নিয়োগ হয়ে থাকে। যেমন— বুকিং অফিসে যে সমস্ত কর্মচারী কাজ করেন, তাঁদের সঙ্গে যে চুক্তি সম্পাদন হয়, সেখানে শ্রমিকের দাবি-দাওয়ার কোনও সংস্থান থাকে না। পার্সেল অফিসে যে শ্রমিক সরবরাহ করা হয়, সেখানে অবশ্য সরকারি শ্রমনীতিতে উল্লিখিত সুবিধা দেওয়ার কথা লেখা থাকে চুক্তিতে। তবে চুক্তিতে উল্লেখ থাকলেও সে সব সুবিধার অনেকগুলিই শ্রমিকরা পান না। অভিজ্ঞতায় জানি, কর্মীদের মাইনে দেওয়া হয় ব্যাঙ্কের মাধ্যমে। কিন্তু শ্রমিক সরবরাহকারী সংস্থাগুলি তাদের প্রেরিত শ্রমিকদের ব্যাঙ্কের এটিএম কার্ড নিজের কাছে রেখে দেয়। টাকা তুলে শ্রমিকদের ইচ্ছেমতো মাইনে দেয়। ইপিএফ এবং ইএসআই-এর সুবিধা থাকা সত্ত্বেও শ্রমিক বা কর্মীরা সেই সুবিধা অনেক ক্ষেত্রেই পান না। অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের নামও সেখানে দেওয়া হয় না। যদিও রেলকর্মীদের অ্যাকাউন্টে বেতনের সম্পূর্ণ টাকা এবং অন্যান্য সুবিধা দেওয়া হয়ে থাকে, কিন্তু শ্রমিকেরা সে সব থেকে বঞ্চিত। তাঁরা মাইনেটাও সম্পূর্ণ পান না। বুকিং অফিস বা অনুসন্ধান অফিসে নিযুক্ত কর্মীদেরও এটিএম কার্ড রেখে দেয় শ্রমিক সরবরাহকারী সংস্থা, ইচ্ছেমতো মাইনে দেয়। কেউ প্রতিবাদ করলেই তাঁদের কাজ থেকে বার করে দেওয়া হয়।

এ ছাড়াও ট্রেনে যে সমস্ত এসি অ্যাটেনডেন্ট বা সাফাই কর্মচারী থাকেন, তাঁদের বেতন অত্যন্ত কম। যদিও ঠিকাদার সংস্থার সঙ্গে রেলের চুক্তি অনুযায়ী, তারা অনেক টাকা পেয়ে থাকে। অথচ, কন্ট্রাক্টর সেই সমস্ত কর্মচারীকে মাত্র তিন-সাড়ে তিন হাজার টাকা মাসে বেতন দেয়। অনেক ক্ষেত্রে সাফাই কর্মচারীদের ট্রেনে ভিক্ষা করতেও দেখা যায়। তাঁদের ইপিএফ কিংবা ইএসআই-এর সুবিধার ব্যাপারে কোনও রকম উল্লেখ করা হয় না চুক্তিতে। এ ছাড়াও শ্রমনীতিতে যে সমস্ত সুবিধা দেওয়া আছে, তাঁরা সেগুলি পান না।

একটি বিষয় নিয়ে বলা জরুরি, ভারত সরকারের ১৯৭৪-এর একটি নির্দেশ অনুযায়ী, রেলে যে সমস্ত শ্রমিক নিযুক্ত হন, তাঁরা শ্রমিক সমবায় থেকেই আসতে পারেন। ষাট বছর কেটে গেলেও সেই আইনটি বদল হয়নি। আজ যে সমস্ত শ্রমিক এখানে কাজ করেন, তাঁরা কোনও শ্রমিক সমবায় থেকে আসেন না। বরং ঠিকাদার সংস্থা সেই সমস্ত শ্রমিক সমবায় তৈরি করে কাগজপত্র বানিয়ে নেয়। এবং শ্রমিকদের নানা ভাবে বঞ্চিত করে। এই বঞ্চনার পিছনে ঠিকাদার ছাড়াও রেলের বিভিন্ন স্তরের অফিসাররাও জড়িত আছেন বলে একাধিক বারই অভিযোগ উঠেছে।

এই পরিস্থিতির নিরসনে ১৯৭৪ সালের সরকারি নির্দেশ রদ করে, শ্রমিক সমবায়ের পরিবর্তে যে কোনও ব্যক্তি বা সংস্থা, যার শ্রমিক সরবরাহ করার সামর্থ্য রয়েছে, তাকে নিয়োগ করা উচিত রেলের। এই বিষয়টা পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন।

দ্বিতীয়ত, শ্রম আইন উপযুক্ত ভাবে প্রয়োগ হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য রেল কর্তৃপক্ষ, লেবার কমিশনার, ইপিএফও অফিস, ইএসআই অফিস ইত্যাদিকে বিশেষ ভাবে নজর দিতে হবে। বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন ও রাজনৈতিক দলের এই বিষয়ে সবিশেষ নজর দেওয়ার প্রয়োজন, যদি সত্যিই তাঁরা শোষণ থেকে শ্রমিককে উদ্ধার করতে চান।

সুমনা রায়, বাকসাড়া, হাওড়া

বঙ্কিমের ধর্ম

বিশ্বজিৎ রায়ের ‘মার্কামারা ছকের বাইরে’ (১৪-৪) শীর্ষক প্রবন্ধের সূত্রে কিছু কথা। কী হিন্দু, কী মুসলমান, সকলের প্রীতিই ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের আকাঙ্ক্ষিত। হিন্দু-মুসলমানের তারতম্য নির্দেশ করা তাঁর গ্রন্থ রচনার উদ্দেশ্য ছিল না। তাঁর সাহিত্যে হিন্দুত্বের আড়ম্বর থাকলেও তার সত্যকার প্রতিপাদ্য হিন্দুত্ব নয়, মানবতা। তিনি ছিলেন জ্ঞান ও মনুষ্যত্বের পূজারি। তাঁর কাছে ধর্ম হল, “...ঈশ্বরে ভক্তি, মনুষ্যে প্রীতি, এবং হৃদয়ে শান্তি” (ধর্ম্ম ও সাহিত্য)। আনন্দমঠ উপন্যাসে তাঁর এই চিন্তা অভিব্যক্ত হয়েছে চিকিৎসকের উক্তিতে। মহাপুরুষ, সত্যানন্দকে বলেছেন, “তুমি বুদ্ধির ভ্রমক্রমে দস্যুবৃত্তির দ্বারা ধন সংগ্রহ করিয়া রণজয় করিয়াছ। পাপের কখন পবিত্র ফল হয় না। অতএব তোমরা দেশের উদ্ধার করিতে পারিবে না...” (আনন্দমঠ)। মহাপুরুষের স্পষ্ট উক্তি, “এখন ইংরেজ রাজা হইবে।”

আসলে বঙ্কিমচন্দ্রের মতে হিন্দু, মুসলমান-সহ সমস্ত প্রজার সুরক্ষা ও মঙ্গলবিধানই রাজার ধর্ম। তাঁর জীবনের শেষ উপন্যাসে মুসলমান ফকির চাঁদশাহের মুখ দিয়ে হিন্দু রাজা সীতারামের উদ্দেশে বলেছিলেন, “বাবা! শুনিতে পাই, তুমি হিন্দু রাজ্য স্থাপন করিতে আসিয়াছ, কিন্তু অত দেশাচারে বশীভূত হইলে, তোমার হিন্দুরাজ্য সংস্থাপন করা হইবে না। তুমি যদি হিন্দু মুসলমান সমান না দেখ, তবে এই হিন্দু মুসলমানের দেশে তুমি রাজ্য রক্ষা করিতে পারিবে না। তোমার রাজ্যও ধর্মরাজ্য না হইয়া পাপের রাজ্য হইবে। সেই একজনই হিন্দু মুসলমানকে সৃষ্টি করিয়াছেন...” (সীতারাম)। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, শ্রীরামকৃষ্ণ, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ থেকে বিবেকানন্দ, সকলেই মানবতাবাদী ভাবধারার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন।

সুদেব মাল, খরসরাই, হুগলি

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement