১০ এপ্রিল কোচবিহারে শীতলখুচি নামক স্থানে কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতে কয়েক জন ভোট দিতে আসা মানুষ নিহত হন। তাঁদের মধ্যে জীবনে প্রথম ভোট প্রদান করার জন্য এসেছিলেন এক ১৮ বছর বয়সি সদ্য কৈশোর অতিক্রান্ত যুবকও। তিনিও নিহত হন। কেন্দ্রীয় বাহিনী শূন্যে গুলি না-চালিয়ে অথবা পা লক্ষ্য করে গুলি বর্ষণ না করে সোজাসুজি ভোটারদের বুকের দিকে গুলি চালায়। এই ঘটনা ঘটার পর বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষ বরাহনগরের এক সভায় দাঁড়িয়ে বলেছেন: “বাড়াবাড়ি করলে জায়গায় জায়গায় শীতলখুচি করে দেব দরকার হলে।” এ-কথা শুনে আমি স্তম্ভিত! এই দেশে আমি বাস করি? বিজেপি দল, কেন্দ্রীয় বাহিনীর এই গুলিচালনাকে প্রকাশ্য জনসভায় সমর্থন করছে? যা ঘটল, তা তো এক রকম গণহত্যাই! দেখে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে। বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষ পরিষ্কার ভাবে ভোটারদের খুনের হুমকি দিচ্ছেন। অনেক ভোট দেখেছি, কিন্তু জীবনে এমন দেখিনি, শুনিনি। কাদের দ্বারা এই হত্যার হুমকি কার্যকর হবে? কেন্দ্রীয় শাসক বাহিনীর বুলেটের দ্বারা। আমরা এখন কী করব? যে দল, অর্থাৎ বিজেপি সরাসরি কেন্দ্রীয় বাহিনীর দ্বারা গুলিবর্ষণ করে ভোটারদের হত্যা করা সমর্থন করে এবং জায়গায় জায়গায় এই হত্যা ঘটানো হবে বলে আস্ফালন করে— আমরা কি ভুলে যাব সেই দেশের প্রধানমন্ত্রী এক জন বিজেপি নেতা?
আসলে তো প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ মদত আছে বলেই দিলীপ ঘোষের মতো নেতারা এমন সোজাসুজি ভয় দেখাতে সাহস পান ভোটারদের। আবার পথে নামার সময় এল। এই বিজেপি নেতা-মন্ত্রীরা আজ ভারতবর্ষ নামক মহান ভূমিখণ্ডটির শাসনভার গ্রহণ করে দিল্লি থেকে দেশ চালাচ্ছেন— এ-কথা ভেবে ঘুরে দাঁড়ানো দরকার এখনই। কিন্তু আমি এক সাধারণ নাগরিকমাত্র। মাত্রই এক জন সাধারণ ভোটার। আমার একার কতটুকু ক্ষমতা বিরোধিতা করার? আমি অসহায় ভাবে নিরাপত্তার অভাব বোধ করছি এই হত্যাকাণ্ড দেখে, এবং এই হত্যার হুমকি শুনে। আমি জানি না, আমার কী করা উচিত। আমার বিশ্বাস— ‘জায়গায় জায়গায় শীতলখুচি করে দেব’— দিলীপ ঘোষের এই গর্জন শুনে অনেকেই নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন আমার মতো। আমার মতো যাঁরা একা-একলা অসহায় বোধ করছেন, তাঁরা ভোটের দিন যদি মনে-মনে এক হতে পারেন, তা হলে হয়তো এই আস্ফালন নিরর্থক হয়ে যাবে। কোচবিহারে ১০ এপ্রিলের হত্যাকাণ্ড এবং দিলীপ ঘোষের সব জায়গায় কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে হত্যা ঘটানোর হুমকির বিরুদ্ধে আমার ঘৃণা ও ধিক্কার জানাচ্ছি। যতই ভয় দেখানো হোক, নির্দিষ্ট দিনে আমি কিন্তু ভোট দিতে যাব।
জয় গোস্বামী
কলকাতা-১০৬
নিধনযজ্ঞ
‘লজ্জা’ (১০-৪) ও ‘নিশানা’ (১২-৪) সম্পাদকীয় দু’টি বিশেষ ভাবে প্রণিধানযোগ্য। ‘লজ্জা’-য় লেখা হয়েছে, বিজেপি দলটি ‘আসল পরিবর্তন’-এর ডাক দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতি পদে বুঝিয়ে দিচ্ছে, চিরপরিচিত রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পথেই সে হাঁটবে। হ্যাঁ, আমরা দেখলাম সেটাই। শীতলখুচিতে নির্বাচন চলাকালীন সশস্ত্র কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে নিরস্ত্র জনতার উপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে নিধনযজ্ঞ চলল। ইতিহাসের পাতায় নিশ্চয়ই লেখা হবে, গুলি চালানোর আগে লাঠি বা কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার না-করে কিংবা শূন্যে বা পায়ে গুলি করার কথা না-ভেবে সরাসরি সংশ্লিষ্ট যুবকদের বুকে গুলি করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং জনসভায় ‘গোলমাল দেখলে’ কেন্দ্রীয় বাহিনীকে ‘ঘিরে রাখার’ যে পরামর্শ দিয়েছিলেন, তা নিন্দনীয় ঠিকই, কিন্তু ‘আসল পরিবর্তনকামী’ দলটির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ ঘোষণা করে দিলেন, “এ বার গোলমাল হলেই জায়গায় জায়গায় শীতলখুচি ঘটবে।” প্রকাশ্যে এহেন বাণী সম্প্রচারের পরেও নির্বাচন কমিশন যে প্রথমে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই ‘শাস্তি’ দিতে মনস্থ করল, তা দেখে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ থেকে জনগণ— সকলে কৌতুক অনুভব করেছেন। নির্লজ্জ ফ্যাসিবাদের প্রত্যক্ষ নমুনা আর কী হতে পারে!
সবুজ সান্যাল
ধাড়সা, হাওড়া
‘সাম্প্রদায়িক’?
তৃণমূল শীর্ষ নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২৪ ঘণ্টা ভোট প্রচার করতে পারবেন না, এমনই নির্দেশ নির্বাচন কমিশনের (‘প্রচারে নিষেধাজ্ঞা, আজ ধর্নায় মমতা’, ১৩-৪)। তিনি সাম্প্রদায়িক ভোট ভাগাভাগির আবেদন করেছেন তাঁর সভায়, এবং কেন্দ্রীয় বাহিনীকে ঘেরাও করার জন্যও সমর্থকদের বলেছেন— এই অভিযোগে তাঁর ভোট প্রচার বন্ধ করার নির্দেশ দিল কমিশন। এই নির্বাচনে মমতা কি একাই সাম্প্রদায়িক কথা বলেছেন? বাংলায় আজ যে মেরুকরণের চিত্র ফুটে উঠেছে, তার জন্য তিনি কি একাই দায়ী? শুভেন্দু অধিকারী তাঁকে ‘মমতা বেগম’ ছাড়া অন্য কিছু বলেননি। এই ভাষার মধ্যে উস্কানি লুকিয়ে ছিল না? মমতা বাংলাকে কাশ্মীর বানাবেন, পাকিস্তান বা বাংলাদেশ বানাবেন— এ সব কথার মধ্যে কিন্তু সাম্প্রদায়িক উস্কানি কমিশন খুঁজে পায়নি। মমতার ‘খেলা হবে’ কথায় মানুষ মারমুখী হয়ে উঠেছে, তাই নাকি প্রমাণ হয়ে গেল শীতলখুচির ঘটনায়।
শীতলখুচির দায় মমতার ঘাড়ে চাপিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মৃত্যু নিয়ে বিভাজনের রাজনীতি করলে তা সাম্প্রদায়িক হয় না? বস্তুত দিলীপ ঘোষ জায়গায় জায়গায় শীতলখুচি ঘটানোর কথা বললে তাতে সরাসরি হিংসাত্মক উস্কানি থাকে। বিজেপির আর এক নেতা শীতলখুচির মৃত্যুসংখ্যা বাড়া উচিত ছিল বলে ঘোষণা করেছেন। কোন কথাগুলো বেশি উস্কানিমূলক বলে মনে করে কমিশন?
কোনও একটা সম্প্রদায়কে সমর্থন করলে, বা তাদের সমর্থন পেলে নেতা ‘সাম্প্রদায়িক’ হন না, যদি না তাঁর কথার মধ্যে উস্কানিমূলক মন্তব্য থাকে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যতীত অন্য নেতাদের মন্তব্য উস্কানিমূলক বলে কমিশন মনে না করলেও, সবার মন্তব্যই সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর।
নরেন্দ্রনাথ কুলে
কলকাতা-৩৪
ভয়ের জন্ম
বিবদমান রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীগুলির পক্ষ থেকে যে পরিবেশ সৃষ্টি হয়, তাতে সাধারণ ভোটাররা অসহায় বোধ করেন, ভীত হয়ে পড়েন। এখানে সাহস জোগানোর কথা কেন্দ্রীয় বাহিনীর। যতটুকু বুঝি, নির্বাচন কমিশনের ভূমিকাও তা-ই। কিন্তু শীতলখুচির ঘটনা ভিন্ন এক ভয়ের জন্ম দিল। কোনও ভিডিয়ো ফুটেজ এখনও অবধি মেলেনি, যেখান থেকে বোঝা যাবে ওই চার জনের অপরাধ কী ছিল, যে অপরাধ দমন করতে হত্যা করা হল একেবারে বুক লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে। কারা করল সবাই জানে। কিন্তু তাদের এ নিয়ে কিছুই যায় আসে না। কেন না তারা বৈধ হত্যাকারী। এ জন্য তাদের শাস্তির সম্ভাবনা নেই। এই যদি হয়, তবে তো ভোটারদের ভয় আরও বাড়ল। কেবল যুযুধান দু’পক্ষের আক্রমণ নয়, আক্রমণ যে কোনও সময় নেমে আসতে পারে সশস্ত্র শান্তিরক্ষকদের কাছ থেকেও। ভোটার নয়, কেন্দ্রীয় সরকার, শাসক দলকে নিরাপদে রাখাই এদের কাজ।
শীর্ষ বিজেপি নেতা যখন বলেন, “শীতলখুচিতে দুষ্টু ছেলেরা গুলি খেয়েছে, দুষ্টু ছেলেরা বাংলায় থাকবে না, আইন হাতে নিলে জায়গায় জায়গায় শীতলখুচি হবে”, বা আর এক নেতা যখন বলেন, চার জন নয়, আট জনকে গুলি করা দরকার ছিল, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না, বাহিনী এমন কাজ করার ইন্ধন কোথা থেকে পাচ্ছে। ক্ষমতায় এলে ‘এনকাউন্টার’ করার কথা এঁদেরই মস্তিষ্কপ্রসূত।
ক্ষমতার লালসার কাছে মানুষের জীবনের কোনও মূল্য নেই। সেই কারণে এঁরা ক্ষমতায় থাকতে কি নির্ভয়ে ভোট দেওয়া সম্ভব?
গৌরীশঙ্কর দাস
খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর