প্রান্তিক মানুষের সমস্যার কথা ভোটের বাক্সে প্রভাব ফেলে না।
প্রহেলী ধর চৌধুরীর ‘আইন আছে, অধিকার নেই’ (২৯-৮) লেখাটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং গুরুত্বপূর্ণ। সংগঠিত ক্ষেত্রের কোনও চাকরিতে যে রকম আগেই জানানো হয় যে, এই কাজটির ক্ষেত্রে কী কী করা তাঁর দায়িত্ব বা এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে, সে রকম কোনও কিছুই অসংগঠিত ক্ষেত্রে হয় না। ফলত, বাড়ির কর্ত্রীর মূল উদ্দেশ্য থাকে, তাঁর গৃহসেবিকার কাছ থেকে যতটা সম্ভব কাজ হাসিল করে নেওয়া যায়। সেই জন্য যে দিন বাসন মাজা কম থাকে বা ঘর মোছা থাকে না, সে দিন গৃহসেবিকার উপর চাপিয়ে দেওয়া হয় অন্য কাজ। এটা ভাবা হয় না যে, সেটা কি তাঁর করার কথা? চাকরিতে যখন রাখা হয়, তখন কি তাঁকে বলা হয়েছিল সে ব্যাপারে? অফিসে যাঁর কাজ ক্যাশ সামলানো, তাঁকে যদি হঠাৎ এক দিন বলা হয় ঝাড়ুদার আসেনি, আপনি একটু ঝাড়ু দিয়ে দিন অথবা এই প্রেজ়েন্টেশনটা তৈরি করে দিন, তা হলে সেটা তাঁর করার কথা নয় এবং তিনি করবেনও না হয়তো।
এই ভাবেই পরিষ্কার বোঝা যায়, কতটা প্রাসঙ্গিক এই লেখাটি যে— আইন আছে কিন্তু অধিকার নেই। সংগঠিত ক্ষেত্রে আইন থাকলেও বিভিন্ন কারণে সে আইনের অপব্যবহার হলে তার একটা আইনগত লড়াই করা সম্ভব, যেটা অসংগঠিত ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। গৃহকর্মীদের উপর সহজে সন্দেহ করা যায় হয়তো এই কারণেই যে, তাঁদের ক্ষেত্রটা অসংগঠিত এবং তাঁদের ছাড়ানোটা খুব সহজ। সংগঠিত ক্ষেত্রে যদি এ রকম কোনও ঘটনা ঘটত, তা হলে কিন্তু এই চুরি বা অন্য কোনও সন্দেহের ক্ষেত্রে বিষয়টা অন্য ভাবে পরিচালিত হত। যে-হেতু ব্যাপারটা অত্যন্ত চাকচিক্যপূর্ণ, তাই সে ক্ষেত্রে আগে তদন্ত হত। তবে বাড়ির দাদাদের যে লোলুপ দৃষ্টি পড়ার কথা বলা হয়েছে, সেটা যে কোনও চাকরির ক্ষেত্রেই মেয়েদের উপর কমবেশি পড়ে। এ ক্ষেত্রে আরও বেশি।
এই কারণে গৃহসেবিকার চাকরিকে সংগঠিত ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্ত করা খুব জরুরি। সঙ্গে দরকার তাঁদের প্রভিডেন্ট ফান্ড ও অন্য সব সুবিধা চালু করা। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, বিড়ালের গলায় সেই ঘণ্টাটি বাঁধবে কে? প্রান্তিক মানুষের এই সমস্যার কথা ভোটের বাক্সে প্রভাব ফেলে না, তাই এর কোনও সমাধান হয় না।
সুমন চক্রবর্তী, কলকাতা-৬৫
মেয়ের মোবাইল
তৃষ্ণা বসাকের ‘মেয়েদের হাতে মোবাইল!’ (২৭-৮) শীর্ষক প্রবন্ধটি পারিবারিক ও সামাজিক পরিমণ্ডলে মোবাইলের প্রভাব সম্পর্কে সকলকে ভিন্ন আঙ্গিকে ভাবায়। মোবাইল ব্যবহারে বিগড়ে যাওয়া সামাজিক সম্পর্কের রসায়নে দায়ভার তো একতরফা মেয়েদের উপরে পড়তে পারে না! অথচ, সাম্প্রতিক অতীতে মোবাইলের পাল্লায় পড়ে বিবাহিত টোটোচালক এবং পরস্ত্রীর এক সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাকে ‘রসালো’ রূপ দিতে শুধুমাত্র মেয়েদের দিকেই ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করা হয়। এ ক্ষেত্রে বহু বছর আগে ঈশ্বর গুপ্তের লেখা ‘একা বেথুন এসে শেষ করেছে’ ফের সকলের মনে পড়ে যায়। ‘এবি শিখে বিবি হয়ে গড়ের মাঠে হাওয়া খাবে’-জাতীয় পুরনো পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা ডিজিটাল শিক্ষার প্রভাবে নতুন করে আতঙ্কগ্ৰস্ত হয়। নার্সিং ট্রেনিং নেওয়া গৃহবধূ সরকারি চাকরি পেয়ে স্বামীকে ত্যাগ করে চলে যেতে পারে, এই আশঙ্কায় তাঁর হাতের কব্জি কেটে নেওয়ার মতো সাম্প্রতিক ঘটনা পিতৃতন্ত্রের বীভৎস রূপকে আরও এক বার জনসমক্ষে তুলে ধরে। মোবাইল ও সমাজমাধ্যম— এই দুইয়ের কুপ্রভাবে শুধুমাত্র মেয়েরাই বিগড়ে যাচ্ছে, তা নয়। বৌয়ের হাতে মোবাইল দিলে ‘সংসার থুয়ে পেইলে যাবে এক দিন’— এই ঘটনা যদি সত্যি সত্যিই ঘটে, তবে উল্টো দিকে আর একটি পুরুষও কিন্তু সমান ভাবে দায়ী থাকবে। কিন্তু মুদ্রার সেই পিঠটি কখনও সংবাদ শিরোনামে আসে না। ভাবনার পরম্পরায় ছেলেদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব ও মেয়েদের প্রতি অবহেলা আজও সমান প্রাসঙ্গিক। মোবাইলের ব্যবহার ঠিক কতটুকু ভাল আর কতটুকু মন্দ ভাগ্য আমাদের জন্য বয়ে নিয়ে এসেছে, তার গভীরতা পরিমাপে নিরপেক্ষ ও সঠিক অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। মোবাইল ফোনের অপব্যবহারের ফলে সংসারে একমাত্র মেয়েদেরই বিপথগামী হওয়ার সম্ভাবনা থাকছে— এই জাতীয় অতি সরলীকৃত কথা উপহাসের ছলেও বলা চলে না। গ্ৰাম-শহরের ভেদাভেদ মুছে ফেলা মোবাইল সর্বস্তরের মেয়েদের কাছে আজ শুধুমাত্র মায়াবী যন্ত্র নয়। মোবাইল তাঁদের কাছে এখন শিক্ষাদীক্ষা বা রুটি-রুজির জগতে আত্মপরিচিতি গড়ে তোলার এক অতি উজ্জ্বল দর্পণ।
তন্ময় মণ্ডল, গোবরডাঙা, উত্তর ২৪ পরগনা
পুনর্মিলন
‘মিলাবে মিলিবে’ (২৩-৮) সম্পাদকীয়টিতে ছিন্নমূল উদ্বাস্তুদের মনের গভীরে চাপা পড়ে যাওয়া একটি প্রশ্নকে পুনরায় জনসমক্ষে এনে দিয়েছে। উত্তর প্রজন্মের দুই যুবক নিসার ধিলোঁ এবং ভূপিন্দর সিংহ লাভলির অসাধারণ প্রচেষ্টায় গড়ে তোলা ‘পঞ্জাব লহর’ ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে ‘ভারত ও পাকিস্তান সীমান্তের দু’পারের পঞ্জাবি মানুষদের মিলিয়ে’ দেওয়ার যে মানবিক উদ্যোগ গ্রহণ করছেন, তাকে মুক্তকণ্ঠে সাধুবাদ জানাই। দেশভাগ-বিচ্ছিন্ন মানুষকে প্রিয়জনের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্রত নিসার ও ভূপিন্দরের। সীমান্তের দুই পারে দুই দেশের অজস্র ‘ফলোয়ার’ ও শুভার্থী মানুষই ওঁদের ‘কর্মী’ হওয়ায় হারিয়ে যাওয়া পরিজনদের খোঁজখবর পাওয়া অনেক সহজ হয়ে গেছে। এমন মানবিক উদ্যোগ পূর্ববঙ্গের ছিন্নমূল মানুষগুলোকে তাঁদের হারিয়ে যাওয়া আত্মীয়-স্বজনদের খুঁজে বার করে দেওয়ার জন্য করা দরকার। অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। চেষ্টা করলে এখনও কিছু সূত্র ধরে এগোলে অবশ্যই সুফল মিলবে।
এক দিকে শিকড় ছেঁড়ার যন্ত্রণা, অন্য দিকে অচেনা অজানা দেশে এসে, নিজেদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এক অসম লড়াই চালাতে হয়েছে। দেশ ভাগের কারণে পঞ্জাব এবং বাংলার লক্ষ লক্ষ মানুষ তাঁদের জন্মভূমি ছেড়ে ভারতের মাটিতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। সেই আতঙ্কের পরিবেশে কে কোথায় হারিয়ে গেছেন, তার খোঁজ অনেকেই এখনও পাননি। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলার উদ্বাস্তু কলোনি কিংবা সরকারি উদ্যোগে তৈরি হওয়া ক্যাম্পে যাঁরা নিজেদের জায়গা করে নিতে পারেননি, তাঁদের অনেকেরই জায়গা হয়েছিল আন্দামান বা দণ্ডকারণ্যে। পূর্ববঙ্গের ছিন্নমূল উদ্বাস্তুদের একাংশ নিজের নিজের জেলাভিত্তিক সংগঠন গড়ে আত্মীয়-পরিজন ও প্রতিবেশীদের মধ্যে একটা সমন্বয় গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। সে ভাবেই নোয়াখালি সম্মিলনী, চাঁদপুর সম্মিলনী ইত্যাদি সংগঠনের জন্ম হয়। কিন্তু ওই সংগঠনগুলি হারিয়ে যাওয়া আত্মীয়-স্বজনদের খোঁজখবর করে, তাঁদের মিলিয়ে দেওয়ার উপযুক্ত কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারেনি। আজকের প্রযুক্তির কল্যাণে যে কাজ ‘পঞ্জাব লহর’-এর মতো ইউটিউব চ্যানেল করে দেখাচ্ছে।
আজ পঁচাত্তর বছর পরে এঁদের অনেকেই হয়তো চিরদিনের মতো পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। তবু কিছু মানুষ আজও প্রিয়জনদের ফিরে পাওয়ার অপেক্ষায় দিন অতিবাহিত করছেন। তাঁরাও মনেপ্রাণে আশা করেন, নিসার ধিলোঁ ও ভূপিন্দর সিংহ লাভলির ‘পঞ্জাব লহর’-এর মতো, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তু পরিবারের যুবকেরাও এমন একটি সংগঠন গড়ে তুলতে সচেষ্ট হবেন।
রতন রায়চৌধুরী, কলকাতা-১১৪