আইজ্যাক নিউটন।
সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে নিউটন সাহেবের তিনটি সূত্র—
প্রথম সূত্র: বেতন বৃদ্ধি পারফর্ম্যান্স appraisal এর সঙ্গে যুক্ত না হলে, ফাঁকিবাজ কর্মচারী চিরকাল বিবিধ অজুহাতে ফাঁকি মারবে এবং দায়িত্বশীল কর্মচারী নিজ দায়িত্ব পালন করবে।
প্রথম সূত্রের অনুসূত্র: যে কোনও সরকারি সংস্থায় ৮০:২০ অনুপাতে এই দুই শ্রেণির অবদান থাকবে। অর্থাৎ সংস্থার যে কোনও উন্নতির ৮০% হবে দায়িত্বশীল কর্মীর প্রচেষ্টায়, যারা সংখ্যায় ২০%।
দ্বিতীয় সূত্র: কর্মচারীদের যে কোনও সংগঠনের সদস্য সংখ্যা, ওই সংগঠন কী পরিমাণ দাবিদাওয়া পেশ করে এবং সেই দাবি আদায়ের জন্য কী পরিমাণ ‘সংগ্রাম’ করে, তার সমানুপাতিক এবং সদস্যদের নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে উৎসাহী করার যে কোনও প্রচেষ্টার ব্যস্তানুপাতিক।
ব্যাখ্যা: যে ইউনিয়ন যত বেশি আকাশচুম্বী দাবিদাওয়া পেশ করবে বেতন বৃদ্ধি এবং অন্যান্য সুবিধা আদায়ের জন্য, তার সদস্যসংখ্যা তত বাড়বে। উল্টো দিকে, যদি কোনও ইউনিয়ন কর্মচারীদের বলে, তাদের কর্তব্য পালনে মনোযোগী হতে বা উপভোক্তার স্বার্থের প্রতি দৃষ্টি দিতে, তা হলে কর্মচারীরা দলবদ্ধ ভাবে সেই ইউনিয়ন পরিত্যাগ করে বিপক্ষের ইউনিয়নে যোগ দেবে।
তৃতীয় সূত্র: সংস্থার গ্রাহকদের প্রতি দায়বদ্ধতার অভাবের সমান এবং বিপরীত প্রতিক্রিয়া হবে গ্রাহকদের পক্ষ থেকে।
ব্যাখ্যা: গ্রাহকেরা সংস্থার উপভোক্তার প্রতি অবহেলার জবাব দেবেন সেই সংস্থা পরিত্যাগ করে, বেসরকারি সংস্থার পরিষেবা গ্রহণ করে। এমনকি সরকারি সংস্থার কর্মীরাও তাঁদের ব্যক্তিগত বা পারিবারিক কারণে উক্ত পরিষেবা পেতে, বেসরকারি সংস্থার শরণাপন্ন হবেন। যেমন সরকারি স্কুলের শিক্ষক তাঁর সন্তানকে বেসরকারি স্কুলে পড়াবেন, সরকারি হাসপাতালের কর্মী তাঁর পরিজনকে বেসরকারি নার্সিং হোমে ভর্তি করাবেন, ইত্যাদি।
অরুণ দে
ইমেল মারফত
আইন যে রকম
‘ঠিকা শ্রমিক’ (১৯-১১) শিরোনামে পত্রের সূত্রে জানাই, Contract Labour (Abolition & Regulation) Act একটি কেন্দ্রীয় শ্রম আইন। সেখানে প্রতিটি ঠিকাদারকে লাইসেন্স নিতে হয় এবং প্রতি মাসে প্রতি শ্রমিককে ওই ঠিকাদার কোন খাতে কত টাকা বেতন দেন, কোন খাতে কত টাকা কেটে রাখেন/জমা রাখেন তার বিস্তারিত উল্লেখ করে Wages Register প্রধান নিয়োগকর্তার কাছে পেশ করতে হয়, যদি না ওই নিয়োগকর্তা (এ ক্ষেত্রে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ) শ্রমিকদের বেতন দেওয়ার সময় উপস্থিত থাকেন। ওই রেজিস্টারের প্রতি পাতায় প্রধান নিয়োগকর্তা স্বাক্ষর করবেন। ওই সমস্ত রেজিস্টার ঠিকাদার মাসান্তে Contract Labour Inspector-এর সমীপে দাখিল করবেন।
এর অন্যথা হলে ধরে নেওয়া যেতে পারে, ঠিকাদার তাঁর প্রধান নিয়োগকর্তার যোগসাজশেই সরকারকে ঠকিয়ে শ্রমিক শোষণের বেআইনি কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন।
অজয় দে
ইমেল মারফত
বাস্তব যা
অভিজ্ঞান সরকারের ‘যাঁরা সাফ করেন ট্রেনের টয়লেট’ (৭-১১) নিবন্ধ পড়ে এই চিঠি। বর্তমান কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের নিয়ন্ত্রিত রেল, বিদ্যুৎ প্রভৃতি সরকারি সংস্থা-সহ বেসরকারি ক্ষেত্রগুলিতে বিপুল হারে বাড়ছে ঠিকা শ্রমিক নিয়োগ, ক্রমাগত কমছে স্থায়ী কর্মীর সংখ্যা। ঠিকা শ্রমিকদের অধিকাংশই স্থায়ী কাজে নিযুক্ত হয়ে বছরের পর বছর ধারাবাহিক কাজ করছেন।
ভয়াবহ বেকার সমস্যার যুগে বাজারে শ্রম উদ্বৃত্ত। মজুরি নিয়ে দর কষাকষির কোনও ক্ষমতাই নেই শ্রমিকদের। যার পূর্ণ সুযোগ নিচ্ছেন ঠিকাদাররা। সরকার শ্রম আইন ভঙ্গকারী ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসে আছে। ফলে ঠিকাদাররা বেপরোয়া হয়ে উঠছেন। সরকার আইন ভঙ্গকারী ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা করছে না কেন? কারণ আইনটা প্রথমে সরকার নিজেই ভাঙে। কী ভাবে? ভারতীয় রেলের মতো, বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থাও ন্যূনতম মজুরিভুক্ত নির্দিষ্ট শিল্পগুলির মধ্যে পড়ে না। তা সত্ত্বেও কোনও নিয়মের তোয়াক্কা না করে, রাজ্যের বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থার স্থায়ী কাজে নিযুক্ত ঠিকা কর্মীদের ক্ষেত্রে, কর্তৃপক্ষ জোর করে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ঘোষিত ন্যূনতম মজুরিভুক্ত নির্দিষ্ট শিল্পগুলির অন্তর্ভুক্ত বিশেষ একটি গোত্রের শ্রমিকদের (নির্মাণকর্মী) জন্য নির্ধারিত মজুরি চালু করেছে। অর্থাৎ প্রথমেই কর্তৃপক্ষ ১৯৭০ সালের ঠিকা শ্রমিক আইন অনুযায়ী সম এবং সমজাতীয় কাজের জন্য প্রাপ্য সমবেতনের অধিকার থেকে শ্রমিকদের বঞ্চিত করে নিজেই আইন ভেঙে বসে আছে।
এ বার দেখা যাক ঠিকাদাররা কী ভাবে শ্রমিকদের শোষণ করছেন— ১) সমকাজে সমবেতন দূর অস্ত্, বহু ক্ষেত্রেই ঠিকাদার মুখ্য নিয়োগকর্তা দ্বারা ঘোষিত ন্যূনতম মজুরিও শ্রমিকদের দেন না। প্রকৃত প্রাপ্য মজুরি থেকে কম দিয়ে সাদা কাগজে ঠিকা কর্মীদের সই করতে বাধ্য করানো হয়। পরে ঠিকাদার সেখানে প্রকৃত মজুরি বসিয়ে কর্তৃপক্ষকে জমা দেন। ২) সংশ্লিষ্ট কর্মীদের বেতনের কোনও নির্দিষ্ট দিন নেই, নেই অন্যান্য প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা। বহু ক্ষেত্রেই মাসের পর মাস বেতন বকেয়া পড়ে থাকে। ৩) মুখ্য নিয়োগকর্তা ঘোষিত ‘ম্যানিং’ না দিয়ে কিছু ভুয়ো নাম ঢুকিয়ে কম লোক দিয়ে কাজ করানো হয়। ৪) বেতন প্রদানের সময় মুখ্য নিয়োগকর্তার প্রতিনিধির উপস্থিতি বাধ্যতামূলক হওয়া সত্ত্বেও বহু ক্ষেত্রে তা হয় না। ৫) অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঠিকাদার পরিবর্তনের সময়, কর্মীদের প্রাপ্য বেতনের টাকা আত্মসাৎ করে আগের ঠিকাদার চলে যান। ৬) ঠিকাদার বেতন না দিলে আইন অনুযায়ী মুখ্য নিয়োগকর্তা দিতে বাধ্য। অথচ তা মানা হয় না।
৭) কাজের ঘণ্টার কোনও বালাই নেই। আট ঘণ্টার বেশি কাজের জন্য প্রাপ্য মজুরি চাইলে ছাঁটাই অনিবার্য। ৮) ছাঁটাইয়ের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মীকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনও সুযোগ দেওয়া হয় না। ঠিকাদারের ইচ্ছাই শেষ কথা। ৯) ঠিকা শ্রমিকদের ক্ষেত্রে পিএফ-এর টাকার গরমিল সাধারণ ঘটনা। ১০) মাতৃত্বকালীন ছুটি এঁদের কাছে দিবাস্বপ্ন। ১১) অধিকাংশ জায়গায় কর্মক্ষেত্রে পানীয় জল, শৌচালয়, বিশ্রামাগার-সহ আইনানুগ প্রাপ্য অন্যান্য সুযোগসুবিধার কোনও মান্যতাই দেওয়া হয় না।
বঞ্চনার বহর আর বাড়িয়ে লাভ নেই। অথচ উপরের বিষয়গুলির ‘কনট্র্যাক্ট লেবার (রেগুলেশন ও অ্যাবোলিশন) আইন-১৯৭০’ অনুযায়ী ঠিকা শ্রমিকদের প্রাপ্য। না মানলে শাস্তির বিধানও নির্দিষ্ট আছে। কিন্তু আইন ভেঙে ঠিকাদাররা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অসহায় শ্রমিকরা মুখ্য নিয়োগকর্তার কাছে অভিযোগ জানালে তাঁদের জবাব, ‘‘ও সব ঠিকাদারদের বিষয়, আমাদের কিছু করার নেই।’’
উল্লেখ্য, রোদ ঝড় বৃষ্টি ও প্রবল ঠান্ডার মধ্যে ২৪ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ব্যবস্থা সচল রাখার ক্ষেত্রে ঠিকা কর্মীদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি কোম্পানির রাজস্ব আদায়ের মতো অতীব গুরুত্বপূর্ণ কাজে মিটার রিডিং ও বিলিংয়ের সঙ্গে হাজার হাজার ঠিকা কর্মী যুক্ত। যাঁদের ন্যূনতম মজুরিভুক্ত নির্মাণকাজের সঙ্গে যুক্ত অর্ধদক্ষ কর্মীদের মজুরি দেওয়া হয়। সাবস্টেশনে অপারেশন এবং লাইন রক্ষণাবেক্ষণের সঙ্গে যুক্ত ঠিকা কর্মীরা প্রতি মুহূর্তে জীবনের প্রবল ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন। দুর্ঘটনা ও মৃত্যু এঁদের নিত্যসঙ্গী। কারণ, অনেক ক্ষেত্রেই উপযুক্ত ‘গ্লাভস’, ‘হেলমেট’, ‘জুতো’, ‘সেফটি বেল্ট’ প্রভৃতি ছাড়াই ‘হাই-টেনশন’ ও ‘লো-টেনশন’ লাইনে কাজ করতে বাধ্য করা হন। কর্মক্ষেত্রে লাইসেন্সপ্রাপ্ত সুপারভাইজ়র থাকা বাধ্যতামূলক হলেও, বহু ক্ষেত্রে তা মানা হয় না। এই যদি সরকারি ক্ষেত্রে ঠিকা শ্রমিকদের অবস্থা হয়, বেসরকারি ক্ষেত্রে ঠিকা শ্রমিকদের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। কেন্দ্র ও রাজ্যে রাজ্যে ক্ষমতাসীন সরকারের অনুগামী সংগঠনগুলো এ বিষয়ে টুঁ শব্দ করে না।
মানসকুমার সিংহ
সাধারণ সম্পাদক, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদ পাওয়ারমেন্স ইউনিয়ন