Education

সম্পাদক সমীপেষু: গোলমাল বাঁধবেই

স্কুলশিক্ষা বিষয়ে জাতীয় পাঠক্রম পরিকাঠামোতেও পরীক্ষার্থীদের মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০২৪ ০৫:১৬
Share:

—প্রতীকী ছবি।

‘ওপেন বুক ইভ্যালুয়েশন’ (ওবিই) প্রসঙ্গে সোনালী দত্তের ‘বই খুলেও উত্তর মিলবে কি’ (১৮-৩) শীর্ষক প্রবন্ধে উত্থাপিত প্রশ্নগুলো স্বাভাবিক এবং বাস্তবোচিত। এটি এমন এক পদ্ধতি, যেখানে পরীক্ষার্থীরা পাঠ্যবই, সহায়িকা, নোটস ইত্যাদির সাহায্য নিয়ে পরীক্ষা দিতে পারবে। এই পরীক্ষা পদ্ধতির আবার দুটো ভাগ আছে। একটি সীমাবদ্ধ পদ্ধতি (রেস্ট্রিক্টেড টাইপ), যেখানে শুধুমাত্র অনুমোদিত পাঠসামগ্রী ব্যবহার করা যায়। অপরটি স্বাধীন পদ্ধতি (ফ্রি টাইপ) যেখানে যে কোনও ধরনের প্রাসঙ্গিক পাঠসামগ্রী ব্যবহার করা যায়। এ ধরনের পরীক্ষা পদ্ধতির উদ্দেশ্য হল, সামগ্রিক ভাবে পরীক্ষার্থীদের মূল্যায়ন পদ্ধতির পরিবর্তন করা, পাঠ্যবিষয় সম্পর্কিত সমস্যা সমাধানে ছাত্রছাত্রীদের দক্ষতা বৃদ্ধি, বিষয়ভিত্তিক বিশ্লেষণ ক্ষমতার উন্নতি, গঠনমূলক চিন্তাশক্তির বিকাশ ঘটানো ইত্যাদি। প্রসঙ্গত, ২০১৪-য় সিবিএসই পরীক্ষামূলক ভাবে ‘ওপেন টেক্সট বেসড অ্যাসেসমেন্ট’ চালু করেছিল। কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের গঠনমূলক চিন্তাভাবনার বিকাশ ঘটাতে ব্যর্থতার কারণে, ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে সেই প্রয়াস স্থগিত হয়। যদিও ২০২০-র জাতীয় শিক্ষানীতিতে কোথাও সুস্পষ্ট ভাবে ওবিই পরীক্ষা পদ্ধতির কথা বলা নেই। বরং পাঠ্যবিষয়ে অধীত মুখস্থবিদ্যার পরিবর্তে প্রয়োগজনিত দক্ষতা বৃদ্ধিভিত্তিক শিক্ষাপদ্ধতিতে গুরুত্ব আরোপ করার কথা বলা আছে। স্কুলশিক্ষা বিষয়ে জাতীয় পাঠক্রম পরিকাঠামোতেও পরীক্ষার্থীদের মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছে।

Advertisement

কিন্তু শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সার্বিক প্রশিক্ষণ প্রদান ও মানসিক প্রস্তুতি ছাড়া, প্রকল্প রূপায়ণের উপযুক্ত পরিবেশ ও পরিকাঠামো তৈরির কোনও পদক্ষেপ না করেই এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রবন্ধে উল্লিখিত প্রশ্নাবলির সঙ্গে আমি সহমত। যেখানে পরীক্ষায় ‘একটু ঘুরিয়ে’ প্রশ্ন করলে পরীক্ষার্থী, এমনকি তাদের অভিভাবকরা পর্যন্ত ‘প্রশ্ন খুব কঠিন হয়েছে’ বলে সরব হন, সেখানে চিন্তনমূলক প্রশ্নমালার মুখোমুখি হয়ে পরীক্ষার্থীদের অবস্থা কী দাঁড়াবে, সেটা কল্পনা করা কষ্টসাধ্য নয়। কারণ, বই দেখে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে স্ব-চিন্তিত ও সু-চিন্তিত উত্তর প্রদান করা, আদ্যোপান্ত পাঠ্যবই পড়তে অনভ্যস্ত ছাত্রছাত্রীদের কাছে অসম্ভব। পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে সম্পর্করহিত ছাত্রছাত্রীর দল, ‘বই দেখে পরীক্ষা দেওয়ার’ বার্তা পেয়ে উৎফুল্ল হয়ে উঠবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে বই খুলে উত্তর দিতে গিয়ে অচেনা পথের গোলকধাঁধায় ঘুরে বেড়াবে। তাই, ‘গোলমাল’ অবশ্যম্ভাবী।

অরিন্দম দাস, হরিপুর, উত্তর ২৪ পরগনা

Advertisement

জটিল পদ্ধতি

‘ওপেন বুক ইভ্যালুয়েশন’ পদ্ধতির পরিকাঠামো এতটাই জটিল যে, সেটা সাজাতেই অনেক সময় লেগে যেতে পারে। এই পদ্ধতিতে বিদেশে বিভিন্ন বিভাগে পড়াশোনা চালু আছে এবং তার সুফলও মিলছে। কারণ, এই পদ্ধতির সঠিক পরিকাঠামো তারা গড়ে তুলতে পেরেছে। ওদের পরিকাঠামোর সঙ্গে আমাদের দেশের তুলনা করাটা যুক্তিহীন। এ দেশে শিক্ষিতের কোনও নির্দিষ্ট মানদণ্ড নেই, কোনও সঠিক সংজ্ঞাও নেই। প্রবন্ধকার যথাযথ বলেছেন যে, বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থাতে একটু ঘুরিয়ে প্রশ্ন করলেই বা পরীক্ষার হলে কড়া নজরদারি হলেই বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রী অকৃতকার্য হয় এবং শতকরা হিসাবে সে সংখ্যা নজরে পড়ার মতো।

বলা হচ্ছে, ‘ওপেন বুক ইভ্যালুয়েশন’-এ প্রশ্ন এমন মানের থাকবে যাতে বই দেখেও তার সঠিক উত্তর লিখতে পারাটা কঠিন, যদি না কেউ মনোযোগ সহকারে পাঠ্যবই, ও অন্যান্য রেফারেন্স বই ঠিকঠাক পড়ে। যেখানে সরকার মিড-ডে মিল চালু করেও বিদ্যালয়ে সকল ছাত্রছাত্রীকে হাজির করতে ব্যর্থ হচ্ছে, সেখানে এমন পদ্ধতির প্রচলন হলে তো কথাই নেই। এর পরে বিদ্যালয়ছুট শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক গুণ বৃদ্ধি পেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আর শতকরা কত জন শিক্ষার্থী কম্পিউটার নামক বস্তুটিকে ভাল ভাবে চেনে বা কম্পিউটারের ব্যবহার সঠিক ভাবে জানে, যেখানে এ পদ্ধতি সম্পূর্ণরূপে কম্পিউটারভিত্তিক।

২০১৪ সালে সিবিএসই এই পদ্ধতি চালু করেছিল। কিন্তু সেটি ব্যর্থ হওয়ার কারণে পরবর্তী কালে তারা এই পদ্ধতি তুলে দেয়। তার কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল, সৃজনশীল দক্ষতা শিক্ষার্থীরা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়নি।

স্বরাজ সাহা, কলকাতা-১৫০

বাস্তবসম্মত নয়

‘ওপেন বুক ইভ্যালুয়েশন’ নিয়ে ইতিমধ্যে শিক্ষামহলে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, ভারতে এই পরীক্ষাব্যবস্থা কতটা বাস্তবসম্মত? কত শতাংশ পড়ুয়া এই ব্যবস্থায় উপকৃত হবে? এই পরীক্ষাব্যবস্থায় মূল্যায়নের জন্য ধারণাভিত্তিক, উদ্ভাবনীমূলক প্রশ্ন দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ, প্রশ্নগুলির উত্তর দিতে গেলে পরীক্ষার্থীদের সেই বিষয়ে ধারণা এবং বোধশক্তি পরিষ্কার হতে হবে। কিন্তু, একটি ক্লাসে সব পড়ুয়ার বোধশক্তি সমান নয়। শুধু সৃজনশীল, বোধমূলক, দক্ষতাসূচক প্রশ্ন দিয়ে পড়ুয়ার সম্পূর্ণ জ্ঞান যাচাই করা যায় কি? একটি শ্রেণিকক্ষে নানা স্তরের মেধাসম্পন্ন শিক্ষার্থী থাকে। একই ধাঁচের প্রশ্ন দিয়ে সব পড়ুয়ার মেধা সঠিক ভাবে যাচাই সম্ভব নয় এবং তা শিক্ষাবিজ্ঞানের পরিপন্থী। তাই, তথ্যভিত্তিক জ্ঞানমূলক প্রশ্নেরও দরকার আছে। কিন্তু এই ধরনের প্রশ্ন ‘ওপেন বুক ইভ্যালুয়েশন’-এ দেওয়া যাবে না। সে ক্ষেত্রে পরীক্ষার্থীরা বই দেখে লিখে ফেলবে। প্রবন্ধকারের মতো আমরাও দেখেছি, নবম শ্রেণির ‘ওপেন বুক ইভ্যালুয়েশন’-এ বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রীই পাঠ্যাংশ থেকে সঠিক উত্তরের লাইনটুকুও লিখে উঠতে পারেনি। এমনিতেই এই প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে নানা ধরনের বই, ক্লাসের পাঠ্যবই পড়ার তাগিদ কমে গেছে। এর পর যদি বই, নোটস, অন্যান্য উপকরণ নিয়ে পরীক্ষা দেওয়ার অভ্যাস তৈরি হয়, সারা বছর তাদের বইমুখী করা যাবে কি? যে দেশে পড়ুয়ার তুলনায় শিক্ষকের সংখ্যা ক্রমশ কমছে, স্কুলের পরিকাঠামো নিম্নমানের, স্কুলছুট আটকাতে সরকারের কোনও পদক্ষেপ নেই, শিক্ষাখাতে সরকারি বরাদ্দ কমছে, সেখানে এই পরীক্ষাব্যবস্থা বাস্তবোচিত নয়।

অরুণ মালাকার, কলকাতা-১০৩

শিক্ষার বোঝা

‘বই খুলেও উত্তর মিলবে কি’ প্রবন্ধ প্রসঙ্গে আমরা যারা শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত তাদের কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। প্রথমত, শিক্ষার্থীদের কাছে এই শিক্ষণ পদ্ধতি পৌঁছতে গেলে শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরও নতুন করে প্রশিক্ষণ নেওয়া আবশ্যক। কিন্তু নতুন প্রশিক্ষণ নিয়ে সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কতটা সম্ভব? দ্বিতীয়ত, আপাতদৃষ্টিতে এই পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের নিকট সহজ মনে হলেও তা সহজ নয়। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার পরিকাঠামো ও মূল্যায়ন ব্যবস্থার সঙ্গে এই নতুন ব্যবস্থা কতটা শিক্ষার্থীর নিকট উপযোগী হয়ে উঠবে? তৃতীয়ত, পরীক্ষাকেন্দ্রে নজরদারির ব্যবস্থা কি যথাযথ রক্ষিত হবে? হয়তো বলা হবে, ‘নজর দেওয়ার কী প্রয়োজন? পরীক্ষার্থীরা তো বই খুলেই লিখবে।’ এমতাবস্থায় পরীক্ষাকেন্দ্রে বা শ্রেণিকক্ষে শৃঙ্খলা রক্ষিত হবে তো? চতুর্থত, হয়তো দেখা গেল, একটা দুটো উত্তর লিখতে না লিখতেই ছুটির ঘণ্টা বেজে গেল। তাতে বড় ক্ষতি হয়ে যাবে না তো?

এই চাপিয়ে দেওয়া শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁরা এর সুদূরপ্রসারী ফল নিয়ে ভেবেছেন কি? দেশে এখনও ২৩ শতাংশ মানুষ নিরক্ষর। তাই সার্বিক শিক্ষার জন্য বাজেটে ব্যয়বরাদ্দ বাড়াতে হবে। প্রবন্ধকার যথার্থই বলেছেন, দুর্বল শরীরে ভারী বোঝা চাপিয়ে দিলে শরীর ও বোঝা কেউই লক্ষ্যস্থলে পৌঁছতে পারে না। শিক্ষার্থীরা গিনিপিগ নয়। নতুন ব্যবস্থার চাপ তারা সইতে পারবে তো?

সূর্যকান্ত মণ্ডল, কলকাতা-৮৪

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement