সিঙ্গুরের সেই জমি। —ফাইল চিত্র।
অভিরূপ সরকারের ‘সিঙ্গুরেই সব শেষ?’ (৮-১১) পড়লাম। সিঙ্গুরের ন্যানো কারখানা ছিল সিপিএম এবং তৃণমূল কংগ্রেসের ভোটের অঙ্ক। শুধু আমাদের দেশ নয়, সারা বিশ্বে এখন আর শিল্পায়নের যুগ নেই। বামফ্রন্ট আমলে কয়েক হাজার শিল্প বন্ধ হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের বহু জায়গায় শিল্পের জন্য তারা জোর করে জমি নিয়েছে, অথচ শিল্প গড়ে তোলেনি, তার অনেক দৃষ্টান্ত আছে। হয় জমি দাও, না হলে লাঠি-গুলি খাও— এটা শুভবুদ্ধিসম্পন্ন কোনও মানুষের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। টাটাকে সিঙ্গুরের তিন-চার ফসলি জমি দেওয়ার জন্য বামফ্রন্ট আমলে লাঠি-গুলি-টিয়ার শেল, কারাদণ্ড, হত্যা, সবই হয়েছে। অথচ, বামফ্রন্ট শাসনকালে ছোট-বড় প্রায় ৫৬ হাজার শিল্প কেন বন্ধ হল, কেন অন্য রাজ্যে কৃষিজমিতে শিল্পের বিরোধিতা করেছে বাম দলগুলি, অথচ নিজের রাজ্যে স্ববিরোধী ভূমিকা নিচ্ছে, এ সবই তারা গোপন রেখেছে। কেন শিল্পায়নে ভাটা, একটা শিল্প গড়ে উঠলে দশটা শিল্প বন্ধ হয়, এক জন মানুষ কাজ পেলে দশ জন মানুষ কাজ হারায়, কেন অ-কৃষি জমিতে শিল্পই এখন সঠিক সিদ্ধান্ত— এ সব কথার যুক্তিপূর্ণ উত্তর তারা মানুষের কাছে দিল না। শুধু প্রচার করল, সিঙ্গুরে শিল্প হলে রাজ্যের চেহারা বদলে যাবে। বহু বেকার যুবক চাকরি পাবে।
বামফ্রন্টের এই সিদ্ধান্তে কত ভুল ছিল, কয়েক বছর পরেই তা প্রমাণ করে দিয়েছে গুজরাতের সানন্দতে টাটার ন্যানো কারখানা, যা এখন পুরোপুরি বন্ধ। সিঙ্গুরে চেষ্টা করলে হয়তো কংক্রিটের শেড ভেঙে জমিকে ভবিষ্যতে চাষযোগ্য করা যেতে পারে, বা জমির মালিক সেই জমিতে অন্য কিছু করতে পারেন। কিন্তু সানন্দতে কারখানাও হল না, চাষও হবে না, চাষি জমি ফেরতও পাবেন না।
ফলে অ-কৃষি জমিতে শিল্পের স্লোগানই সঠিক। অ-কৃষি জমিতে শিল্প বন্ধ হলে চাষির কিছু যায় আসে না। আর ক্ষতিপূরণ? এটা তো পুঁজিবাদের নিয়ম। ধনী শ্রেণির ক্ষতি এখানে যত্ন সহকারে পূরণ করা হয়। যেমন আরবিট্রাল ট্রাইব্যুনাল রায় দিল, টাটাদের ৭৬৬ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। বৃহৎ শিল্প সংস্থাগুলির অনাদায়ি ঋণ কী করে উদ্ধার হবে, সে বিষয়ে অবশ্য কোনও কথাই শোনা যায় না। যে দিক থেকেই দেখা যাক, গরিব ক্ষতিপূরণ পান না।
নিখিল কবিরাজ, শ্যামপুর, হাওড়া
এগিয়ে ওড়িশা
প্রবন্ধে অভিরূপ সরকার তথ্য-পরিসংখ্যান দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন যে, টাটারা সিঙ্গুর থেকে চলে গেলেও পশ্চিমবঙ্গের শিল্পায়নে তার কোনও প্রভাব পড়েনি। অথচ, তিনি আরবিআই-এর যে তথ্য উল্লেখ করেছেন, তাতে দেখা যাচ্ছে ২০০৬-০৭ সালে ভারতের মোট শিল্প বিনিয়োগে পশ্চিমবঙ্গের অংশ ছিল ৪% আর ২০১৯-২০ সালে ৩.৮৭%। অর্থাৎ, বিগত ১৪ বছরে আমরা একটুও এগোতে পারিনি, এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি। পাশের রাজ্য ওড়িশা আমাদের টপকে ভারতের শিল্প মানচিত্রের উন্নত রাজ্যগুলোর মধ্যে নিজেদের স্থান পাকা করে নিয়েছে। আসলে ২০০৬ সালের পর থেকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে যে শিল্পবান্ধব বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল, ২০০৮ সালে টাটাদের বিদায়ের ফলে তার অপমৃত্যু ঘটে।
প্রবন্ধকার যথার্থই বলেছেন যে, ন্যানো কারখানার নির্মাণ-শ্রমিক ও কর্মচারীদের নিরাপত্তা দিতে না পারাটা তৎকালীন সরকারের প্রশাসনিক ব্যর্থতা। কিন্তু যাদের ধ্বংসাত্মক আন্দোলনের ফলে এই শ্রমিক কর্মচারীদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়েছিল, তাদের বিষয়ে দু’চার কথা প্রবন্ধে কোথাও খুঁজে পেলাম না। যে আন্দোলনের ফলে প্রায় ৮০% নির্মাণ সম্পন্ন হয়ে যাওয়া কারখানাকে অন্যত্র স্থানান্তরিত করতে বাধ্য হয়েছিল টাটা মোটর্স, সেই আন্দোলন কি সত্যিই অনিচ্ছুক কৃষকদের স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে হয়েছিল? সত্যিই কি টাটারা চলে যাওয়ার পর অনিচ্ছুক কৃষকরা তাঁদের জমি ফেরত পেয়ে, বছরে তিন বার করে ফসল ফলাতে পারছেন? প্রশ্নগুলো সহজ, উত্তরও তো জানা।
শেষাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়, ভদ্রেশ্বর, হুগলি
শিল্প ও চাকরি
অভিরূপ সরকার প্রশ্ন করেছেন, শিল্পপতি হিসাবে টাটারা টাটানগরে কী এমন করেছেন? এর উত্তরে বলতে হয়, টাটা শিল্পগোষ্ঠী টাটানগরকে একটা আর্থসামাজিক নগরে পরিণত করেছে, যেখানে জনগণের জীবনযাপনের সমস্ত ব্যবস্থা থেকে ‘টাটা ফুটবল অ্যাকাডেমি’ তৈরি, সবই হয়েছে। টাটাদের জন্যই ঝাড়খণ্ডের অর্থনীতি একটা শক্ত ভিতের উপর দাঁড়িয়ে আছে। ভারতে শিল্পজগতের ইতিহাসে টাটা ব্যতীত এমন সুনাম আছে টমাস বাটার সংস্থার, যার জন্য বাংলার বাটানগর কেবল জুতোই তৈরি করেনি, অনেক সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ করেছে (বাটা ফুটবল দলের খেলা আমরা দেখেছি কলকাতার লিগে)।
লেখক বলেছেন, বৃহৎ শিল্পে কিছু শিক্ষিতের চাকরি হয়, আর কর্মসংস্থানের জন্য দরকার ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প। এ কথার পুরোটা ঠিক নয়। বৃহৎ শিল্পে অবশ্যই প্রশিক্ষিতদের চাকরি হয়। আইটিআই পাশ করা বেশ কিছু ছেলে নিয়মিত চাকরি পায় টাটা, ভারত ওয়াগন, বাটা, ইন্ডিয়ান অয়েল, এইচপিসিএল, বিপিসিএল প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানে। আর ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের মধ্যে চর্ম, বস্ত্র, বিস্কুট, পাউরুটি প্রভৃতি বাদে আর যে সব শিল্প আছে, তাদের বাজার বড় শিল্পের চাহিদার উপর নির্ভরশীল। এর ফলে হাওড়া ও দুর্গাপুরের ঢালাই কারখানা, ঘরে ঘরে লেদের কারবার, সবই প্রায় বন্ধ। কারণ বড় শিল্পগুলোই তো নেই বাংলায়।
যদি বাংলার অর্থনীতি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প দিয়েই চলত, তা হলে সারা বাংলায় শিল্পতালুকগুলোর এমন বিপর্যস্ত অবস্থা হত না। দীর্ঘ দিন ব্যাঙ্কিং সেক্টরে কাজ করার সুবাদে জানা আছে যে, রাজ্য বা দেশের পরিসংখ্যানের উৎসগুলো অনেকটাই পুরনো দিনের সাফল্যের তথ্য, যা বার বার তুলে ধরা হয়। এবং তার সঙ্গে কিছু কাল্পনিক তথ্যের সংযোজন করা হয়। লেখক বলেছেন, এখানে আইনের শাসন আছে। গত ১০-১২ বছর ধরে বাংলায় যে শাসন চলছে, সেটা অপশাসন নয় কি? কোনও অপরাধমূলক কথা বা কাজ অনুসন্ধান না করেই এফআইআর করা হচ্ছে, কেবল শাসক দলের কারও দেওয়া চিঠির ভিত্তিতে। অথচ, বহু সত্য ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ এফআইআর করেই না, ফলে আদালতে সরকারের মুখ পোড়ে। চাকরির ন্যায্য দাবিতে শিক্ষিত বেকার ছেলেমেয়েদের নবান্ন থেকে সামান্য দূরত্বে অবস্থানের উপর পুলিশি জুলুমকে ‘আইনের শাসন’ বলা চলে না।
বাংলায় সরকারের অদ্ভুত শিল্পনীতি (সরকার জমি অধিগ্রহণ করবে না, শিল্পপতিকে জমির ব্যবস্থা করতে হবে) অনুযায়ী কোনও শিল্পপতি পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না, যিনি বাংলায় এসে ভূতুড়ে ল্যান্ড ব্যাঙ্কের জমির উপর শিল্প গড়বেন। টাটাকে তাড়িয়ে তৎকালীন বিরোধী নেত্রী লক্ষ লক্ষ চাকরিপ্রার্থীর জীবন নিয়ে ছেলেখেলা করেছেন।
অসিত কুমার চক্রবর্তী, কলকাতা-১৪১
সমস্যার বীজ
অভিরূপ সরকারের প্রবন্ধটি প্রাসঙ্গিক। সিঙ্গুর থেকে টাটাদের ফিরে যাওয়াই রাজ্যের বর্তমান দুর্দশার বীজ, এমন ধারণা বপন করা হয়েছে আমাদের মনে। প্রবন্ধকার বিশ্লেষণে দেখিয়েছেন প্রকৃত সত্য। যাবতীয় ব্যর্থতার পিছনে রাজনৈতিক সমস্যা আছে। গণতন্ত্রে জনগণের জাগরণ শেষ কথা। ‘রথের রশি’-তে কবি সব অচলাবস্থাকে বাতিল করেছেন জনতার যোগদানে। সত্য প্রকাশ হোক।
সোমা বসু, কলকাতা-১০৩