অমর্ত্য সেন বামপন্থার অপরিহার্যতা সম্পর্কে যে আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছেন, তা গুরুত্বপূর্ণ (‘অভাব সুচিন্তা ও সমদৃষ্টির’, ৮-৬; ‘কার্পণ্য নয়, ঔদার্য দরকার’, ৯-৬)। বামপন্থার আদর্শবোধ সমাজব্যবস্থাকে এবং নিজেকে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে বুঝতে, এবং তার নিরিখে উন্নততর সমাজব্যবস্থার আকাঙ্ক্ষাকে লালন করতে শেখায়। তা হয়তো বামপন্থীরা পুঁথিগত ভাবে জানেন, কিন্তু আত্তীকরণ করতে পারেননি। সেখানেই সঙ্কট। মানসিক বধিরতার কারণে বাম-নেতারা মানুষের চাহিদা-পরামর্শ শোনেন না। এই সঙ্কীর্ণতা এঁদের জনবিচ্ছিন্ন করেছে। দ্বন্দ্বের অভাব রয়েছে চিন্তাশক্তির মধ্যে। মহাবিশ্বের সব কিছুতে দ্বন্দ্ব আছে বলেই বিশ্ব চলমান। দ্বন্দ্বের উপলব্ধির অভাবে বামপন্থীদের চিন্তাপদ্ধতিতে সঙ্কীর্ণতা এসেছে। কিন্তু বামপন্থার প্রয়োজন ফুরিয়ে যেতে পারে না। সমাজে অভাব, বৈষম্য যত দিন প্রকট থাকবে, তত দিন বামপন্থার প্রয়োজনও থাকবে। বামপন্থীদের এখন ভাবতে হবে, গুণগত ভাবে ভিন্ন কী কর্মসূচি গ্রহণ করা যায়। ভূমি-সংস্কার, অপারেশন বর্গা, পঞ্চায়েতের মাধ্যমে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ— এগুলো একটা লক্ষ্যে পৌঁছনোর ধাপমাত্র। এই ধাপগুলোর পরে কাম্য ছিল মানুষের আরও আর্থসামাজিক ক্ষমতায়ন। যেমন, জমির মালিকানা চাষিদের হাতে বজায় রেখে ছোট ছোট কৃষকদের নিয়ে যৌথ উৎপাদন সমবায় গড়ে কৃষির উন্নতি ঘটানো। এতে ছোট ও মাঝারি কৃষকদের আয় বাড়ত। গ্রামীণ শ্রমিকদের (ভ্যানচালক, রিকশা, পরিবহণ শ্রমিক ইত্যাদি) নিয়েও শ্রম সমবায় (ট্রেড ইউনিয়ন নয়) গড়া যেতে পারে। এই ভাবে যৌথ উৎপাদন ও শ্রমপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাঁরা যূথবদ্ধতার শক্তি অনুভব করবেন। তাঁরা নতুনতর সমাজব্যবস্থার দিকে এগোতে চাইবেন। বাস্তবে ছোট ছোট ক্ষেত্রে কাজ করে এই আশা-আকাঙ্ক্ষার স্বপ্ন দেখানোটাই বামপন্থীদের কর্তব্য।
মৃগেন গাঁতাইত
কলকাতা-১৫৪
নিজেদের হাতে
অর্মত্য সেনের সাক্ষাৎকারভিত্তিক নিবন্ধ প্রসঙ্গে এই চিঠি। সদ্য সমাপ্ত রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে বামপন্থীরা একটি আসনেও জয়লাভ করতে পারেননি বলে অর্মত্যবাবু বেশ বিচলিত হয়ে পড়েছেন। তিনি বারংবার পশ্চিমবঙ্গ এবং কেরল রাজ্যের বামপন্থার একটি তুলনামূলক আলোচনা করতে চেয়েছেন। নিবন্ধের শুরুর দিকে তিনি কেরলে মুদির দোকানে এক বার অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ কেনার কথা জানিয়েছেন। অমর্ত্যবাবু আরও বলেছেন, সেই দোকানদার তাঁর কাছে কোনও অ্যান্টিবায়োটিকে অ্যালার্জি আছে কি না জানতে চাওয়ায় তিনি অভিভূত হয়েছেন। মুদির দোকানে অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়াটা কি খুব সমর্থনযোগ্য? যত দূর জানি, বর্তমান চিকিৎসকেরা ‘অ্যান্টিবায়োটিক রেজ়িসট্যান্স’ নিয়ে সবচেয়ে বেশি চিন্তিত। তাঁদের পরামর্শ ছাড়াই এই জীবনদায়ী ওষুধটির যথেচ্ছ প্রয়োগের কারণে এমনটা হয়েছে বলে বিষয়টি বেশ উদ্বেগজনক! বামপন্থার ভাল দিকের কথা জানাতে গিয়ে এই তথ্য না জানালেই বোধ করি ভাল করতেন অমর্ত্য সেন।
পশ্চিমবঙ্গের এই ভরাডুবির জন্য উনি বাম নেতাদের চিন্তাধারা বদলানোর পরামর্শ দিয়েছেন। সংসদীয় রাজনীতির অলিন্দে যেখানে রাষ্ট্রক্ষমতা কিংবা রাজ্যক্ষমতা নিজ দখলে রাখাই প্রতিটি রাজনৈতিক দলের মূল লক্ষ্য, সেখানে কোনও পন্থাকে কি বেশি প্রাধান্য দিলে চলে? উনি উদাহরণ সহযোগে যে বামপন্থার কথা বুঝিয়েছেন, বাস্তবে ভোগসর্বস্ব দুনিয়ায় তা প্রয়োগের কোনও সুযোগ আছে কি? নেতানেত্রীরা দামি গাড়িতে ছুটে বেড়াবেন, দেহরক্ষী পরিবৃত হয়ে ঘুরবেন, তাঁদের সাক্ষাৎপ্রার্থীদের আগে থেকে অনুমতি নিতে হবে, আর নির্বাচন এলেই সেই নেতানেত্রীরা গরিবদরদি, শ্রমিকদরদি, কৃষকদরদি বামপন্থার পরাকাষ্ঠা হয়ে যাবেন— এই প্রাঞ্জল থিয়োরি আজকের সচেতন নাগরিকদের বামপন্থায় আকৃষ্ট করে না কিছুতেই।
তবুও এ কথা ঠিক যে, প্রকৃত বামপন্থার প্রাসঙ্গিকতা চিরন্তন। কিন্তু পন্থা ও পন্থীর যে পৌনঃপুনিক দূরত্ব, তা ঘোচানোর দায় যাঁদের, তাঁরা কতটা বাস্তবে উদার হবেন এবং ভোগসর্বস্বতাকে দূরে সরিয়ে বামপন্থার ধ্বজাকে উড্ডীয়মান রাখবেন— তার উপরে নির্ভর করবে রাজ্য তথা দেশের বামপন্থার ভবিষ্যৎ।
রাজা বাগচি
রায়পাড়া, হুগলি
এখনও আশাবাদী
অমর্ত্য সেনের সাক্ষাৎকারভিত্তিক নিবন্ধের প্রেক্ষিতে কিছু কথা। ইটালীয় দার্শনিক আন্তোনিয়ো গ্রামশি বলেছিলেন, “পেসিমিজ়ম অব দ্য স্পিরিট, অপটিমিজ়ম অব দ্য উইল।”
উদ্ভাবনী চিন্তাশক্তির দৈন্যতায় বামশক্তি আজ বিপন্ন। শুধুমাত্র ক্ষমতার অলিন্দে প্রবেশের ইচ্ছাশক্তি মৌলিক চিন্তার জন্ম দেয় না। তাই দেশের অন্যান্য দলের সঙ্গে বামপন্থীদের মৌলিক দৃষ্টিকোণ কোথায় আলাদা, অনেকে তা বুঝতে পারেন না। অথচ, বামেদের কাছে নতুন পথের দিশা খুঁজে পেতে চেয়েছিলেন জনগণ। অমর্ত্যবাবু যথার্থই বলেছেন যে, “বামপন্থীরা যদি সামগ্রিক ভাবে অন্য দিকে আমাদের পথ দেখাতেন, সেটা তো সমাজের পক্ষে ভাল হতে পারত, অথচ সেটা আমরা দেখছি বলে মনে হয় না।” পশ্চিমবঙ্গে শাসনের পরবর্তী দিনগুলিতে বামশক্তি শুধুই নিজেদের দুর্বলতাগুলি চাপা দিয়ে অন্য সব দলের সমালোচনাতে মুখর থেকেছে। অথচ, সমকালীন হতাশাজনক রাজনীতির আবর্তে বামেদের সমাজভিত্তিক মৌলিক চিন্তা-চেতনা দেশে নতুন বাতাস বইয়ে দিতে পারত। দেশের প্রবল ফ্যাসিবাদী শক্তি চিহ্নিতকরণে দুর্বলতা, সব দলকেই সমান দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে মূল বিপদকে এড়িয়ে যাওয়া এবং ক্ষমতার লক্ষ্যে কিছু সস্তা সিদ্ধান্তের হঠকারিতা বামপন্থীদের আরও বিপন্ন করেছে।
দেশের মানুষ রাজনৈতিক হতাশার নিরিখে বাম ভাবনার মৌলিক দিকগুলি সম্বন্ধে এখনও আশাবাদী। দেশের এই দুঃসময়ের অধ্যায়ে বামেদের বিকল্প ভাবনার আধারে এখনও সাধারণ মানুষ আশায় বুক বাঁধেন।
সঞ্জয় রায়
হাওড়া
শিক্ষা হবে কি?
নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেন সম্প্রতি রাজ্যের নির্বাচনে বর্তমান বামপন্থীদের সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাওয়া নিয়ে হতাশায়-দুঃখে যে চেতাবনি দিয়েছেন, তা দেখে এই বামপন্থীদের সত্যিই কোনও শিক্ষা হবে কি না, সন্দেহ আছে। অমর্ত্যবাবু যে বামপন্থী নেতানেত্রীদের চরিত্র, ভাবনা, আলাপচারিতার কথা তুলে ধরেছেন, তা ১৯৮২ সাল পর্যন্ত ঠিক ছিল। তার পর ক্রমাগত পিচ্ছিল পথে চলতে চলতে ক্ষমতার ঔদ্ধত্যে তাঁরা এমন সব কাজে প্রশ্রয় দিয়েছেন, যা বামপন্থীদের কাছে মানুষ সত্যিই আশা করেননি। তার জন্যই টানা ৩৪ বছরের বামপন্থী শাসনের অবসান ঘটিয়ে জনগণ চোখের সামনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিকল্প ভেবে নিয়ে এগিয়েছেন। কিন্তু এই সত্যি স্বীকার করতে রাজি নন বামেরা। তার বদলে তাঁরা ক্রমাগত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আক্রমণ করেছেন। তাঁদের কথা কি সত্যিই আমজনতা শুনছেন গত ১০ বছর ধরে?
আগামী দিনে দেশকে বাঁচাতে বিজেপিকে উৎখাতের জন্য যদি সত্যিই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ইউপিএ চেয়ারপার্সন করার প্রস্তাব আসে, তা হলে এই বামেরাই বাধা দিয়ে পরোক্ষে বিজেপির ভাল করলে অবাক হব না। এই বিধানসভা নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নয়, বিজেপিই প্রধান শত্রু বলে যে প্রস্তাব রেখেছিলেন মানিক সরকার এবং দীপঙ্কর ভট্টাচার্যরা, তা এই বামপন্থী দলগুলোর মনঃপূত হয়নি। বরং অতি উৎসাহে অন্ধ মমতা-বিরোধিতায় দেওয়ালে লিখেছিলেন, ‘একুশে রাম, ছাব্বিশে বাম।’ তা বাস্তবে আর সম্ভব নয়। বামপন্থীদের এই অন্ধ মমতা-বিরোধিতাকে সমর্থন করতে পারছেন না অমর্ত্য সেন, নিজে বামপন্থী মনোভাবাপন্ন হয়েও।
মৃত্যুঞ্জয় বসু
কলকাতা-৩০