Swami Vivekananda

সম্পাদক সমীপেষু: পুনঃপাঠ প্রয়োজন

এক সময় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের শিরায় রক্ত ছুটিয়েছিল বিবেকানন্দের এই ‘আর্কেটাইপ’— ভারতের ‘ভারতীয়ত্ব’ ফুটে উঠেছিল তাঁরই প্রবর্তিত নির্দিষ্ট সেবাকার্যে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১২ জানুয়ারি ২০২৩ ০৫:৪৬
Share:

স্বামী বিবেকানন্দ। ফাইল চিত্র।

স্বামী বিবেকানন্দ মানেই কি ভারত মহাসাগরের বুকে একাকী পাথরখণ্ডে বসে অসমসাহসী ধ্যান? বা ১১ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৩ সালের ‘সিস্টার্স অ্যান্ড ব্রাদার্স অব আমেরিকা’? তার পর টানা মিনিট দুয়েকের করতালি? এই সবই হিমশৈলের চূড়াটুকু, প্রদীপের দপ করে জ্বলে ওঠা। সাধারণ মানসে বিবেকানন্দের যে জনপ্রিয় ইমেজটুকু ধরা আছে, তাতে এই চোখ-ধাঁধানো খণ্ডচিত্রগুলির আড়ালে পাঠ-প্রত্যাশী হয়ে বেঁচে থাকে মানুষটির জীবনচর্যা, তাঁর প্রদীপ হয়ে ওঠার পিছনের সুগভীর দর্শনের নিশ্ছিদ্র নির্মাণ ও তীক্ষ্ণ যুক্তিবাদ।

Advertisement

১৮৯৭ সালে প্রথম বার বিদেশ থেকে দেশে ফিরছেন যখন বিবেকানন্দ, তাঁর তৎকালীন বক্তৃতামালায় বেদান্তের আদর্শে তিনি গড়ে তুলছেন ভারতের এক নবীন ধারণা— আবেগের বশে নয়, খুব সচেতন ভাবে। কী ভাবে গঠিত হবে নতুন দেশ? জাতীয় জীবনের মূল সুর ধর্মে অর্পিত করে তারই ভিত্তিতে তিনি গড়ে তুলছেন কিছু ‘ন্যাশনাল আর্কেটাইপ’। এক সময় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের শিরায় রক্ত ছুটিয়েছিল বিবেকানন্দের এই ‘আর্কেটাইপ’— ভারতের ‘ভারতীয়ত্ব’ ফুটে উঠেছিল তাঁরই প্রবর্তিত নির্দিষ্ট সেবাকার্যে। স্বাস্থ্যদান, অন্নদান, বিদ্যাদান ও অধ্যাত্ম সম্পদদানে প্রথমে বলীয়ান হবে ভারত; ক্রমশ সে নিজেকেও ছাড়িয়ে অদ্বৈতের একত্বে বাঁধবে সারা পৃথিবীকেই, তৈরি হবে ক্ষুদ্রতার সমস্ত সীমা-পেরোনো মানুষের এক বসত— বিবেকানন্দ গবেষক সান্ত্বনা দাশগুপ্ত যাকে বলছেন— ‘দ্য সিটি অব ম্যানকাইন্ড’।

সন্ন্যাসীর উদাসীন ভক্তিভাব নয়, বরং এক কর্মীর দৃঢ় প্রতিজ্ঞা, প্রজ্ঞা ফুটে ওঠে তাঁর প্রতিটি বক্তৃতায়, লেখায়। আধুনিক সময়ে, ‘স্ক্রল’ করে এগিয়ে যাওয়ার যুগে, যখন ‘গ্লোবাল ভিলেজ’-এর ধারণাকেও পেরিয়ে যাচ্ছি আমরা এক দিকে, আর অন্য দিকে সাম্প্রদায়িকতা আর রাজনীতির খেলায় টুকরো-টুকরো হয়ে যাচ্ছে দেশ ও মানুষ, বিবেকানন্দের পুনঃপাঠ প্রয়োজন— মানুষ, সমাজ ও নিজেকে নতুন ভাবে চিনতে।

Advertisement

শুভঙ্কর ঘোষ রায় চৌধুরী, কলকাতা-৩১

স্বামীজির সঙ্গীত

পরপদানত ভারতবাসীকে জাগানোর জন্য বিবেকানন্দ নিজেকে নিংড়ে দিয়েছিলেন। স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পূর্তিতে তাই তাঁকে স্মরণ। ভারতের জাতীয় জীবনে প্রাণ সঞ্চারে স্বামীজির নিদান ছিল রজোগুণের বিকাশ। ‘বর্তমান ভারত’ শিরোনামে প্রবন্ধ রচনাকালে ভারতের জনগণের প্রতি তাঁর খোঁচা, লজ্জাকর কাপুরুষতা দিয়ে বীরভোগ্যা স্বাধীনতা লাভ অসম্ভব। রামকৃষ্ণ মিশনের বাংলা মুখপত্র উদ্বোধন পত্রিকার ‘প্রস্তাবনা’ রচনাতেও একই সুর। তিনি লিখেছেন, “ভারতে রজোগুণের একান্ত অভাব; পাশ্চাত্যে সেই প্রকার সত্ত্বগুণের।” অনুভব করেছিলেন, সত্ত্বগুণের ধুয়া ধরেধীরে ধীরে ভারত তমোগুণ সমুদ্রে ডুবে গিয়েছে।

জাতীয় জীবনে রজোগুণের বিকাশে বিবেকানন্দ সঙ্গীত নিয়েও ভেবেছিলেন। তিনি জানিয়েছেন, জাতীয় জীবনে যেমন-যেমন বল আসবে, তেমন ভাষা, শিল্প, সঙ্গীত প্রভৃতি আপনাআপনি ভাবময় প্রাণপূর্ণ হয়ে দাঁড়াবে। তাঁর ভাবনায়, ভাবহীন, প্রাণহীন নিছক নকলনবিশি দিয়ে মৌলিকত্ব অসম্ভব। অথচ, মৌলিকত্বের পূর্ণ বিকাশেই একটা জাতির জাতীয় জীবনের প্রকাশ। ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে ঝরঝরে চলিত গদ্যে লিখেছেন, “যত মরণ নিকট হয়, নূতন চিন্তাশক্তির যত ক্ষয় হয়, ততই দু-একটা পচা ভাব রাশীকৃত ফুল-চন্দন দিয়ে ছাপাবার চেষ্টা হয়।…যখন দেশটা উৎসন্ন যেতে আরম্ভ হল, তখন এই সব চিহ্ন উদয় হল।... গান হচ্ছে, কি কান্না হচ্ছে, কি ঝগড়া হচ্ছে— তার কি ভাব, কি উদ্দেশ্য, তা ভরত ঋষিও বুঝতে পারেন না; আবার সে গানের মধ্যে প্যাঁচের কি ধুম!!!” (স্বামীজীর বাণী ও রচনা)। স্বামীজির অনুভবে, জাতীয় জীবন, মৌলিকত্ব এবং সঙ্গীত— এই তিন বিষয় যেন এক রেখায় অবস্থিত তিনটি বিন্দু। একটির সঙ্গে অপরটি অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে বেলুড় মঠে শিষ্য শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী প্রশ্ন করেছেন— “আমাদের পক্ষে এখন কী রূপ আদর্শ গ্রহণ করা উচিত?” এই প্রশ্নের উত্তরেও বিবেকানন্দ গীত-বাদ্যের প্রসঙ্গ তুলেছেন। জীবনে রজোগুণ জাগাতে ঢাক-ঢোল এই সব বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পরামর্শ দিয়েছেন। বলেছেন— “তুরীভেরী কি ভারতে মেলে না? ঐ-সব গুরুগম্ভীর আওয়াজ ছেলেদের শোনা।… ডমরু শিঙা বাজাতে হবে, ঢাকে ব্রহ্মরুদ্রতালের দুন্দুভিনাদ তুলতে হবে।”

পরাধীন জাতীয় জীবনে প্রাণসঞ্চার করতে বিবেকানন্দ সঙ্গীতের মতো এক প্রভাবশালী মাধ্যমকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। কেমন সেই গান? তিনি জানিয়েছেন, যে সব মিউজ়িক-এ মানুষের নরম মনোভাবকে উদ্দীপিত হয়, সে সব কিছু দিনের জন্য বন্ধ রাখতে হবে। পরিবর্তে দেশের মধ্যে প্রাণসঞ্চার করতে এবং সকল বিষয়ে ‘বীরত্বের কঠোর মহাপ্রাণতা’ আনতে স্বামীজির বক্তব্য, “খেয়াল-টপ্পা বন্ধ করে ধ্রুপদ গান শুনতে লোককে অভ্যাস করাতে হবে।” বাল্যবন্ধু প্রিয়নাথ সিংহ যখন বলেন যে, পাশ্চাত্য সঙ্গীত তাঁর কাছে রণবাদ্য বলে বোধ হয়, তখন স্বামীজির মন্তব্য, “পাশ্চাত্য সঙ্গীতে করুণরস ও বীররস দুই-ই আছে, যেমন থাকা দরকার।” (স্মৃতির আলোয় স্বামীজী)। তাঁর মতে, আমাদের দেশের যথার্থ সঙ্গীত কেবল কীর্তনে আর ধ্রুপদে আছে। আমরা জানি, কীর্তন করুণরস প্রধান আর ধ্রুপদ বীররসে লীলায়িত। তাই, কিছু দিনের জন্য কীর্তনচর্চা বন্ধ রেখে পরাধীন ভারতবাসীকে তিনি বীররসের ধ্রুপদ-চর্চার পরামর্শ দিয়েছিলেন। এ-হেন সঙ্গীতময় ভাবনা তিনিই ভাবতে পারেন। পরাধীন ভারতে সঙ্গীতচর্চাকে তিনি নিছক শৌখিনতার বেড়াজালে আবদ্ধ রাখার পক্ষপাতী নন। সঙ্গীত তাঁর ভাবনায় রজোগুণের বিকাশ-মাধ্যম। দুঃখ ও আক্ষেপ, স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পেরিয়েও আমরা ‘যুগনায়ক বিবেকানন্দ’-র স্বপ্ন দেখা ভারতকে ছুঁতে পারিনি।

অবশ্য, যুগনায়ক রূপে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে সঙ্গীতে জাতীয়তাবাদী ভাবনা পাওয়া যায় নরেন্দ্রনাথ দত্ত ও বৈষ্ণবচরণ বসাক সংগৃহীত সঙ্গীত কল্পতরু বইয়ে। ১২৯৪ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত বইটির ‘বিশেষ কথা’ শীর্ষক রচনায় বৈষ্ণবচরণের স্বীকারোক্তি, “শ্রীযুক্ত বাবু নরেন্দ্রনাথ দত্ত বি, এ, মহাশয়ই প্রথমতঃ ইহার অধিকাংশ সংগ্রহ করেন, কিন্তু পরিশেষে তিনি নানা অলঙ্ঘনীয় কারণে অবসর না পাওয়ায় ইহা শেষ করিতে পারেন নাই। তজ্জন্য আমিই ইহার অবশিষ্টাংশ পূরণ করিয়া সাধারণ্যে প্রকাশ করিলাম। কিন্তু কতদূর কৃতকার্য্য হইয়াছি বলিতে পারি না।” বইটির ‘সঙ্গীত সংগ্রহ’ অধ্যায়ে নরেন্দ্রনাথ প্রথমেই রেখেছিলেন ‘জাতীয় সঙ্গীত’। সঙ্কলনের প্রথম গানের রচয়িতা হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কলমে, “সবাই স্বাধীন এ বিপুল ভবে,/ সবাই জাগ্রত মানের গৌরবে,/ ভারত সুধু কি ঘুমায়ে রবে?” তাঁর রচনা যেন নরেন্দ্রনাথের মনের কথার প্রতিধ্বনি।

সুর-তাল-লয়-ছন্দের দোলায় বিবেকানন্দ ভারতকে জাগাতে চেয়েছিলেন। সঙ্গীতের আকর্ষণী ও অন্তর্নিহিত শক্তি দিয়ে পরাধীনতার আঁধার আকাশে দেখতে চেয়েছিলেন বিদ্যুতের আলো।

জয়দীপ মুখোপাধ্যায়, অরবিন্দ নগর, বাঁকুড়া

কর্মবীরের বাণী

স্বামী বিবেকানন্দের জীবনাদর্শ, তাঁর চিন্তা ও চেতনা যুবসম্প্রদায়ের কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর জন্মদিনটি প্রতি বছর আমরা যুব দিবস হিসেবে পালন করি। তবে তা যতটা উৎসবের মেজাজে পালন করি, ততটা নিজেদের জীবনে গ্রহণ করি কি না, সন্দেহের বিষয়। যদি করতাম, তা হলে আজকের যুবসমাজ কেন এমন উদ্‌ভ্রান্ত? কেন তারা অন্ধকার পথের পথিক হবে? সমাজে নাবালক অপরাধীর সংখ্যা বাড়ছে। ভোগাকাঙ্ক্ষা নিবৃত্তির জন্য তারা হাঁটছে অসৎ পথের দিকে। যে বাংলায় বিবেকানন্দ জ্ঞানের বাতি জ্বালিয়ে জগৎকে আলোকিত করতে চেয়েছিলেন, সেখানে এমন অনভিপ্রেত ঘটনা বিবেকবান মনকে আহত করে।

শঙ্খ অধিকারী , সাবড়াকোন, বাঁকুড়া

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement