চন্দ্রযান-৩ উৎক্ষেপণের আগে ইসরো-র চেয়ারম্যান-সহ আট জন বিজ্ঞানী তিরুপতির মন্দিরে পুজো দিলেন। —ফাইল চিত্র।
বহুচর্চিত, বহু সমালোচিত বিজ্ঞান ও ধর্মের পারস্পরিক অবস্থান নিয়ে অত্যন্ত সময়োচিত আলোচনা পড়লাম তাপস কুমার দাসের ‘বিশ্বাসে মিলায় বিজ্ঞান’ (২০-৭) প্রবন্ধে। ভারতের দুর্ভাগ্য যে, বিজ্ঞানের মতো বিষয়কে সুচতুর ভাবে ধর্মের সঙ্গে কিংবা কুসংস্কারের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষের চিন্তাভাবনাকে গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। ফলিত বিজ্ঞানের চর্চা করা হলেও বিজ্ঞানমনস্কতার দিক থেকে ধারাবাহিক ভাবেই দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে দেশের জনগণকে। তাই এমনকি চন্দ্রযান-৩ উৎক্ষেপণের আগে ইসরো-র চেয়ারম্যান-সহ আট জন বিজ্ঞানী যান তিরুপতির মন্দিরে পুজো দিতে।
বিজ্ঞান কী? বিজ্ঞান কী শেখায়? বিজ্ঞানমনস্ক হওয়ার প্রয়োজন কেন? বিজ্ঞান প্রশ্ন করতে শেখায়। বিজ্ঞান যুক্তিবাদী হতে শেখায়। যে কোনও বিষয়কে যুক্তি ও প্রয়োজনীয় পরীক্ষানিরীক্ষার সাহায্যে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার-বিবেচনা করে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সাহায্য করে বিজ্ঞানমনস্কতা। অথচ, দেশের শাসক শ্রেণি ইচ্ছাকৃত ভাবেই একটা উদ্ভট চিন্তাভাবনাকে প্রশ্রয় দিয়ে চলেছেন— বিজ্ঞানের গবেষণায় আপত্তি নেই কিন্তু কোনও ভাবেই যুক্তিবাদকে উৎসাহ দেওয়া যাবে না। যুক্তিবাদী মানুষ দেশের শাসকের পক্ষে বিপজ্জনক।
লেখক অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত ভাবেই প্রশ্ন তুলেছেন যে, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে কোনও রাষ্ট্রীয় সংস্থার শুভকামনায় কেন এক বিশেষ ধর্মের আরাধ্য দেবতাকে পুজো করা হবে! অন্য ধর্মাবলম্বীরাও তো দেশের করদাতা। তার চেয়েও বড় কথা, যাঁরা কোনও ধর্মই পালন করেন না, যুক্তিবাদকে আশ্রয় করে জীবন কাটাচ্ছেন, তাঁরাও তো দেশের করদাতা। তা হলে দেশের সমস্ত করদাতার টাকায় চলা সরকারি সংস্থায় কেন ধর্মচর্চা এবং পূজার্চনায় উৎসাহ দেওয়া হবে? কেন সমস্ত পূজার্চনা থেকে নিজেদের দূরত্ব বজায় রাখবে না রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলো? ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার, কে কী ভাবে ধর্মাচরণ করবে সেটা তাঁর নিজস্ব অভিরুচি। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র কোনও মতেই সরকারি উদ্যোগের মধ্যে ধর্মকে যুক্ত করতে পারে না।
দেশের সাধারণ নাগরিক যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানমনস্ক হলে শাসকের পক্ষে বিপদ। তাঁরা প্রশ্ন করতে শিখলে শাসকের সিংহাসন নড়বড়ে হয়ে যাবে, শোষণ করা হয়ে যাবে শক্ত। তাই ধর্মের নামে অন্ধবিশ্বাস আর কুসংস্কারে ডুবিয়ে রাখতে চায় পুঁজিবাদী শাসকের প্রতিভূ সমস্ত দলই। সেই কারণেই আমাদের দেশে পাথরের গণেশ দুধ খাওয়ার ঘটনায় হাজার হাজার লিটার দুধ হেলায় নষ্ট করা হয়। জানি না কবে জনসাধারণের মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতা বাড়বে। অন্ধবিশ্বাসের বদলে যুক্তি দিয়ে বিচার করে বিশ্বাস করা হবে। সে দিন আসবে কি?
সুরজিৎ কুন্ডু, উত্তরপাড়া, হুগলি
অশনিসঙ্কেত
এ দেশের বিজ্ঞানমনস্কতার চেহারা যথার্থই তুলে ধরেছেন প্রবন্ধকার তাপস কুমার দাস। যে বিজ্ঞানচর্চায় বিজ্ঞানমনস্ক যুক্তিবাদ গড়ে ওঠে না, বরং সংস্কার ও বিশ্বাসের কাছে বিজ্ঞান গুরুত্বহীন হয়ে থাকে, সেই বিজ্ঞান শুধু পেশাগত যোগ্যতাকেই সমৃদ্ধ করে। এরই জ্বলন্ত নিদর্শন চন্দ্রযান-৩ উৎক্ষেপণের আগে বিজ্ঞানীদের দল বেঁধে পুজো দেওয়া। বিজ্ঞানী বলে পরিচিতদের এ-হেন অবস্থা হলে, সাধারণ স্তরে বিজ্ঞান শিক্ষার অবস্থা আরও শোচনীয় হবে, বলা বাহুল্য। এর জন্য কি চলমান শিক্ষাব্যবস্থা দায়ী, না অন্য কিছু? তবে এ দেশে শিক্ষাকে ধর্মমুক্ত করা যায়নি, সে কথা অস্বীকার করার অবকাশ নেই।
গণপরিসরে বিজ্ঞানমনস্কতা তৈরি করতে হলে শিক্ষাকে ধর্মমুক্ত হতে হবে। চার পাশে ধর্ম-ভিত্তিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যে ভাবে রয়েছে, তাতে শিক্ষা ধর্মীয় বিষয় থেকে মুক্ত নয় বলেই প্রমাণিত হয়। তা ছাড়া প্রার্থনা-সঙ্গীত হিসাবে যে সঙ্গীত বেশির ভাগ বিদ্যালয়ে গাওয়া হয়, তা-ও ধর্মীয় আধারেই। বিজ্ঞানচর্চার আগেই ধর্মীয় ভাবধারা তৈরি করতে যা সাহায্য করে। আর এখন, কারিগরি দিক ছাড়া বিজ্ঞানের অন্য ভাবনা নিয়ে কেউ ভাবে না। তাই বর্তমান পরিসরে বিজ্ঞানের ছাত্র, শিক্ষক, এমনকি তথাকথিত বিজ্ঞানী বলে পরিচিত ব্যক্তিদেরও ধর্মীয় কুসংস্কারকে আঁকড়ে থাকতেই দেখা যায়, যার উদাহরণ ইসরোর বিজ্ঞানীরা। যুক্তির কষ্টিপাথরে যাচাই করার মতো মন থেকে এঁরা শতযোজন দূরে। বিজ্ঞানীদের ধর্মীয় আচরণে তাই কুণ্ঠা থাকে না। আর অ্যারিস্টটল, ব্রুনো, গ্যালিলিও— বিজ্ঞানের জন্য সত্য বলার অপরাধে যাঁরা জীবনে বহু প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছেন, তা শুধু গল্প হয়েই বেঁচে থাকেন। তাই, উচ্চশিক্ষিত থেকে বিজ্ঞানীদের অনেকেই নানা পদ ও ব্যক্তিস্বার্থের লোভে প্রকৃত বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে নিশ্চুপ থাকেন। লেখক সে কথাও বলেছেন। লেখক আরও একটি প্রশ্ন করেছেন যে, প্রতিষ্ঠানের কর্তারা কেবল হিন্দুর আরাধ্যের কাছে ধর্না দেন কেন? প্রকল্প যখন দেশবাসীর জন্য, দেশবাসী বলতে কি শুধুই বর্ণহিন্দু? এ প্রশ্নের ‘হ্যাঁ’বাচক উত্তর প্রতিষ্ঠানের কর্তারা ক্রমশ দিয়ে চলেছেন।
যদি বিজ্ঞানীদের ধর্মীয় আচার-আচরণ রাষ্ট্রীয় সংস্থার উদ্যোগে হয়, তবে তা এই স্বাভাবিক অবস্থার মারাত্মক অভিঘাত বলে মনে করেন লেখক। তবে চলমান সময়ে রাষ্ট্রীয় সংস্থার সেই উদ্যোগ নিয়ে আজ কোনও দ্বিমত নেই। নতুন শিক্ষানীতিতে শাস্ত্রের কাল্পনিক বিষয় বিজ্ঞান বলে মান্যতা পেয়েছে। জ্যোতিষও এখন একটা বিজ্ঞান! বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়-সহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যোতিষ নিয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরের পাঠক্রম ইতিমধ্যেই চালু হয়ে গিয়েছে। এ বিষয়ে কোনও রকম পাঠক্রম ছাড়াই মানুষের বিশ্বাস জগদ্দল পাথরের মতো এমনিতেই বসে আছে। সরকারি ভাবে তার প্রসারে সেই পাথর আরও ভারী হবে, সেটাই স্বাভাবিক। এমন পরিস্থিতিতে বৈজ্ঞানিক যুক্তি বলে যেটুকু মানুষের মননে আছে, তা আগামী দিনে একেবারে হারিয়ে যেতে বাধ্য। আজকের বিজ্ঞানীদের ধর্মীয় আচরণ সে কথাই বলে।
অথচ কবিগুরু বলেছিলেন, “বিজ্ঞানের সঙ্গে শাস্ত্রবাক্যের বিরোধ যেখানে, সেখানে শাস্ত্র আজ পরাভূত, বিজ্ঞান আজ আপন স্বতন্ত্র বেদীতে একেশ্বর রূপে প্রতিষ্ঠিত। ...বিশ্বের সমস্ত জ্ঞাতব্য ও মন্তব্য বিষয় সম্বন্ধে মানুষের জিজ্ঞাসার প্রবণতা আজ বৈজ্ঞানিক। আপ্তবাক্যের মোহ তার কেটে গেছে।” নব্বই বছর আগে যে মোহ কেটে গিয়েছে বলে কবি উপলব্ধি করেছিলেন, এত যুগ পর আজ সেই মোহের গ্রাসে বিজ্ঞানী থেকে সাধারণ মানুষের একেবারে ডুবে যাওয়া সমাজের পক্ষে এক ভয়ানক সঙ্কেত।
নরেন্দ্রনাথ কুলে, কলকাতা-৩৪
নাস্তিক কেন?
তাপস কুমার দাসের প্রবন্ধটি পড়লাম। পড়তে পড়তে মনে প্রশ্ন জাগল, এটি কি দেশ ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণার প্রবন্ধ, না কি বিজ্ঞানমনস্কতা বিষয়ক কোনও লেখা? লিখতে গিয়ে লেখক বোধ হয় খেই হারিয়ে ফেলেছেন। বিজ্ঞানমনস্ক হতে হলে ঈশ্বর অবিশ্বাসী বা নাস্তিক হতে হবে, এই উপপাদ্য কোথায় লেখা আছে? লেখক কি কোনও ভাল কাজে যাওয়ার আগে বা ছোটবেলায় পরীক্ষা দিতে যাওয়ার আগে কখনও তাঁর বাবা-মা বা শিক্ষক-গুরুজনের আশীর্বাদ চাননি? ইসরো-র চেয়ারম্যান-সহ যে আট জন বিজ্ঞানী চন্দ্রযান-৩ উৎক্ষেপণের আগের দিন তিরুপতির মন্দিরে পুজো দিতে যান— এই ঘটনাটিও তো আশীর্বাদ চেয়ে নেওয়ার সমতুল।
বিজ্ঞানী হলে তিনি ঈশ্বর মানতে পারবেন না— প্রবন্ধকার নিজের লেখায় এই প্রতিপাদ্যটি স্থাপন না করার চেষ্টা করলে বোধ হয় বেশি বিচক্ষণতার কাজ হত। নিজের নাস্তিকতাকে অপরের কাঁধে চাপানোটা ঠিক কথা নয়। বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে মানুষের জীবনযাত্রাকে আরও বেশি উন্নত, প্রগতিময় করা বিজ্ঞানীদের লক্ষ্য। কিন্তু তা করতে গিয়ে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অবিশ্বাস করা বা আস্তিকতা বর্জন করা একান্ত আবশ্যক— এই আশা করা বোধ হয় অনাবশ্যক আর অমূলক।
রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক, কলকাতা-৫৫