TMC

সম্পাদক সমীপেষু: রোষের ফুলকি

রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে খোদ তৃণমূল নেত্রীই পঞ্চায়েত সদস্যদের ‘রয়ে সয়ে’ খেতে বলছেন। যার অর্থ, তোলাবাজি দুর্নীতি চলুক, তবে কম করে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৫ অগস্ট ২০২২ ০৪:৩৬
Share:

প্রতিবাদ মিছিল।

কৌশিক সেনের লেখা ‘ইতিহাস কিন্তু বড় নির্মম’ (৩-৮) প্রবন্ধ সম্পর্কে কিছু কথা বলতে চাই। প্রথমত, তৃণমূল দলটি তৈরি হয়েছে কোনও মতাদর্শ নিয়ে নয়। তৎকালীন কংগ্রেসের রাজনৈতিক কারণে বামেদের পাশে থাকার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দল গঠন করেন। এর মধ্যে বেশির ভাগ নেতা-কর্মী পুরনো দলের। ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর দলের বলবৃদ্ধি করতে বাছবিচার না করে বামফ্রন্টের দুর্নীতিগ্রস্ত নেতানেত্রীদের দলে নেন তিনি। তারই অন্যতম উদাহরণ— পরেশ অধিকারী। এঁরা কোনও আদর্শগত কারণে তৃণমূলে যোগ দেননি, বাড়তি আয়ের লক্ষ্যে দলকে মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে খোদ তৃণমূল নেত্রীই পঞ্চায়েত সদস্যদের ‘রয়ে সয়ে’ খেতে বলছেন। যার অর্থ, তোলাবাজি দুর্নীতি চলুক, তবে কম করে।

Advertisement

এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভের প্রতিফলন জোকার ইএসআই হাসপাতালে পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে এক মহিলার জুতো ছোড়ার ঘটনা। টিভি চ্যানেলে শেখানো কুযুক্তি দিয়ে মুখপাত্ররা নেত্রীর বাহবা কুড়োতে পারলেও, সত্য মুছে যায় না। জুতো ছোড়ার ঘটনা নেহাতই প্রতীকী, তবুও তা সুপ্ত জনরোষেরই এক ফুলকিমাত্র। কৌশিক সেন বলেছেন, ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৯০ সালের বামফ্রন্টের বুদ্ধিজীবী সমাবেশে কবি শঙ্খ ঘোষের সাবধানবাণী উপেক্ষা করেছিলেন তৎকালীন বাম নেতৃত্ব। এর দু’দশক পর সাফ হল বামফ্রন্ট। ইতিহাস সাক্ষী, শাসকরা সমালোচনা সহ্য করতে পারে না। দলে সমালোচকদের সরিয়ে দেওয়া হয়, স্তাবকদের উন্নতি ঘটে। যুগ যুগ ধরে এ ঘটনা চলে আসছে।

কৌশিক সেন বিজেপিকে সাম্প্রদায়িক বলে দাগিয়ে দিলেও, সেই বিষয়ে তাঁর সঙ্গে সহমত হতে পারলাম না। জন্মলগ্ন থেকে বিজেপির নীতি একদেশদর্শী। কোনও দ্বিচারিতা নেই সেখানে। অন্য দল যে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করে, তার অঢেল নজির রয়েছে। নির্বাচন এলেই তা বোঝা যায়। নরম হিন্দুত্ব, গরম হিন্দুত্ব এই রাজনৈতিক দল দ্বারা সৃষ্ট। ইডি সম্পর্কে লেখকের মতামতও অমূলক। রাজ্যে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর তদন্তের তিনি ভূয়সী প্রশংসা করলেও, ইডি-র বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীদের ধরপাকড় বা জিজ্ঞাসাবাদকে সমালোচনা করেছেন। ইডি যাঁদের বাড়িতে কড়া নাড়ছে, তাঁরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের তাবড় নেতা, প্রভাবশালী। এঁরা কেউ ধোয়া তুলসীপাতা নন। যেমন, মহারাষ্ট্রের নবাব মালিক, এনসিপি নেতা। টাকা তছরুপ মামলায় আজও জেলে, আদালত এখনও জামিন দেয়নি। কয়েক দিন আন্দোলন হল। তার পর আন্দোলনকারীরা মামলায় সত্যতা আছে বলে থেমে যান। মনে রাখতে হবে, ইডি তাঁদের বাড়িতেই যায়, যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগের সারবত্তা আছে। তবে শেষে এটা না বলে পারছি না যে, স্তাবক দ্বারা পরিবেষ্টিত শাসককুল আগেও ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়নি, এখনও নেবে বলে মনে হয় না।

Advertisement

তারক সাহা, হিন্দমোটর, হুগলি

যাঁরা নিরাশ্রয়

‘সব মরণ নয় সমান’ (২-৮) শীর্ষক প্রবন্ধে অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় এক ভয়ানক কঠিন প্রশ্ন তুলে ধরেছেন, “তাঁদের জীবন ও জীবিকার দায়িত্ব কে নেবে, সেই প্রশ্নও নাহয় ভুলে গেলাম, কিংবা— একই কথা একটু কায়দা করে বললে— বাজারের হাতে ছেড়ে দিলাম। কিন্তু তাঁদের একেবারে মেরে ফেলার ব্যাপারটা কি বন্ধ করা যায় না?” এ দেশের অসংখ্য নিরাশ্রয় গৃহচ্যুত গরিব মানুষের হতভাগ্য জীবনে এটাই কিন্তু নির্মম বিধিলিপি।

দু’দশক আগের একটি বিবর্ণ কলঙ্কিত ঘটনা এখানে যোগ করা যেতে পারে। ২০০২ সালের সেপ্টেম্বরে বলিউড সুপারস্টার সলমন খানের ‘হিট অ্যান্ড রান’ মামলায় এক জন নিহত ও চার জন আহত হলে, মুম্বইয়ের দায়রা আদালত তাঁকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়। কিন্তু বেশ কয়েক বছর মামলা চলার পর, ২০১৫ সালে মুম্বই হাই কোর্ট পর্যাপ্ত প্রমাণের অভাবে নিম্ন আদালতের রায় বাতিল করে। বলিউড তারকা সমস্ত অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পান। সেই সময় মুম্বইপ্রবাসী এক জনপ্রিয় বাঙালি গায়ক মন্তব্য করেছিলেন যে, কুকুরেরা রাস্তায় ঘুমোয়, এবং কুকুরের মতো মরে। এই মন্তব্য নিয়ে জনমানসে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া তৈরি হলে, পরে অবশ্য তিনি দুঃখপ্রকাশ করেন। ৩১ জুলাই রাতে বেসমেন্টে ঘুমিয়ে থাকা আট বছরের গরিব বালিকা তৃষা দত্তকে একটি চার চাকার গাড়ি যে ভাবে পিষে মেরে গেল, তা সমাজের গভীর দুঃস্বপ্নের স্মৃতিকে আরও এক বার উস্কে দিল। মোদ্দা কথাটি হল, যত চাকচিক্যময় সমাজ বা সুশাসিত গণতন্ত্রের কথাই বলা হোক না কেন, আজও এ ভাবে রাস্তা বা রাস্তার পাশে ফুটপাতে দুর্ভাগ্যজনক ভাবে মরাই এ দেশের এক বিপুল সংখ্যক গৃহহীন, নিরাশ্রয় মানুষের বিধিলিপি!

মনে রাখতে হবে, বিশ্বের দ্বিতীয় জনবহুল এই দেশে ২০১১ সালের জনসুমারি অনুযায়ী, ১৭ লক্ষ ৭০ হাজারের বেশি গৃহহীন মানুষের বাস। আবার, ২০১৯ সালের ‘হোমলেস ওয়ার্ল্ড কাপ’ সমীক্ষা বলছে, ভারতে ১৮ লক্ষ লোকের কোনও ঘর নেই। এ সব গৃহহীন লোকেরা সাধারণত ফুটপাতে, প্ল্যাটফর্মের উপরে, ফ্লাইওভার বা সিঁড়ির নীচে, আবাসন-সংলগ্ন বেসমেন্ট এলাকা বা শহরের অস্থায়ী বস্তি ইত্যাদি অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে চরম দুর্দশায় জীবন কাটায়। আবার ‘ইনস্টিটিউট অব গ্লোবাল’-এর সংজ্ঞা অনুসারে এটাও উঠে আসে, এ দেশে প্রকৃত গৃহহীনতার সংখ্যাটি ৬ কোটিরও বেশি!

ভারতে গৃহহীনতার সমস্যা সমাধানের জন্য ‘প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা প্রকল্প’ শুরু হয় ২০১৫ সালে। প্রকল্পটি ২০২২ সালের মধ্যে দেশের সব দরিদ্র মানুষের জন্য বাড়ি তৈরির দাবিকে মান্যতা দিয়েছিল। এর সময়সীমা এখন ২০২৪ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। একই সঙ্গে এর নামকরণ নিয়ে কেন্দ্র-রাজ্যের মধ্যে একটা জঘন্য রাজনীতির খেলাও সামনে আসে। গরিব মানুষের বাসস্থান নিয়ে এমন কদর্য রাজনীতি কেন?

প্রবন্ধকার বলেছেন, এক কালে মানুষ রাত্রিতে পালা করে জেগে থাকত, আগুন আবিষ্কারের পর আগুন জ্বালিয়ে রাখত, বিপদের হাত থেকে বাঁচতে। প্রশ্ন হল, সংবিধানের অন্যতম মৌলিক অধিকার, অর্থাৎ আশ্রয়ের নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তার সামগ্রিক অধিকার যখন লঙ্ঘিত, তখন কোনও ক্রমে প্রাণটা বাঁচিয়ে রাখলেই কি সত্যিকারের জীবনরক্ষা হবে? গৃহহীন, পথবাসী মানুষের আশ্রয়, সামাজিক মর্যাদা, জীবনের অধিকারের প্রশ্নের কেন স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তির অমৃত মহোৎসবে প্রকৃত সমাধান হল না?

পৃথ্বীশ মজুমদার, কোন্নগর, হুগলি

গোপন খিদে

সম্পাদকীয় ‘খিদের হিসাব’ (৬-৮) পড়ে এই পত্র। নিবন্ধের সূচনায় অনাহারের যে পরিসংখ্যান তুলে ধরেছেন লেখক, তা রীতিমতো ভাবার বিষয়। এত রেশন ব্যবস্থা, এত জনকল্যাণমুখী প্রকল্পের পরেও কী ভাবে থেকে যায় এমন অনাহারের চিত্র? কোনও সরকারেরই তাতে মাথাব্যথা নেই। কারণ তাঁদের ধারণা, তাঁরা যে সব জনমুখী প্রকল্প ঘোষণা করে চলেছেন, তা গরিব খেটে-খাওয়া মানুষের জন্য যথেষ্ট। তাঁরা এটা ভেবে দেখেন না যে, নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্রের দাম এতটাই ঊর্ধ্বমুখী যে, নিম্ন মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পরিবারের সাত-আট জনের দু’বেলা দু’মুঠো খাবার জোগাড় করতে হিমসিম খেতে হচ্ছে। বিশেষ করে পেট্রোপণ্য, ভোজ্য তেল, ওষুধ, খাদ্যশস্যের দাম এতই বাড়ছে যে, সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকা দায়।

রেশন, মিড-ডে মিল, শিশুপুষ্টি, একশো দিনের কাজ— সবেতেই চলছে চূড়ান্ত অব্যবস্থা। কিন্তু সাধারণ মানুষের কথা বলার জায়গা নেই। ব্রিটিশ সরকার যেমন বাংলার মন্বন্তর ঢাকতে ‘দুর্ভিক্ষ’ শব্দ ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল, এই সরকারও পছন্দ করে না অনাহার, অর্ধাহার, অপুষ্টির মতো শব্দ শুনতে। তাই আমরা চাইলেও সব খিদের হিসাব সরকারের কাছে জানাতে পারি না।

কুহু দাস, দশগ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement