‘সয়ে সয়েই রমণীর প্রাণসংশয়’ (২৪-২) নিবন্ধে প্রহেলী ধর চৌধুরী বড় স্পষ্ট এবং স্বচ্ছ ভাবে প্রাসঙ্গিক চিত্রটি এঁকেছেন। ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’ ইত্যাদি বুলি যেমন তাঁদের ‘সেপসিস’ হয়ে শেষ হয়ে যাওয়ার একটি অন্যতম কারণ, আর একটি কারণ আজও বিদ্যমান, যার জন্য আজও কিছু নারী পারিবারিক নির্যাতন সয়েই চলেছেন। সেটি হল, সন্তানের উপর বিচ্ছিন্ন পরিবারের কী প্রভাব পড়বে, তার চিন্তা। বিশেষ করে সন্তান যদি মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে পৌঁছে গিয়ে থাকে, তখন তার ভবিষ্যতের চিন্তা মেয়েদের কাছে বড় হয়ে ওঠে। “আর একটু দেখি, হয়তো আবার সব ঠিক হবে”— মায়েরা এই অনর্থক প্রত্যাশায় দিন গুজরান করতে থাকেন। শান্তি অধরাই থেকে যায়, মাঝখানে মূল্যবান সময় যায় চলে। শেষে ‘সেপসিস’ নিয়েই একটা সাঙ্ঘাতিক কষ্টকর জীবন অতিবাহিত করা ছাড়া গত্যন্তর খুঁজে পান না অনেক মেয়ে, আজও! পড়াশোনার গুরুত্বপূর্ণ বছরে সন্তানকে আবার নতুন ব্যবস্থার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে বলা, বা তাকে ছেড়ে যাওয়া, কোনও বিকল্পের সঙ্গেই সমঝোতা করা সম্ভব হয় না অনেক মেয়ের পক্ষে। তাই ব্যক্তিগত জীবনে অনেক রমণী আজও ‘অ্যাডজাস্ট’ আর ‘কম্প্রোমাইজ়’ করে দিন কাটান। সেপ্টিসেমিয়া যে বড় মারাত্মক ব্যাধি!
যাঁরা সম্মানহানি সহ্য করেন না, তাঁরা সত্যিই বাহবাযোগ্য। ধৈর্য কমেনি আজকের নারীদের। শুধু তাঁরা অসম্মানের সঙ্গে সমঝোতা করতে রাজি নন। তাঁদের অবশেষে চোখ খুলেছে, তাঁরা বাঁচতে শিখেছেন।
চৈতালী তরফদার, ম্যান্ডারিন গার্ডেন্স, সিঙ্গাপুর
সেই আর্তনাদ
প্রহেলী ধর চৌধুরীর প্রবন্ধটি পড়ে দু’টি ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। একটি অনেক দিন আগের, অন্যটি সাম্প্রতিক। ছোটবেলায় ১৯৮৬-৮৭ সাল নাগাদ পূর্ব মেদিনীপুরের (তখন মেদিনীপুর) এক প্রত্যন্ত গ্রামে মামাবাড়িতে থাকতাম। বাড়ির সামনে দিয়ে তখন পাকা রাস্তা (পিচ রাস্তা) তৈরির প্রস্তুতি চলছিল। সেই কারণে অনেক শ্রমিককে নিয়োগ করা হয়েছিল। মামার বাড়ির কাছে একটা ফাঁকা মাঠে তাঁবু বানিয়ে তারা অস্থায়ী আস্তানা তৈরি করেছিল। দেখতাম, সেই পরিবারগুলির পুরুষরা নেশাগ্রস্ত হয়ে, কিংবা সুস্থ অবস্থাতেই তাদের বৌদের উপরে কী প্রচণ্ড অত্যাচারই না করত! জ্বালানির জন্য রাখা মোটা মোটা চ্যালাকাঠ দিয়ে নির্মম ভাবে তারা বৌদের পেটাত। আর্তনাদ শুনে বাড়ির অন্যদের সঙ্গে এই বাচ্চা মেয়েটাও কত বার বেরিয়ে এসেছে। কখনও খাবার গরম নেই বলে প্রহার, কখনও অবৈধ সম্পর্ক আছে, এই সন্দেহে। না, আর্তনাদ ছাড়া মেয়েদের প্রতিবাদ চোখে পড়েনি কোনও দিন।
অপর ঘটনাটি এখনও ঘটে চলেছে। আমাদের বাড়িতে যে কাজের মেয়েটি আসে ঘুটিয়ারি শরিফ থেকে, মাঝে মাঝে সে আসতে দেরি করে। কারণ জিজ্ঞেস করলে বলে, “মার খেয়ে খেয়ে মরে গেলাম। গোটা গায়ে যন্ত্রণা। সারা রাত ঘুমোতে পারিনি। ভোরের দিকে একটু চোখটা লেগে গিয়েছিল।” এক দিন না আসায় ফোন করে উত্তর পেলাম, “কাল রাত তিনটের সময় কোথা থেকে মদ গিলে ফিরেছে। তার পর গোটা ঘরে বমি করে ভর্তি করেছে। এখনও সব পরিষ্কার করে উঠতে পারিনি।” তখন দুপুর একটা বাজে।
পরিশেষে কলেজ-ছাত্রাবস্থায় এক দিন বাসে বাড়ি ফেরার সময় কনডাক্টরকে বীরদর্পে তার সঙ্গীকে বলতে শুনেছিলাম, “বৌয়ের সঙ্গে ঝগড়ার সময় আমার মুখ চলে না। যা করে আমার এই হাত।”
স্তুতি দাশগুপ্ত, কলকাতা-৯২
সইবার বিধান
‘সয়ে সয়েই রমণীর প্রাণসংশয়’ পড়ে একটা বড় দীর্ঘশ্বাস বুক খালি করে বেরিয়ে এল। ‘যে সয় সে রয়’— মেয়েদের এই মন্ত্রে দীক্ষা দেওয়া হয় শৈশবেই, প্রতিবাদী সত্তাকে ক্রমশ নিস্তেজ করে তাদের বুঝিয়ে দেওয়া হয় যে, মুখ বুঝে সহ্য করে নেওয়ার মধ্যেই নিহিত আছে জীবনের চরম সার্থকতা-পরম গৌরব। সহনশীলতার শিক্ষায় শরীর ও মনের অসুস্থতাকে অবহেলা করতে শেখে তখন থেকেই। তাই ভ্রাতৃপ্রতিম দেওর, অগ্ৰজ ভাশুর, পিতৃতুল্য শ্বশুর, এমনকি ভাশুরের ছেলেদের দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার, নানা কারণে শাশুড়ি-ননদের কাছে অত্যাচারিত হলেও নীরবে সয়ে যায়। ক’জন মেয়ের ভাগ্যে স্বামী ‘বন্ধুপ্রতিম’ হয়? সেখান থেকেও মেনে নেওয়া-মানিয়ে নেওয়ার বিধান দেওয়া হয়। বহু ক্ষেত্রে স্বামীই অত্যাচারী হয়ে ওঠে, ফলে লাঞ্ছনার তাপ আর জুড়োয় না। যন্ত্রণার উপশম হয় না, গাল বেয়ে নোনা স্রোত চুইয়ে-চুইয়ে পড়ে, অব্যক্ত যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যায়, তবুও দিনের পর দিন মেয়েরা সংসার আঁকড়ে পড়ে থাকে। প্রেমহীন দাম্পত্য জীবনের ভার বইতে থাকে, তবুও বিবাহবিচ্ছেদের কথা ভাবতে পারে না। কারণ, বিবাহবিচ্ছিন্না মহিলারা সমাজের কাছে উপহাসের পাত্রী। বাপের বাড়ির কাছেও সহানুভূতি আদায়ে অসমর্থ। সনাতন আইনিব্যবস্থাও তাদের আশ্রয় দেয় না, এ দিকে বুকের মধ্যে হাতুড়ির শব্দ— ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’। অর্থনৈতিক ভাবেও তারা পরনির্ভরশীল, অগত্যা অন্যায়-অবিচার নিপীড়ন সইতে-সইতে ‘সয়-রয়’-এর পথ ধরে সকল জীবনীশক্তিটুকু ক্ষয় হয়। আঁচলচাপা কান্নায় যন্ত্রণাগুলো শেষ পর্যন্ত সান্ত্বনার ভাষা খোঁজে।
শুভ্রা সামন্ত, বালিচক, পশ্চিম মেদিনীপুর
অসহায় পুরুষ
পারিবারিক বন্ধন রক্ষায় ভারতীয় নারীর সীমাহীন সহিষ্ণুতা প্রতিফলিত হল প্রহেলী ধর চৌধুরীর প্রবন্ধে। লেখিকার ব্যক্তিগত উপলব্ধি ও পরিসংখ্যানের জোরালো দাবির নেপথ্যেও রয়ে যায় আরও কিছু ভয়াবহ তথ্য, যেখানে দেখতে পাই প্রতিনিয়ত নীরবে গার্হস্থ হিংসার শিকার পুরুষও। পুরুষমাত্রেই নির্যাতনকারী, এমন সরলরৈখিক ভাবনার বিপ্রতীপে মাঝেমধ্যেই প্রকাশ পায় নারীর রণং দেহী রূপ। বিগত লকডাউনে গৃহবন্দি দশায় এই হিংসা প্রকট হয়েছে ভীষণ ভাবে। জবরদস্তি বৃদ্ধ স্বামীকে বাজারে পাঠানো, অথবা গৃহস্থালির সমস্ত কাজ স্বামীকে দিয়ে করিয়ে নেওয়ার ঘটনা সমাজমাধ্যমে উঠে এসেছে। এ ছাড়াও, সঞ্চিত অর্থের বেহিসাবি খরচ, শ্বশুরমশাইকে যৌন হেনস্থার মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসানোর হুমকি, স্বামীকে আত্মহননে মদত দেওয়া, বা প্রেমিক দ্বারা নিজ স্বামীকে হত্যা করার খণ্ডচিত্রে গার্হস্থ হিংসার সিন্ধুদর্শন হয়। পুরুষের অসহায়তা বা চোখের জল, দুই-ই সমাজের চোখে করুণা ও লজ্জার হওয়ায় তাঁরা বিষয়টি লুকিয়ে রাখতে বাধ্য হন। এ দেশে পশুপাখিকে রক্ষা করতে বা পরিবেশ বাঁচাতে নির্দিষ্ট আইন আছে, অথচ পুরুষের অভিযোগ জানানোর নির্দিষ্ট জায়গা নেই।
সুপ্রতিম প্রামাণিক, আমোদপুর, বীরভূম
অনুপ্রেরণা
প্রথম মহিলা ডাক্তার কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের জীবন নিয়ে একটি টেলিসিরিয়াল (‘প্রথমা কাদম্বিনী’) আমি কয়েক দিন দেখার সুযোগ পেয়েছি। আমার মনে পড়ছে নিজের দিদিমা রেণুপ্রভা বসুমল্লিকের কথা। দাদু শিবদাস বসুমল্লিক ছিলেন ডাক্তার। হঠাৎ মারা যান। তখনকার দিনে দু’টি শিশুকন্যাকে নিয়ে অল্প বয়সে দিদিমা বিধবা হন। তার পর অসম্ভব মানসিক শক্তি ও মেধার জোরে, কাদম্বিনীর উদাহরণে অনুপ্রাণিত হয়ে, ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল স্কুল (এখন এনআর এস মেডিক্যাল কলেজ) থেকে ডাক্তারি পাশ করেন। ভাল ফল করার জন্যে পেয়েছিলেন ‘কাদম্বিনী গাঙ্গুলী মেডেল’। দিদিমা ছিলেন নিষ্ঠাবতী হিন্দু, রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের ভক্ত। কিন্তু চিরকাল শিখিয়েছেন, অন্য ধর্মের মানুষকে ভালবাসতে। কাদম্বিনীর উদাহরণ অনুপ্রাণিত করে দিদিমার পরের দুই বোনকেও। তাঁরাও ডাক্তারি পাশ করেন।
প্রদীপ বসু, কলকাতা-৭৪