পথিক গুহের ‘বিজ্ঞান? এই সমাজে?’ (২২-৫) পড়ে এই চিঠি। গণপরিসরে বিজ্ঞানমনস্কতা গড়ে তুলতে দরকার বিজ্ঞানের সংগঠন। রাজনীতির সর্বোচ্চ আইনানুগ প্রতিষ্ঠান সরকার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষকদের অনুসরণ ও অনুকরণ করে থাকে। গণপরিসরে মন্ত্রী ও রাজনীতিবিদদের দেখে ভারতের মানুষ তেমনই প্রভাবিত হন। রাজনীতিতে যে হেতু বিজ্ঞানমনস্কতার অভাব, তাই গণপরিসরে বিজ্ঞানকে তুলে ধরার গরজ কোনও দলই দেখায়নি। কারণ, অন্য উপসংগঠনের প্রভাব বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তার বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস চট করে রাজনীতি দেখায় না। আর বিচ্ছিন্ন ভাবে একক লড়াই? গৌরী লঙ্কেশ, দাভোলকর বা কালবুর্গি কে হতে চায়? বিজ্ঞান-পড়া মানুষ থাকলেও সেই বিজ্ঞান মানুষের চেতনায় জায়গা পায়নি। আজন্মলালিত সংস্কারের শিকড় উপড়াতে পারেনি। আমাদের সমাজে ভাল কাজের চেষ্টার কোনও ধারাবাহিকতা নেই। অনেকের মধ্যেই আছে শুরুর পর গা-ছাড়া ভাব। লেখক বর্ণিত বিজ্ঞান মঞ্চের মতো কোনও সংগঠন আবার গড়ে তোলা যায় কি না, তা ভাবা যেতে পারে। ছোট ছোট নানা গণসংগঠন ও অসরকারি সংস্থাকে দিয়েও কিছু কাজ করানো যায়। তবে মুখ্য ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে সরকারকেই।
ধর্মীয় আচার-সর্বস্ব সমাজে বিজ্ঞানের বীজ বুনে দেওয়া কঠিন। এই জন্য রাজনীতির মঞ্চকে এগিয়ে আসতে হবে। যুক্ত করতে হবে জনগণকে। স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে একটা অংশ বিজ্ঞানচেতনা প্রসারে কাজে লাগানো যায়। এ ব্যাপারে কার্যকর ভূমিকা নিতে পারে ক্লাবগুলো। বিজ্ঞানের পরতে পরতে যে জটিলতা, তা বোঝার মতো সময় এটা নয়। মানুষ বোঝে তাৎক্ষণিক প্রাপ্তি। যদি রোগ-ব্যাধির দাওয়াই নাগালের মধ্যে মেলে চিকিৎসাকেন্দ্রে, আর খানিক দূর হেঁটেই মেলে বিশুদ্ধ পানীয় জল— এগুলোই তৈরি করবে বিজ্ঞানমনস্কতার প্রাথমিক সোপান। সূর্যগ্রহণ বা ঝড়ের সঠিক পূর্বাভাস দাগ রেখেছে মানুষের মনে, কিন্তু অপবিজ্ঞানের ময়লায় সে দাগ আজ আর স্পষ্ট নয়।
রঘুনাথ প্রামাণিক, কালীনগর, হাওড়া
বাধা ধর্মান্ধতা
পথিক গুহের নিবন্ধের প্রেক্ষিতে কিছু কথা। গালিলেও জীবনে বিশ্বাসের প্রশ্নে বলেছিলেন, “যে ঈশ্বর আমাদের ইন্দ্রিয়, বিচারবুদ্ধি এবং ধীশক্তি দিয়েছেন, তিনিই চেয়েছেন আমরা যেন তার ব্যবহার বর্জন করি, এ কথা বিশ্বাস করার তাগিদ আমি অনুভব করি না।” ধর্মান্ধের দেশে সদ্য-সমাপ্ত বঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে শাসক-বিরোধী উভয় দলই যুক্তিতর্কের আধারে না থেকে সংখ্যাগুরু আর সংখ্যালঘুবাদের আশ্রয়েই জীবন সঁপে দিলেন। ভোট বড় বালাই! তাই অদৃষ্টবাদের হাত ধরেই সমাজ এগিয়ে চলেছে। এমনকি ৩৪ বছরের বাম শাসনেও রাজ্যের মানুষ যথার্থ যুক্তিবাদী হয়ে উঠতে পারেন না। বিজ্ঞান মঞ্চের প্রতিরোধ ব্যর্থ করে অবিজ্ঞানের পূজারি হয়ে ওঠেন। রক্ষণশীল কট্টর হিন্দুবাদী দলের ফাঁদে পা বাড়ায় বিরোধী দলগুলোও! বিজ্ঞানকে সমাজ জীবনের উন্মুক্ত পরিসরে এনে মানুষের চেতনার মাটিকে উর্বর করাতে দেশের রাজনৈতিক দলগুলির অনীহা অবিজ্ঞানের জয়গান গায়। ধর্মান্ধতায় আচ্ছন্ন দেশ গণেশের দুধ খাওয়া পেরিয়ে এসে গোমূত্রে করোনানাশের তত্ত্বে আশ্রয় নেয়। তবুও অঙ্গদান এবং প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে এই সময়ের কিছু কাজ অত্যন্ত প্রশংসনীয় ও আশার আলো জাগায়। আসল কথা, বিজ্ঞানচেতনায় গুরুত্ব আরোপের ক্ষেত্রে ধর্মান্ধতা এ দেশে এক কঠিন বাধা। তাই এই করোনা কালেও লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাবেশে সাড়ম্বরে ধর্মীয় অনুষ্ঠান উদ্যাপিত হয়। দেশের অর্ধেক মানুষ মাস্ক ব্যবহার করেন না। বিজ্ঞানকে প্রাত্যহিক জীবনে বরণ করে নেওয়াই এই সময়ের চ্যালেঞ্জ।
সঞ্জয় রায়, দানেশ শেখ লেন, হাওড়া
যুক্তির কষ্টিপাথর
পথিক গুহের নিবন্ধের সূত্র ধরে বলি, গণপরিসরে বিজ্ঞানমনস্কতা তৈরি করতে হলে শিক্ষাকে ধর্মমুক্ত করতে হবে। চার পাশে ধর্মভিত্তিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যে ভাবে ছড়িয়ে আছে, তা প্রমাণ করে যে, শিক্ষানীতি ধর্মীয় বিষয় থেকে মুক্ত নয়। তা ছাড়া, প্রার্থনা সঙ্গীত হিসেবে যে সঙ্গীত বেশির ভাগ বিদ্যালয়ে গাওয়া হয়, তাও ধর্মীয় আধারেই।
আর এখন কারিগরি দিক ছাড়া বিজ্ঞানের অন্য ভাবনা নিয়ে কেউ ভাবে না। বর্তমান পরিসরে বিজ্ঞানের ছাত্র, শিক্ষক, এমনকি ‘বিজ্ঞানী’ বলে পরিচিত বেশির ভাগ মানুষকেই ধর্মীয় কুসংস্কার আঁকড়ে থাকতে দেখা যায়। যুক্তির কষ্টিপাথরে যাচাই করার মতো মন তৈরি থেকে শতযোজন দূরে থাকেন তাঁরা। ফলে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বাদ দিয়ে বলা যায়, বিজ্ঞানের শিক্ষকসমাজ তাঁদের বর্তমান পরিসরে ছাত্রের মধ্যে বিজ্ঞানের কারিগরি দিক ছাড়া বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে পারেননি। পারলে রাজনৈতিক নেতাদের বিজ্ঞানচর্চা নিয়ে মাথাব্যথার কারণ থাকত না। সেই কারণেই অ্যারিস্টটল, ব্রুনো, গালিলেও প্রমুখ বিজ্ঞানের জন্য
সত্য বলার অপরাধে যে জীবন উৎসর্গ করেছেন, তা শুধু গল্প হয়েই বেঁচে থাকে।
নরেন্দ্রনাথ কুলে, কলকাতা-৩৪
এ তো ধ্বংসযজ্ঞ
‘এক ডজন ভবন ভেঙে ‘কংগ্রেস-মুক্ত’ রাজপথ’
(২১-৫) পড়ে স্তম্ভিত হলাম। কেন্দ্রীয় সরকারের সেন্ট্রাল ভিস্টা প্রকল্প রূপায়ণের পরিণামে এ তো ধ্বংসযজ্ঞ হতে চলেছে! প্রায় এক ডজন ঐতিহ্যপূর্ণ সরকারি ভবন ভেঙে ফেলা হবে, যার মধ্যে আছে জাতীয় লেখ্যাগারের অ্যানেক্স ভবন এবং ন্যাশনাল মিউজ়িয়াম! কেটে ফেলা হবে দু’হাজার পরিণত গাছ! নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের দাবি, হেরিটেজ সংরক্ষণ কমিটি ও পরিবেশ কমিটির ছাড়পত্র নেওয়া হয়েছে। যদি এই দুই কমিটি সত্যিই সরকারি প্রার্থনা মঞ্জুর করে থাকে তবে বলতে হয়, তারাও অপরাধ করেছে।
জাতীয় লেখ্যাগার বা ন্যাশনাল আর্কাইভ এক সম্পদ। লেখ্যাগারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক নথিপত্রের সিংহভাগ রক্ষিত ওই অ্যানেক্স ভবনেই, যা ধূলিসাৎ হবে অচিরে। এই ভবনে আছে সাড়ে ৪০ লক্ষ ফাইল, ২৫ হাজার দুষ্প্রাপ্য পাণ্ডুলিপি, ১ লক্ষ ঐতিহাসিক মানচিত্র, ২ লক্ষ ৮০ হাজার প্রাক্-আধুনিক নথিপত্র এবং প্রখ্যাত ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত পত্রসম্ভার। এর একটিরও বিনষ্টি বা হারিয়ে যাওয়ার অর্থ অপূরণীয় ক্ষতি। নথিপত্র কোথায়, কী ভাবে সরানো হবে, সংরক্ষণ করা হবে, তার কোনও পরিকল্পনা করা হয়েছে কি না, জানা নেই। কেন বিশিষ্ট পণ্ডিত, অভিজ্ঞ লেখ্যাগারিক, যোগ্য আমলাদের নিয়ে কমিশন গড়ে তাঁদের পরামর্শ নেওয়া হল না? বিকল্প সাময়িক লেখ্যাগার কোথায় হবে, তারও ইঙ্গিত নেই। জাতীয় জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই সব নথিপত্রের সংরক্ষণ সরকারের অবশ্য কর্তব্য। সেই দায়িত্ব পালন না করলে জাতির কাছে সেই সরকার অপরাধী। দেশ-বিদেশের ৪,৩১১ জন চিন্তাবিদ, ইতিহাসবিদ ও গবেষক যৌথ ভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আবেদন করেছেন ঐতিহ্যশালী ভবনগুলি ভেঙে বা সরিয়ে ফেলা থেকে বিরত থাকতে। লাভ হবে কি?
নিখিল সুর, কলকাতা-৩৪