—ফাইল চিত্র।
স্বাতী ভট্টাচার্যের ‘মেয়েদের কথার মূল্য’ (২২-৫) প্রসঙ্গে কিছু কথা। কিছু দিন আগে সন্দেশখালির ঘটনায় ধর্ষিতাদের বয়ানের সত্যতা নিয়ে যে নাটক চলেছে এবং তাকে ঘিরে শাসক-বিরোধী যে দড়ি-টানাটানি চলেছে, তা এক কথায় মর্মান্তিক। প্রশ্ন জাগে, তা হলে কি ধর্ষণের যন্ত্রণা নীরবে হজম করতে হবে? অনেক ভয়-লজ্জা-দ্বিধা কাটিয়ে এক জন নির্যাতিতা নিজের অপমানের কথা প্রকাশ করেন। এই বয়ানের আইনি মর্যাদা থাকলেও তা রাজ্য সরকারের সহানুভূতি কুড়োতে পারে না! অন্য দিকে, সমাজ মেয়েটির চরিত্রের জরিপ করতে বসে যায়, ছিদ্রপথে দোষারোপের তিরে বিদ্ধ করে মেয়েটিকে। মেয়েটির বয়ানের সত্যতা নিয়ে যখন প্রশ্ন ওঠে, তখন তিনি আরও গুটিয়ে যান। তাঁর বিপন্নতা বাড়ে, সুবিধা হয় অপরাধীর।
উত্তরপ্রদেশই হোক, বা পশ্চিমবঙ্গ, রাজ্য সরকার অপরাধীকে আড়াল করতে ধর্ষণের ঘটনাকে মিথ্যে প্রমাণ করতে তৎপর হয়ে উঠছে। যখন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সন্দেশখালির মা-বোনদের ধর্ষণের ঘটনাকে ‘রাজ্যের লজ্জা’ বলে দাগিয়ে দিলেন এবং বিরোধীদের চক্রান্ত বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেন, চমকে উঠেছিলাম। ‘রাজ্যের লজ্জা’ বলে অভিযোগকারীকে মানসিক ভাবে আরও চাপে রাখার চেষ্টা চলেছে! মুখ্যমন্ত্রী এক জন মহিলা হয়েও নির্যাতিতার পাশে থাকেন না, তাঁর যন্ত্রণার শরিক হতে চান না, ভাবলে অবাক লাগে, কষ্টও হয়।
ও-দিকে রাজ্যের সাংবিধানিক কর্তা, রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোসের বিরুদ্ধে এক মহিলাকর্মী যৌন হয়রানির অভিযোগ করলে রাজ্যপাল কী করলেন? কিছু সিসিটিভি ফুটেজ জনসমক্ষে দেখালেন, তা-ও আবার অভিযোগকারীর মুখ গোপন না করেই। এমন ভাবে মহিলাদের অপমান আগে কখনও দেখিনি।
সন্দেশখালির ধর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে চাপ দিয়ে অভিযোগ দায়ের, প্রত্যাহার, নাটকীয় প্রচার নিয়ে নির্বাচন পর্বে শাসক-বিরোধীর উন্মত্ত খেলা রীতিমতো পীড়াদায়ক। প্রবন্ধকারের মতোই বলতে ইচ্ছে করে, নিগৃহীতা মেয়েদের সুরক্ষা যদি না-ই দিতে পারে সরকার, অন্তত অসম্মান করা বন্ধ করুক। ধর্ষিতার বয়ানের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা আইনত নিষিদ্ধ হোক।
শুভ্রা সামন্ত, বালিচক, পশ্চিম মেদিনীপুর
বর্বরতা
‘মেয়েদের কথার মূল্য’ পড়ে মনে প্রশ্ন জাগে, নারীর সম্মান রক্ষা করার দায়িত্ব কার? যে মেয়েটি ধর্ষিতা হয়েছেন বলে দাবি করছেন, কেন ধরে নেওয়া হবে যে তিনি মিথ্যা বলছেন? নিজের সম্মান নষ্ট করে কেন মিথ্যা অভিযোগ করবেন তিনি? আসলে এখন মেয়েরা ভয়, লজ্জা থেকে বেরিয়ে এসে তাঁদের প্রতি অন্যায়ের প্রতিকার চাইছেন। তাই সমাজের এক শ্রেণির মানুষ মেয়েদের সাহসের মেরুদণ্ডটা ভেঙে দিতে চাইছেন। যাঁর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে, তিনি আদালতে প্রমাণ করুন যে তিনি দোষী নন। তিনি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার সুযোগ তো পাচ্ছেন। তা হলে কেন আদালতে বিচার হওয়ার আগেই ধর্ষিতা মেয়েটিকে মিথ্যাবাদী বলে দেগে দেওয়া হচ্ছে?
প্রবন্ধকার সঠিক দাবিই করেছেন যে, ধর্ষণের অভিযোগের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা নিষিদ্ধ করা হোক। মিডিয়ার কাজ নিরপেক্ষ ভাবে ঘটনা প্রকাশ করা, কিন্তু সংবাদমাধ্যমের একাংশ হয় অতিরঞ্জিত করে, না হলে পক্ষপাতিত্ব করে সংবাদ পরিবেশন করছে। বিচারের আগেই সমাজমাধ্যমে একটা বিচারকার্য শুরু হয়ে যাচ্ছে। ধামাচাপা দিলে সত্যকে চাপা যাবে না। তবে কিছু মেয়ে ভয় পেয়ে পিছিয়ে আসবেন, অভিযোগ করতে যাবেন না, যেটা একেবারেই কাম্য নয়। তাতে মেয়েদের বিরুদ্ধে যৌন অত্যাচার, ধর্ষণের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। তাই রাষ্ট্রের উচিত ধর্ষণের অভিযোগের সত্যতা নিয়ে কোনও রকম প্রশ্ন তোলা নিষিদ্ধ করা। একেই মেয়েদের নিরাপত্তা বলে কিছু নেই, তার উপর এই ধরনের সামাজিক চাপ তাঁকে আরও দুর্বল করে দেবে। মেয়েদের প্রতি এই ধরনের আচরণ এক ধরনের বর্বরতা।
সর্বানী গুপ্ত, বড়জোড়া, বাঁকুড়া
দায়ী রাজনীতি
রাজ্যের শাসক ও বিরোধী দলগুলির কাছে নারীধর্ষণ এক স্পর্শকাতর বিষয়। এই অপরাধের অভিযোগ প্রয়োগে যে কোনও শত্রুকে সহজেই ঘায়েল করা যায়। কামদুনি, সন্দেশখালি এবং রাজভবনের ঘটনাগুলি তারই দৃষ্টান্ত। বাম আমলেও এ রাজ্যে সিঙ্গুরে তাপসী মালিককে ধর্ষণ ও হত্যা করে পুড়িয়ে ফেলা থেকে শুরু করে বানতলা, ধানতলা, বিরাটি প্রভৃতি বহু জায়গায় জঘন্য নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু ওই সব ঘটনা সন্দেশখালির মতো এত প্রচারের আলোকে আসেনি। কারণ, তখন দুর্বল ছিল রাজ্যের বিরোধী দল। গণমাধ্যম এবং সমাজমাধ্যম এত সক্রিয় ছিল না। তাই এই সব ঘটনা পুলিশ-প্রশাসন চেপে যেত। বর্তমানে বিরোধী দলগুলির সক্রিয়তা, গণমাধ্যম ও সমাজমাধ্যমে চর্চা চোখে পড়ার মতো। ধর্ষিতাকে নিয়ে সকলে মিলে ঘটনার সত্যতা জানতে যে ভাবে টানাহেঁচড়া করে, তাতে ধর্ষিতাকে শুধু অমর্যাদাই করা হয় না, তাঁর পরিবারও সঙ্কটে পড়ে। মনে পড়ে একটি বাংলা ছবির দৃশ্য, যেখানে এক পিতা একটি কাগজে লিখে রেখেছিলেন, “আমার ধর্ষিতা কন্যা ভাল আছে।”
এই ধরনের বিড়ম্বনার জন্য মূলত দায়ী রাজনৈতিক দলগুলো এবং পুলিশ। পুলিশ কি পারে না নিগৃহীতার অভিযোগকে গুরুত্ব দিয়ে অভিযুক্তকে থানায় এনে, দু’জনকে মুখোমুখি বসিয়ে তাঁদের কথার সত্যাসত্য যাচাই করতে? অনেক ক্ষেত্রেই অভিযোগ ওঠে, পুলিশ মামলা করে দোষীকে শাস্তিদানের পরিবর্তে দু’পক্ষের মধ্যে একটা রফা করে। তাই দু’জনকেই দ্রুত আদালতে পেশ করে আলাদা আলাদা ভাবে বিচারকের কাছে জবানবন্দি নিয়ে, দ্রুত আইনি পথে মামলার সুবিচারের ব্যবস্থা করা দরকার। যাতে রাজনৈতিক দলগুলি ধর্ষিতাকে নিয়ে মিটিং-মিছিলের মাধ্যমে তাঁকে হেনস্থা করতে না পারে।
তপনকুমার বিদ, বেগুনকোদর, পুরুলিয়া
পুরুষের মূল্য
‘মেয়েদের কথার মূল্য’ পড়ে অবাক হতে হল। এ সমাজে তা হলে পুরুষদের কোনও মূল্যই নেই! পুরুষদের মানবাধিকার তো কার্যত শূন্যতেই আটকে রইল। দেখা যাচ্ছে দুনিয়ার যত রক্ষাকবচ, যত রকমের আইন সবই সংরক্ষিত হচ্ছে নারীদের জন্যই। ‘মানবাধিকার’ বিষয়টি যে নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, সেটা জনগণকে ভুলিয়ে দিয়ে পুরুষের প্রতিপক্ষ করে তোলার জন্য অনেক আগেই তৈরি হয়েছে ‘মহিলা কমিশন’। এই রকম বিচিত্র একপেশে ব্যবস্থা বিশ্বের ক’টা দেশে বর্তমান, তা জানতে বড় ইচ্ছে হয়।
প্রবন্ধকারের দাবি, ধর্ষিতার বয়ানের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা আইনত নিষিদ্ধ হোক। ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে প্রকাশ্যে সন্দেহ প্রকাশ করলে শাস্তি হোক জনপ্রতিনিধিদের। এর অর্থ তো এটাই দাঁড়ায়, মেয়েদের অভিযোগের সারবত্তা নিয়ে কোনও প্রশ্ন তোলা যাবে না। কী অদ্ভুত যুক্তি! যেন পরোক্ষে এটাই বলতে চাওয়া হচ্ছে যে, নারী কখনও কোনও পুরুষকে বিপদে ফেলতে পারেন না। তাই ধর্ষণের অভিযোগের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা অনৈতিক কাজ হিসাবেই গণ্য হবে। ফলে সব সময়েই পুরুষকে নতজানু হয়ে অবস্থান করতে হবে।
শক্তিশঙ্কর সামন্ত, ধাড়সা, হাওড়া