Illegal Firecracker Factories

চাই কড়া শাস্তি

আগামী দিনে এগরা, বজবজ, দত্তপুকুরের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা কখনও সম্ভব হবে না, যদি না সমস্যার গভীরে গিয়ে এর নিরসনে যথাযথ পদক্ষেপ করা হয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৫:০৮
Share:

দত্তপুকুরের বিস্ফোরণস্থল। —ফাইল চিত্র।

এগরার খাদিকুলের পর মাস তিনেক যেতে না যেতেই দত্তপুকুরে প্রশাসনিক ঔদাসীন্য ও চরম গাফিলতির সুযোগ নিয়ে রমরমিয়ে চলতে থাকা বেআইনি বাজি কারখানায় ভয়াবহ বিস্ফোরণ এবং তার মর্মান্তিক পরিণতিস্বরূপ ঝরে গেল বেশ কিছু প্রাণ। সবচেয়ে মর্মান্তিক এবং হৃদয়বিদারক খবর হল— মৃতদের মধ্যে রয়েছে দু’জন শিশুশ্রমিকও। যথারীতি এর পর আমরা দেখতে পেলাম কিছু ঘটনার সম্মিলিত পুনরাবৃত্তি। সংশ্লিষ্ট ঘটনাকে কেন্দ্র করে মিডিয়ার ঘন ঘন ব্রেকিং নিউজ়, কলকাতার পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েল এবং রাজ্য পুলিশের ডিজি মনোজ মালবীয়কে মুখ্যমন্ত্রীর জরুরি তলব, দত্তপুকুর থানার আইসি ও নীলগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়ির ওসি-কে সাসপেন্ড করা, মুখ্যমন্ত্রীর কড়া বিবৃতি প্রদান এবং রাজনৈতিক বিবৃতি-পাল্টা বিবৃতির চিরচেনা ছবি! অতঃপর, আমাদের সবার মনে একটাই প্রশ্ন— এ বার কী হবে? এগরার বাজি কারখানায় বিস্ফোরণ-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলে হয়তো এই ‘কী হবে’-র উত্তরটা আমরা সহজেই অনুমান করে নিতে পারব! আর সেটা হল— অভিযুক্তদের গ্রেফতার এবং কিছু দিন পরেই তাদের জামিনে মুক্তি পাওয়ার চিরাচরিত ঐতিহ্যের পুনরাবৃত্তি!

Advertisement

আগামী দিনে এগরা, বজবজ, দত্তপুকুরের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা কখনও সম্ভব হবে না, যদি না সমস্যার গভীরে গিয়ে এর নিরসনে যথাযথ পদক্ষেপ করা হয়। আর এ জন্য প্রশাসনকে কঠোর হতে হবে। রাজনৈতিক প্রভাব ও কলুষমুক্ত হয়ে প্রশাসনকে সম্পূর্ণ স্বাধীন ভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে এবং দোষীদের কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। বিকল্প কর্মসংস্থান হিসাবে সবুজ বাজি বিক্রির উপর জোর দিতে হবে। পাশাপাশি, জাতীয় পরিবেশ আদালতের ২০১৫ সালের রায়কে হাতিয়ার করে সমস্ত অবৈধ বাজি কারখানা অবিলম্বে ভেঙে ফেলতে হবে। সুনির্দিষ্ট ‘মাসোহারা’ দিলেই প্রশাসনের নাকের ডগায় অবাধে নানা ধরনের অবৈধ কাজকর্ম চালানোর ছাড়পত্র পাওয়া যায়— জনমানসে বদ্ধমূল হয়ে যাওয়া এই ধারণার শিকড় উপড়ে ফেলতে হবে পুলিশ-প্রশাসনকেই।

সৈকত কর্মকার, গোবরডাঙা, উত্তর ২৪ পরগনা

Advertisement

প্রশ্রয় কার?

গত ছ’মাসে বাজি বিস্ফোরণের ফলে পশ্চিমবঙ্গে মৃত্যু হয়েছে ত্রিশের কাছাকাছি। মাত্র কিছু কাল আগে এই রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মাসাধিক কাল ধরে বোমা আর আগ্নেয়াস্ত্রের হাড়হিম করা যে সন্ত্রাস দেখেছে রাজ্যবাসী, তাতে মনে হচ্ছে গোটা রাজ্যই যেন এই মুহূর্তে বারুদের স্তূপের উপর দাঁড়িয়ে আছে।

দত্তপুকুরের এই বিস্ফোরণের অভিঘাত এতটাই ছিল, যে বাড়িতে অবৈধ বাজি তৈরি হচ্ছিল, সেটি তো ধুলোয় মিশে গিয়েছেই, এমনকি আশপাশের বেশ কয়েকটি বাড়িও প্রচণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে, তা হলে কি অবৈধ বাজি তৈরির নামে রাসায়নিক বোমা, বা আরও ভয়ঙ্কর কিছু তৈরির চক্রান্ত চলছিল? বিশেষজ্ঞদের মতে, দত্তপুকুরের এই বিস্ফোরণের সঙ্গে ২০১৪ সালের অক্টোবর মাসে বর্ধমানের খাগড়াগড় বিস্ফোরণের মিল আছে। তবে কি নিষিদ্ধ বিদেশি জঙ্গি সংগঠনগুলি আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে? তা-ই যদি হয়, তবে কে বা কারা এদের মদত দিচ্ছে? দ্রুত সঠিক এবং নিরপেক্ষ তদন্ত হলে তবেই এই প্রশ্নগুলির উত্তর সামনে আসবে। আর কয়েক মাস পরেই লোকসভা নির্বাচন। সুতরাং, রাজ্য সরকার এবং বিশেষ ভাবে কেন্দ্রীয় সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে।

এই রাজ্যের সঙ্গে অন্যান্য বিদেশি রাষ্ট্রের সীমান্তগুলির উপর এবং কুখ্যাত করিডরগুলির উপর কড়া নজরদারির প্রয়োজন। দত্তপুকুরের স্থানীয় বাসিন্দারা এই অবৈধ বাজির কারবারিদের সঙ্গে পুলিশ এবং বর্তমান শাসক দলের কিছু নেতার এক অনৈতিক এবং প্রাণঘাতী আঁতাঁতের অভিযোগ তুলেছেন। এ রাজ্যের মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে অবশ্য ইতিমধ্যেই সাসপেন্ড করা হয়েছে দত্তপুকুর থানার আইসি এবং নীলগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়ির ওসি-কে। কিন্তু এটাই শেষ কথা নয়। দেখতে হবে, এই ষড়যন্ত্রের জাল কত দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে।

পরিশেষে, ২০১৫ সালে জাতীয় পরিবেশ আদালতের নির্দেশে বলা হয়েছিল যে, বিস্ফোরণের জেরে মৃত্যু এড়াতে এবং পরিবেশ বাঁচাতে সমস্ত বেআইনি বাজি কারখানা ভেঙে ফেলতে হবে। এমনকি, কয়েক মাস আগে এগরার বিস্ফোরণের পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কয়েকটি জায়গাতে বাজি হাব তৈরির নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে, দু’টি নির্দেশই আজ পর্যন্ত যথাযথ পালিত হয়নি। আদৌ হবে কি— এটাই এখন লাখ টাকার প্রশ্ন।

অমিত কুমার চৌধুরী, কলকাতা-৭৫

প্রাণঘাতী

‘নিচুতলার পুলিশেই ক্ষোভ মুখ্যমন্ত্রীর’ (২৯-৮) শীর্ষক প্রকাশিত সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যেতে পারে, দত্তপুকুরের বাজি বিস্ফোরণের ঘটনায় শুধুমাত্র পুলিশকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে রাজ্য সরকার নিজের দায় এড়িয়ে যেতে পারে না। মনে প্রশ্ন জাগে, আর কত প্রাণের বিনিময়ে টনক নড়বে সরকারের? বাজির কারণে সারা বছর ধরে আরও অনেক ছোটখাটো দুর্ঘটনার কথা অনেক সময়ই লোকচক্ষুর অগোচরে থেকে যায়। সংবাদে প্রকাশ, যাঁরা এই বাজি কারখানার বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করেছিলেন, তাঁদেরই বেছে বেছে গ্রেফতার করা হয়েছিল। স্থানীয় প্রশাসন এ সব জানে না, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। এক শ্রেণির ভোটব্যাঙ্কের কথা মাথায় রেখে বাজি শিল্পকে আড়াল করার সরকারের এই প্রবণতা কারও চোখ এড়ায় না। অথচ দুর্ভাগ্যজনক এটাই যে, প্রায় সমস্ত বিরোধী দলই এই ধরনের ঘটনার পর শুধুমাত্র বিবৃতির মাধ্যমে ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমে পড়ে। কিন্তু সেই ভোটব্যাঙ্কের কথা মাথায় রেখে তারাও অঙ্গীকার করে না যে, এই প্রাণঘাতী শিল্পের ক্ষেত্রে কোনও অবস্থাতেই মদত দেবে না।এই বাজি কারখানার বিস্ফোরণের তীব্রতা কেন এত বেশি ছিল, স্থল থেকে উদ্ধার রাসায়নিক এবং এর অদূরেই চিহ্নিত ‘গবেষণাগার’ সেটা বুঝিয়ে দেয়।

প্রশাসনের তরফে কালীপুজোর কয়েক দিন আগে থেকে লোকদেখানো কিছুটা নজরদারি, ধরপাকড় প্রতি বছরই দেখা যায়। তার পর সারা বছর আর কোনও উদ্যোগ চোখে পড়ে না। সবুজ বাজিই হোক বা অন্য যে কোনও বাজি, এর থেকে নির্গত সমস্ত ধরনের ধোঁয়াই যেমন পরিবেশের পক্ষে ক্ষতিকর, আবার এর শব্দও আমাদের কানে কোনও সুরের মূর্ছনা তোলে না। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, কালীপুজো ও ছটপুজোতে দু’ঘণ্টা করে এবং ইংরেজির নববর্ষে পঁয়ত্রিশ মিনিট, অর্থাৎ সাকুল্যে চার ঘণ্টা পঁয়ত্রিশ মিনিট বাজি পোড়ানোর অনুমতি আছে। এ ছাড়াও বাজি পোড়ানোর ক্ষেত্রে প্রয়োজন আগাম অনুমোদনের। সেখানে রাজ্য সরকার নিজের আইনকেই উপেক্ষা করে সারা বছর বাজি বিক্রির জন্য উদ্যোগী হয়েছে বাজির ক্লাস্টার ও হাব তৈরির জন্য। পরিবেশের পক্ষে এই সিদ্ধান্ত যে কতটা আত্মঘাতী, বলার অপেক্ষা রাখে না। অন্নের সংস্থান করে, এই অজুহাতে সরকার সব কিছু জেনেও না জানার ভান করে থাকে। অথচ এই বিস্ফোরণে প্রাণ যায় অধিকাংশ শিশু ও মহিলা শ্রমিকদের। এখানে কাজ করে মানুষ আক্রান্ত হন দুরারোগ্য ফুসফুসের ব্যাধিতে। বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্পে অনুদান খাতে রাজ্য সরকার যে অর্থ ব্যয় করে, তার অনেকটাই চলে যায় অপেক্ষাকৃত সচ্ছল পরিবারে। অথচ, সেই বিপুল পরিমাণ অর্থ কাজে লাগানো যেতে পারে এই শ্রমিকদের পুনর্বাসনে। দিল্লি, মেঘালয় প্রভৃতি রাজ্যের মতো নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন বাজি পোড়ানো। এর ফলে বোমার যথেচ্ছ উৎপাদন ও ব্যবহার স্তিমিত হয়ে কমবে অপরাধের সংখ্যা। শুধুমাত্র প্রশাসনই নয়, এগিয়ে আসতে হবে সমস্ত পরিবেশপ্রেমী নাগরিক ও বিরোধী রাজনৈতিক দলকে জোটবদ্ধ হয়ে, অবিলম্বে।

অশোক দাশ, রিষড়া, হুগলি

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement