Bengali Language

সম্পাদক সমীপেষু: অদ্ভুত মিশ্রণ

সরকারি কাজে বাংলা ভাষাকে যেমন প্রাধান্য দিতে হবে, তেমনই সরকারি চাকরিতে অগ্রাধিকার দেওয়া চাই বাংলা ভাষার জ্ঞানকে। সমস্ত সর্বজনীন ফলকে বাংলা লেখা বাধ্যতামূলক করতে হবে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০২৩ ০৪:৫২
Share:

এক দিন একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করলেই মাতৃভাষার প্রতি দায়িত্ব শেষ হয় না। ফাইল চিত্র।

‘মিলনের ভাষা’ (১-৩) শীর্ষক সম্পাদকীয়তে যথার্থই উল্লেখ করা হয়েছে যে, “...নিছক চলতি হাওয়ার পন্থী হওয়ার নেশায়, অহেতুক এবং নির্বিচারে অন্য ভাষার শব্দ ও শৈলীকে আত্মসাৎ করলে ভাষার সমৃদ্ধি হয় না, দূষণ ঘটে।” অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিকে গণমাধ্যমে কথা বলার সময়ও দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি কথায় ব্যবহার করা হচ্ছে, ‘বাট’ ও ‘বিকজ়’ শব্দ দুটো। সম্প্রতি বাংলায় ফুটবলের ধারাবিবরণীর একটা নমুনা— “কোচের সাইড লাইনে অ্যাবসেন্স টিমের পারফরম্যান্স-এ হিউজ এফেক্ট করছে। পুরো টিমটারই উইথ দ্য বল রিকভার সো পুওর যে, অপোনেন্ট টিম এভরি টাইম হাফ চান্স আর্ন করছে। এখন হাফটাইমে ড্রেসিংরুমে নিজেদের মধ্যে ডিসকাশনের পর তাদের খেলার মধ্যে যদি স্পার্ক ফিরে আসে, তবেই টিমের পক্ষে সেটা হেল্পফুল হবে।” সম্পাদকীয়তে উল্লিখিত “মিশ্রণ এমন মাত্রায় পৌঁছে যাচ্ছে যে, তাকে বাংলা ভাষা বলে চিনতে সমস্যা হয়”— কথাটা এই পরিপ্রেক্ষিতে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলা ভাষা দিয়ে আমাদের জীবন-জীবিকা চলবে না, এই বোধ আমাদের মধ্যে সুকৌশলে প্রবেশ করানো হচ্ছে ব্যবসায়িক স্বার্থেই। ইংরেজি সাল সম্বন্ধে অবগত থাকলেও, অনেকেই বলতে পারব না সঠিক বাংলা সন। এক দিন একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করলেই মাতৃভাষার প্রতি দায়িত্ব শেষ হয় না। সরকারি কাজে বাংলা ভাষাকে যেমন প্রাধান্য দিতে হবে, তেমনই সরকারি চাকরিতে অগ্রাধিকার দেওয়া চাই বাংলা ভাষার জ্ঞানকে। সমস্ত সর্বজনীন ফলকে বাংলা লেখা বাধ্যতামূলক করতে হবে। অনুপ্রেরণা হতে পারে দক্ষিণের রাজ্যগুলো।

Advertisement

অশোক দাশ, রিষড়া, হুগলি

চুক্তিতে নিয়োগ

Advertisement

গত কয়েক বছর ধরে খবরের কাগজ ও অন্যান্য মাধ্যমে রাজ্যের তথা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থিত কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়গুলির শিক্ষক-শিক্ষিকা ও অশিক্ষক কর্মচারী নিয়োগের বিজ্ঞাপন চোখে পড়ছে। সবই চুক্তির ভিত্তিতে নিয়োগের বিজ্ঞাপন। অথচ, ভারত সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে কেন্দ্রীয় বিদ্যালয় সংগঠনের ১২৪৫টি বিদ্যালয়ের জন্য সম্পূর্ণ পৃথক একটি কেন্দ্রীয় স্তরে নিয়োগ পদ্ধতি রয়েছে। যার মাধ্যমে এই বিদ্যালয়গুলির নানা শাখার জন্য শিক্ষাকর্মী নিয়োগ করা হয়ে থাকে। এই ১২৪৫টি বিদ্যালয়ে নিয়োগের জন্য প্রবেশিকা মূল্যায়নের মাধ্যমে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক বেছে নেওয়া হত। কিন্তু বর্তমানে এগুলিতে স্থানীয় ভাবে, চুক্তির ভিত্তিতে নিয়োগ হচ্ছে। কেন্দ্রীয় সংস্থায় স্থায়ী পদগুলোতে অস্থায়ী ভাবে নিয়োগ হচ্ছে কেন? স্থায়ী পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতা অনেক বেশি। চুক্তির ভিত্তিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে এত সব আর্থিক দায়বদ্ধতা থাকে না, চুক্তির মেয়াদও এক বছরের হয়ে থাকে, যার ফলে আর্থিক দিকটা অনেকটাই নিজেদের ইচ্ছেমতো পরিচালনা করা যায়। চুক্তির ভিত্তিতে নিযুক্তদের বেতনও অনেক কম।

একই কাজের দায়িত্ব পালন করে এক জন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক যখন দেখেন যে, তাঁর সমকক্ষ ও সমমানের সহকর্মী তাঁর তুলনায় অনেক বেশি আর্থিক সুবিধা পাচ্ছেন, যা তাঁকে সরাসরি সামাজিক ভাবেও সুবিধা পেতে সাহায্য করছে, তখন তিনি অনুৎসাহী হয়ে পড়বেন, এটাই স্বাভাবিক। স্থায়ী পদে শিক্ষক-শিক্ষিকারা অবসর নিলে তাঁদের স্থান চুক্তির ভিত্তিতে পূরণ করা হচ্ছে। এতে নিয়োগের উপর ভিত্তি করে শিক্ষক-শিক্ষিকা ও অশিক্ষক কর্মচারীদের মধ্যে অলিখিত গোষ্ঠী তৈরি হচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে ছাত্রছাত্রীদের উপরেও। লেখাপড়ার মান, ছাত্র-ছাত্রীদের নানা রকম কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করানো, তাদের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণে উৎসাহ দেওয়া-সহ নানা বিষয়ে আজ কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়গুলি পিছিয়ে পড়ছে। গত কয়েক দশক পূর্বে যাঁরা দেশের নামী-দামি কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী ছিলেন, তাঁরা আজ অনেকেই তাঁদের জীবনে প্রতিষ্ঠিত। অভিজ্ঞতা দিয়ে দেখেছেন যে, তাঁদের সেই প্রাণের কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়গুলি ক্রমশ ঐতিহ্য হারাচ্ছে। অনেকেই ছেলেমেয়েদের কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ে ভর্তি করতে চাইছেন না।

কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ের বর্তমানে মোট ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ১৪ লক্ষ। মোট অনুমোদিত শিক্ষক-শিক্ষিকা, শিক্ষাকর্মী ও অশিক্ষক কর্মচারীর সংখ্যা ৬৫,২১৩। কিন্তু বর্তমানে ৫০,৪২৫ জন কর্মী তাঁদের পদে কর্তব্যরত অবস্থায় রয়েছেন। বাকি আসনগুলো শূন্য। অর্থাৎ, ৭৭ শতাংশ কর্মী নিয়ে কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়গুলি কাজ করছে। তাতে সার্বিক ভাবে ছাত্রছাত্রীদের ক্ষতি। আর তার উপর যদি স্থায়ী পদের পরিবর্তে অস্থায়ী পদে নিয়োগ করে কাজ চালানো হয়, তা হলে কি উপযুক্ত মান বজায় রাখা সম্ভব?

আশিস রায়, কলকাতা-৮৪

রামপ্রসাদের গান

এক দিকে ঈশ্বর সাধনা, অন্য দিকে সমাজের চলমান ঘটনার উল্লেখ— এই দুইয়ের মেলবন্ধন রামপ্রসাদ সেনের গানকে চিরকালীন সাহিত্য রসে সিক্ত করেছে। রামপ্রসাদ সমকালীন জমিদারি প্রথার ছবিও তুলে ধরেছিলেন অকপটে। তিনি ছিলেন মাতৃভক্ত। মায়ের কাছে অভিযোগ কিংবা আকুতির আশ্রয় ছিল তাঁর গান। নিতান্ত সহজ সুরে সে গান হয়ে উঠেছিল বাঙালির ঘরের কথা। কবির নির্মোহ, নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে প্রচলিত ছক ভাঙার প্রেরণা জুগিয়েছিল। তিনি অকাতরে লিখে ফেলেছিলেন, “তারা আমার নিরাকার”। শাসকের বিরুদ্ধে অবলীলায় উচ্চারণ করেছেন প্রতিবাদের শব্দবন্ধ। তিনি লিখছেন— “প্যাদার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র, তার নামেতে নিলাম জারি।/ ঐ যে পান বেচে খায় কৃষ্ণ পান্তি, তারে দিলে জমিদারী।”

তোষামোদের রাষ্ট্রব্যবস্থার ঘুণপোকার বিরুদ্ধে সেই কলম আজ কোথায়? কবি লক্ষ করেছিলেন, ‘কৃষ্ণ পান্তি’-রা যোগ্যতা ছাড়াই রাজত্ব পেয়ে যান। রাজা হওয়ার শখ বেশির ভাগ মানুষকে যখন উন্মত্ত করে তোলে, অনৈতিক কাজে উৎসাহ জোগায়, তখনও অসহায় মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেছেন কবি রামপ্রসাদ সেন। লিখেছেন, “চাই না মাগো রাজা হতে/... দু বেলা যেন পাই মা খেতে।” দু’বেলা অন্ন জোটে না যেখানে, সেখানে অন্য চিন্তা বৃথা। সমাজের দুই বিপরীত ছবি দেখে কবি চরম সত্য প্রকাশ করেন। লেখেন, “জানিগো জানিগো তারা, তোমার যেমন করুণা।/ কেহ দিনান্তরে পায় না খেতে, কারু পেটে ভাত গেঁটে সোনা।/ কেহ যায় মা পালকি চড়ে, কেহ তারে কাঁধে করে,/ কেহ উড়ায় শাল-দুশালা, কেহ পায় না ছেঁড়া টেনা।”

জীবনের চলতি পথে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা থাকে, কবিরও ছিল। বহু সংশয়, বহু অভিমান, তবু আমরা স্বপ্ন দেখি নতুন সকালের। হিংসামুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত এক শুদ্ধ রাষ্ট্রব্যবস্থা যখন সাধারণের পক্ষে গড়ে তোলা সম্ভব হয় না, তখন অসহায় কবি যথার্থ পরামর্শ দেন। বলেন, “বাসনাতে দাও আগুন জ্বেলে—/ ক্ষার হবে তার পরিপাটি/ করো মনকে ধোলাই, আপদ বালাই/ মনের ময়লা ফেলো কাটি।” রামপ্রসাদ একাধারে সাধক ও কবি, এবং দু’টিই সমতালে বিরাজ করত। কবিত্ব গুণের জন্য তিনি কবিরঞ্জন উপাধি পেয়েছেন।

রাজানুগ্রহ ভোগ করে পার্থিব সুখ উপভোগ করতে পারতেন, কিন্তু করলেন না, বরং অসহায় সাধারণ মানুষের জন্য কলম ধরলেন। রামপ্রসাদের কবিতায় যে সুর শোনা গেল, তা বাংলা সাহিত্যে অভিনব। এই প্রথম বৈষয়িক কামনা-বাসনা কবিতার বিষয় হয়ে আত্মপ্রকাশ করল। সৌভাগ্য-সুখ বঞ্চিত সকল মানুষের হয়ে রামপ্রসাদ গেয়ে উঠলেন, “কারেও দিলে ধনজন মা হস্তিরথী জয়ী/ আর কারও ভাগ্যে মজুর খাটা, শাকে অন্ন মিলে কই/ কেহ থাকে অট্টালিকায়, আমার ইচ্ছা তেমনি রই/ ও মা তারা কি তোর বাপের ঠাকুর, আমি কি কেউ নই।” বক্তব্যে অভিযোগ আছে। কিন্তু সাম্যবাদের পক্ষে এমন স্পষ্ট উচ্চারণ, এমন সমন্বয় চিন্তা আজকের দিনেও বিরল।

দীপায়ন প্রামাণিক, গোবরডাঙা, উত্তর ২৪ পরগনা

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement