জেলার সেরা স্কুল ও শিক্ষকদের শিক্ষারত্ন পাওয়ার খবর পড়ে আপ্লুত হলাম। অতিমারিকালে স্কুলের প্রধান শিক্ষক-সহ অন্যান্য শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মীর কঠোর পরিশ্রম ছাড়া এটা অসম্ভব। শিক্ষা দফতরের পুরস্কার দেওয়ার এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাচ্ছি। কিন্তু সাধারণ নাগরিক এবং এক জন শিক্ষক হিসাবে শিক্ষা দফতরের কাছে কিছু প্রশ্ন রাখছি।
যাঁরা ভাল কাজ করেছেন, তাঁরা যদি পুরস্কার পেতে পারেন, তবে যাঁরা এই অতিমারির সময়ে কোনও দায়িত্ব পালন না করে প্রায় দেড় বছর ধরে বাড়িতে বসেই মাসে মাসে বেতন নিলেন, তাঁদের কোনও শাস্তি হবে না কেন? বেসরকারি প্রান্তিক প্রাক্-প্রাথমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলি ব্রাত্য কেন? স্থানীয় শিক্ষিত বেকার যুবকযুবতী পরিচালিত বাংলামাধ্যমের প্রাথমিক ও প্রাক্-প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাঁরা প্রায় ৩০-৪০ বছর ধরে সমান্তরাল ভাবে সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলির মতো করে শিক্ষা দান করে আসছেন, তাঁদের কি কোনও পুরস্কার পাওয়ার অধিকার নেই? এই ধরনের বিদ্যালয়গুলির সমস্ত নথিই তো শিক্ষা দফতরের কাছে আছে। তা হলে তাঁদের ব্যাপারে নির্লিপ্তির কারণ কী? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০১১ সালে মুখ্যমন্ত্রী হয়েই এই প্রান্তিক বিদ্যালয়গুলিকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। তা সত্ত্বেও সেই সমস্ত ফাইল চাপা দিয়ে রাখা হয়েছে কেন?
শিক্ষা দফতরের কাছে অনুরোধ, এই ধরনের বিদ্যালয়গুলিকে যত শীঘ্র সম্ভব স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। আমরা সরকারের আর্থিক সাহায্য চাই না। আমরা চাই সম্মান। আর এই সম্মান দিলে সবচেয়ে উপকৃত হবে বাংলা ভাষা।
রামমোহন চক্রবর্তী, প্রধান শিক্ষক, নবদ্বীপ গৌতম শিশু মন্দির
দায় চাপানো
‘ফল নিয়ে অভিযোগ জানাতে হবে কলেজেই’ (১৭-৯) শীর্ষক খবরটি পড়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাণ্ডজ্ঞান দেখে যারপরনাই বিস্মিত হলাম। উক্ত খবরে এবং সিন্ডিকেটের সংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্তে যা দেখছি— মার্কশিট বিভ্রাটের গোটা দায় অধীনস্থ কলেজগুলির ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়। হয় তাঁরা প্রকৃত খবর রাখেন না, অথবা মূল সমস্যার কেন্দ্র থেকে কোনও বিশেষ কারণে সকলের নজর ঘোরাতে চাইছেন।
আসল ঘটনা হল, এই বিভ্রাটের দায় একা কলেজগুলির নয়। এই বিভ্রাটের দু’টি ধরন আছে। একটি সাধারণ মানবিক ত্রুটি বা ‘হিউম্যান এরর’, যা প্রতিটি সিমেস্টারের শেষে কম-বেশি দেখা যায়। অনলাইনে নম্বর আপলোড করার ব্যবস্থার একাধিক ধাপের কোনও একটিতে সংশ্লিষ্ট পরীক্ষক বা যাচাইকারীর পক্ষ থেকে ভুল নম্বর আপলোড করা এই সাধারণ ত্রুটির প্রথম উৎস। এই বিভ্রাট প্রায় প্রতিটি সিমেস্টারে ঘটে। আগামী দিনেও ঘটবে। কারণ, পৃথিবীতে কেউ এই হিউম্যান এরর শূন্য করতে পারেন না। দ্বিতীয় যে বিভ্রাটের ধরন রয়েছে, তার একমাত্র উৎস হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের একটি সিদ্ধান্ত। ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের ইভেন সিমেস্টার এবং পার্টলি-র সাপ্লিমেন্টারি পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীদের ফর্ম পূরণ না করানোর সিদ্ধান্ত। যার ফলে পরীক্ষার খাতা দেখার পরে কলেজগুলির চোখে একাধিক সমস্যা নজরে আসে। এক, কিছু পরীক্ষার্থীর কোনও তথ্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইন নম্বর আপলোড করার পোর্টালে নেই। দুই, কোনও পত্রে পরীক্ষা দিয়েছে হয়তো চার জন, কিন্তু পোর্টালে তথ্য রয়েছে কয়েক হাজার পরীক্ষার্থীর।
কলেজগুলি বহু আগে থেকেই এই দুই ধরনের সমস্যা বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষানিয়ামকের দফতরের দৃষ্টিতে নিয়ে এসেছে। কিন্তু ঘটনা হল, এই ধরনের সমস্যা দূর করার ক্ষেত্রে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো কোনও সুনির্দিষ্ট নীতি ও ব্যবস্থা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কখনও ইমেল মারফত এক্সেল শিটের ফর্ম্যাট পাঠিয়ে পরীক্ষার্থীদের নম্বর সংশোধন করে পাঠাতে বলেন। কখনও নির্দেশ দেন, অনলাইনে নথি পাঠালে চলবে না, যা কিনা এই অতিমারির সময় একমাত্র উপায়। আবার কখনও কলেজকে প্রতিটি পরীক্ষার্থীর যাবতীয় নথি নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা নিয়ামকের দফতরে লাইন দিয়ে জমা করতে বলা হয়। অতিমারিতে পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের কলেজে নিয়ে এসে সমস্ত নথি জোগাড় করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। এই ভাবে নথি যদিও বা জমা করা হয়, পরীক্ষা নিয়ামকের দফতর সেই নথি জমা নেওয়ার কোনও প্রমাণ দেবে না। আপনাকে নিজ দায়িত্বে সমস্ত নথি ওই দফতরে জমা দিয়ে আসতে হবে। এক বার নয়, একাধিক বার একই নথি কলেজগুলিকে এই অতিমারিতে দূর-দূরান্ত থেকে কলকাতায় ছুটে গিয়ে জমা করে আসতে হবে।
এত কিছুর পরেও কলেজগুলি কী দেখতে পাবে? পরীক্ষার্থীদের ‘রেজ়াল্ট নট ফাউন্ড’। সংশোধিত মার্কশিটের হদিস নেই। কলেজ জানে সেই পরীক্ষার্থী পাশ করে গিয়েছে, তবু ছাত্র বা ছাত্রীটি উচ্চশিক্ষায় ভর্তি হওয়ার ফর্ম পূরণ করতে পারছে না। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কশিট অনুযায়ী, এখনও সে ‘অকৃতকার্য’ই রয়ে গিয়েছে!
এ সবের পরিণামেই হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী ভুক্তভোগী। তাদের সেই সমস্যার সমাধানে একটি স্থায়ী নীতি ও ব্যবস্থা প্রবর্তনের পরিবর্তে বিশ্ববিদ্যালয় নিজেদের দোষ ঢাকতে ও সমস্যার দায় কলেজগুলির ঘাড়ে চাপাতেই ব্যস্ত। কলেজগুলির উপরে দায় চাপিয়ে নম্বরের বিভ্রান্তির স্থায়ী সমাধান কোনও দিনই করতে পারবে না বিশ্ববিদ্যালয়। হিউম্যান এরর প্রতিটি সিমেস্টারেই থাকবে। তাই বলে কি পরীক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আবেদন করে প্রকৃত নম্বর পাবে না?
সমস্যার সমাধানে প্রথমে কলেজ এবং তার পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে সাহায্য চাইতে যাওয়া ছেলেমেয়েগুলোর জন্য নিজেদের দরজা বন্ধ করে দেওয়ার সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তটি কেবল অসংবেদনশীল ও ছাত্রবিরোধীই নয়, দেশের একটি প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।
রোহন ইসলাম, কলকাতা-৮
শিক্ষা ব্রাত্য!
‘শিক্ষার মূল্য’ (৩০-৮) শীর্ষক সম্পাদকীয় একটি কল্যাণরাষ্ট্রের শিক্ষাকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে প্রয়োজনীয় ভূমিকা পালন সম্পর্কে অবহিত করে। করোনাকালে শিক্ষার অপরিমেয় ক্ষতি হয়েছে। এ কথা অনস্বীকার্য যে, এই ক্ষতিসাধনে সবচেয়ে বেশি দায়ী করা যায় সরকারের উদাসীনতাকে। মহামারি বা অতিমারির সময় স্বাভাবিক অবস্থা বজায় রাখা যে কোনও রাষ্ট্র বা সরকারের পক্ষে মুশকিল। কিন্তু সময় যখন অনেকটা কেটে গেল, তখন বিকল্প ব্যবস্থা সরকারের পক্ষে ভেবে রাখার দায় থাকেই। শিক্ষায় ঘাটতি একটি জাতির পক্ষে বিপজ্জনক। অশিক্ষার অন্ধকার ও অজ্ঞানতার বিষফল ভবিষ্যতে একাধিক নতুন সমস্যার জন্ম দেবে।
দীর্ঘ দিন স্কুল বন্ধ থাকায় স্কুলছুটের সংখ্যা বেড়েছে। বেড়েছে নাবালিকা বিবাহের সংখ্যাও। এই স্কুলছুটের দল আর কখনও শিক্ষাঙ্গনে ফিরবে কি? যারা ফিরবে না, তাদের জন্য পরিবেশ ও পরিস্থিতি অনুযায়ী একাধিক বিকল্প পথের ব্যবস্থা করতে হবে সরকারকেই। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়ারা। দীর্ঘ দিন লকডাউনে বাড়িতে পড়া বলে দেওয়ার যাদের কেউ নেই, তাদের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে বিকল্প পদ্ধতি ভাবা হয়নি। ফলে শিক্ষায় অসাম্য এসেছে। সাধারণত এই প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়ারা দরিদ্র পরিবারের। খাবার জোগাড় করতেই মা-বাবার দিন কাটে। তাই কিশোর বয়সেই তাদের কাজের জগতে ঠেলে দিতে বাধ্য হয়েছে পরিবার। স্কুল-কলেজ দীর্ঘ দিন বন্ধ থাকায় পড়াশোনার প্রতি অনীহাও তৈরি হয়েছে।
যত দিন যাবে, ততই শিক্ষার সমস্যা বিচিত্র রূপে ফুটে উঠবে। শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে সুগভীর ভাবনা-চিন্তা ও কার্যকর পদক্ষেপই নতুন প্রজন্মকে অশিক্ষার অভিশাপ থেকে রক্ষা করতে পারে।
অভিজিৎ কাপাস, রাজনগর, পশ্চিম মেদিনীপুর