Mahatma Gandhi

সম্পাদক সমীপেষু: গান্ধীজির নিজস্বতা

অনেক ক্ষেত্রে গান্ধীজির আন্দোলন তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত আপাতদৃষ্টিতে হঠকারী মনে হলেও, এগুলির পিছনে গান্ধীজির সুচিন্তিত পরিকল্পনা এবং নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থাকত।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০২৩ ০৫:১৮
Share:

—ফাইল চিত্র।

বেঞ্জামিন জ়াকারিয়া তাঁর ‘গান্ধী: মহাত্মারও আগে’ (২-১০) প্রবন্ধে লিখেছেন যে, ধর্ম, বিশেষত হিন্দু ধর্ম গান্ধীজির স্বদেশচিন্তার প্রধান স্তম্ভ হলেও, তথাকথিত দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদীদের সঙ্গে তাঁর চিন্তার যথেষ্ট ফারাক ছিল। ফলে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা কখনও তাঁকে পুরোপুরি নিজেদের বলে দাবি করতে সক্ষম হয়নি। আবার দেশে-বিদেশে তাঁর অগণিত ভক্তের উপস্থিতি, এবং খ্যাতির জন্য তাঁকে উপেক্ষাও সম্ভব হয়নি। তাঁর ধর্মচিন্তা ছিল উদার। তিনি মুসলমানদের যেমন ঘৃণা করেননি, তেমনই প্রান্তিক মানুষদেরও সহানুভূতির চোখে দেখতেন। কিন্তু অনেক সময়ই তাঁর কথা ও বাস্তব চিত্রের মধ্যে যথাযথ সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়। গান্ধীজি মনে করতেন, বর্ণব্যবস্থা সমাজকে একটি সংগঠিত রূপ দেয়। বংশানুক্রমিক ভাবে একই পেশা অনুসরণ করার ব্যাপারটিও তিনি খুব স্বাভাবিক বলে দেখতেন, বা বলা যেতে পারে এই ব্যবস্থার মধ্যে তিনি কোনও অন্যায় দেখতে পেতেন না। কারণ তাঁর কাছে প্রত্যেকটি পেশাই ছিল সমান সম্মানের। বাস্তবে দেখা যায়, সম্পূর্ণ দৈহিক শ্রম-নির্ভর পেশার মানুষেরা আজও সমাজে তাঁদের প্রাপ্য সম্মান পান না, অথচ তাঁদের ছাড়া সমাজ অচল। বিশেষ কিছু পেশার জন্য আবার অত্যধিক সম্মান এবং গুরুত্ব বরাদ্দ থাকে, যেমন পৌরোহিত্য।

Advertisement

অনেক ক্ষেত্রে গান্ধীজির আন্দোলন তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত আপাতদৃষ্টিতে হঠকারী মনে হলেও, এগুলির পিছনে গান্ধীজির সুচিন্তিত পরিকল্পনা এবং নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থাকত। দলিতদের জন্য স্বতন্ত্র নির্বাচকমণ্ডলীর প্রস্তাব গান্ধীজি মেনে নেননি, যাকে কেন্দ্র করে তাঁর সঙ্গে আম্বেডকরের দ্বন্দ্ব চরমে ওঠে। নিম্নবর্ণের মানুষদের ‘হরিজন’ বলে হিন্দুধর্মের অন্তর্ভুক্ত করে রেখে দেওয়ার প্রচেষ্টায় গান্ধীজি সফল হন। পান্নালাল দাশগুপ্ত তাঁর গান্ধী-গবেষণায় মন্তব্য করেন, যাঁরা মনে করেন দলিত মানুষদের হিন্দুসমাজের মধ্যে রেখে দেওয়ার প্রচেষ্টা একটা রাজনৈতিক অপসরণ মাত্র, তাঁদের বোঝা উচিত ভারতের কোটি কোটি হরিজন, মুসলমানের মতামত ভারতীয় আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার কী বিপদ ছিল। দলিতদের উন্নতির থেকেও সমগ্র হিন্দুসমাজকে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করা, বা বৃহত্তর জাতীয় আন্দোলনের স্বার্থই গান্ধীজির মূল লক্ষ্য ছিল বলে মনে হয়। গান্ধীজির কিছু কিছু সিদ্ধান্তকে তাঁর নিজের দল, অর্থাৎ কংগ্রেসের সদস্যরাও সুনজরে দেখতেন না, কিন্তু তাঁর জনসমর্থনের কথা ভেবে নীরব থাকতেন।

ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তাঁর বিভিন্ন চিন্তা এবং রূপরেখার মধ্যে একটি হল, যথাসম্ভব যন্ত্রের সংস্পর্শহীন, পাশ্চাত্য প্রভাবমুক্ত গ্রামের মানুষ স্বনির্ভর হবে, এবং গ্রামীণ সমাজ, অর্থনীতি সমগ্র জাতীয় ব্যবস্থার মেরুদণ্ড হবে। অথচ আধুনিক প্রযুক্তির সুফলগুলিকে এড়িয়ে থাকার কোনও অর্থ হয় না, তা সম্ভবও নয়। সত্যের অনুসন্ধানে, আদর্শ সমাজ গঠনের ভাবনায় গান্ধীজি প্রতিনিয়ত নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন। ফলে তাঁর অনেক চিন্তাভাবনাই ছিল স্ববিরোধী এবং কখনও কখনও বাস্তবের সঙ্গে সংযোগবিহীন। কোনও ভাবেই তাঁকে নিশ্চিন্তে কোনও একটি গোত্রভুক্ত করা যায় না, যা অনেক সময়ই তাঁকে সম্পূর্ণরূপে আত্তীকরণ করার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।

Advertisement

ইমন মণ্ডল, বোটানিক্যাল গার্ডেন, হাওড়া

প্রথম সত্যাগ্রহ

বেঞ্জামিন জ়াকারিয়া লিখেছেন, গান্ধী ভারতে তিনটি বৃহৎ গণ-আন্দোলনের নেতা ছিলেন, অসহযোগ, আইন অমান্য এবং ভারত ছাড়ো। পরাধীন ভারতের প্রেক্ষাপটে এই তিনটি আন্দোলনের প্রভাব ও ব্যাপ্তি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ভারতের মাটিতে প্রথম যে অহিংস সত্যাগ্রহের সফল প্রয়োগ তাঁর নেতৃত্বে সংগঠিত হয়েছিল, প্রবন্ধে অনুল্লিখিত সেই আন্দোলন সম্পর্কে কিছু বলার তাগিদে এই চিঠি। ১৯১৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে প্রত্যাবর্তনের মাত্র দু’বছর পর গান্ধী এই আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯১৭ সালে বিহারের কিছু অঞ্চলের মানুষ খাদ্যাভাব ও দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েন, কারণ নীল চাষ। ব্রিটিশ সরকারের মদতে পুষ্ট নীল ব্যবসায়ী ও ভূস্বামীরা চাষিদের নীল চাষ করতে বাধ্য করছিল। ফলে এক দিকে খাদ্যশস্যের উৎপাদন কমে যাওয়া, অন্য দিকে অতিরিক্ত জল সেচের মাধ্যমে নীল চাষের ফলে জমির উর্বরতা নষ্ট হতে থাকে। রাজরোষ উপেক্ষা করে কয়েক জন যুবক স্থানীয় কাগজে প্রতিবাদ-প্রতিবেদন লিখতে থাকেন, তাঁরা গান্ধীকে প্রতিবাদ আন্দোলনে নেতৃত্ব দানের আহ্বান জানান। ১৯১৭ সালের ১০ এপ্রিল গান্ধী চম্পারণ জেলার আমলোয়া গ্রামে অন্যতম প্রতিবাদী সনৎ রাউতের বাড়িতে আসেন, সঙ্গী ছিলেন ব্রজকিশোর প্রসাদ, রাজেন্দ্র প্রসাদ, অনুরাগ নারায়ণ সিংহ প্রমুখ বিহার কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ। গান্ধীর নেতৃত্বে চম্পারণ মিশনের নেতারা প্রশাসনের কাছে জমির উচ্চ হারে খাজনা হ্রাস, বৃহত্তর অংশে খাদ্যশস্যের চাষ ও অন্যান্য দাবিতে মৌখিক ও লিখিত আবেদন জানান। সেই আবেদনে প্রশাসন কর্ণপাত করেনি। তখন মিশন অহিংস শান্তিপূর্ণ সত্যাগ্রহের সিদ্ধান্ত নেয়, যার প্রথম পদক্ষেপ ছিল নীল চাষ বন্ধ করা। সত্যাগ্রহ শুরুর আগেই জেলায় অশান্তি ও উত্তেজনা ছড়ানোর অভিযোগে গান্ধী গ্রেফতার হন। মোতিহারি জেলা আদালতের বিচারক গান্ধীকে ১০০ টাকা জরিমানা ও বিহার ত্যাগের শর্তে মুক্তির আদেশ দেন। গান্ধী দু’টি শর্তই প্রত্যাখ্যান করলে তাঁকে আটক রাখা হয়। উপস্থিত সাধারণ মানুষ গান্ধী-মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ অবস্থান শুরু করেন, বেলা যত গড়িয়ে চলে মানুষের দল কাতারে কাতারে বিক্ষোভে শামিল হতে থাকেন। আদালত চত্বর ছাড়িয়ে মোতিহারি শহরের বাজার রাস্তার উপচে-পড়া সত্যাগ্রহীর ভিড়ে স্বাভাবিক জনজীবন কার্যত স্তব্ধ হয়ে যায়। ব্রিটিশ প্রশাসন হতভম্ব! নিরীহ গরিব চাষিদের এ রকম ক্ষোভ প্রতিবাদ তারা আগে কখনও দেখেনি। শেষ পর্যন্ত প্রশাসন আন্দোলকারীদের প্রায় সব শর্ত মেনে নেয়। আর্থিক ক্ষতিপূরণের পরিমাণ বৃদ্ধি, দুর্ভিক্ষ শেষ না হওয়া পর্যন্ত খাজনা মকুব ও অন্যান্য কৃষক সহায়ক উদ্যোগের ঘোষণার ফলে আন্দোলন প্রশমিত হয়। সরকার ‘চম্পারণ অ্যাগ্রারিয়ন বিল’ পাশ করে যা পরে অ্যাগ্রারিয়ন ল (বিহার ও ওড়িশা)-১৯১৮ নামে গৃহীত হয়, সেই সঙ্গে শেষ হল ঐতিহাসিক চম্পারণ সত্যাগ্রহ। ভারতের মাটিতে গান্ধীর নেতৃত্বে সংগঠিত প্রথম ও সফল সত্যাগ্রহের দুটো বিশেষ দিক উল্লেখ দাবি রাখে। এক, চম্পারণে তিনি যাঁর বাড়িতে ছিলেন, সেই সনৎ রাউত তাঁকে প্রথম ‘বাপু’ বলে সম্বোধন করেন। দুই, হতভম্ব ব্রিটিশ সরকার বুঝতে পারে না গান্ধীকে তারা কী ভাবে নেবে— অন্য কংগ্রেসিদের মতো এক জন ইংরেজি-শিক্ষিত প্রতিবাদী কিন্তু অনুগত প্রজা, না কি কট্টর বিদ্রোহী! চম্পারণ সত্যাগ্রহের সাফল্যের নৈতিক উৎকর্ষ গান্ধীকে পরবর্তী রাজনৈতিক জীবনে পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে চালিত করে।

বুদ্ধদেব চট্টোপাধ্যায়, কুলটি, পশ্চিম বর্ধমান

রোজগার

‘হাঁসজারু’ সম্পাদকীয় (৪-১০) যুক্তিসঙ্গত ও ইতিবাচক সমালোচনা। তবে ‘নন-প্র্যাকটিসিং অ্যালাওয়েন্স’-এর পরিবর্তে ডাক্তারদের রোজগার প্রকল্প মোটেই গ্ৰহণযোগ্য নয়, বেশির ভাগ চিকিৎসক তা মনে করছেন। বাম জমানার অন্তিমলগ্নে এই ধরনের অতিরিক্ত আয়ের প্রকল্প শুরু হয়। অঙ্কুরেই তার বিনাশ হয়েছিল মূলত চিকিৎসককুলের অসহযোগিতায়। বিকেলে হাসপাতালের আউটডোরেই ১০০ টাকার পরিবর্তে রোগী দেখার বিশেষ প্রকল্প ছিল, সেখানে সব ধরনের স্বাস্থ্যকর্মীর অতিরিক্ত আয়ের সুযোগ ছিল। তৃণমূল সরকারের হাসপাতালে পেয়িং বেড তুলে দিয়ে সব কিছু বিনামূল্যে পাওয়ার ব্যবস্থা, এবং প্রায় সবার জন্য স্বাস্থ্যসাথী বিমা প্রকল্প বাস্তবোচিত নয়। জনপ্রিয় ভোটমুখী প্রকল্পের চেয়ে দরিদ্রের উপযুক্ত চিকিৎসা বিনামূল্যে করার ব্যবস্থা অনেক বেশি কার্যকর ও বাস্তবসম্মত।

বাসুদেব দত্ত, চৈতলপাড়া, নদিয়া

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement